গুনে গুনে ঘুষ খান তিনি

>

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সংস্থা প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিসিআইই), ঢাকার নিয়ন্ত্রক মো. শহিদুল হক নিজ অফিসে বসেই উৎ​কোচ গ্রহণ করেন প্রকাশ্যে। সেই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর ‘গুনে গুনে ঘুষ খান তিনি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় প্রতিবেদন। একই সঙ্গে এ ঘটনার ভিডিও প্রকাশ করা হয় প্রথম আলো অনলাইনে। ভিডিও ও মুদ্রিত—এই দুইয়ের সমন্বয়ে প্রতিবেদনটি আলোড়ন সৃষ্টি করে।

.
.

চেয়ারটা কাঠের। চেয়ারের পেছনে গোলাপি তোয়ালে। টেবিলের ওপর ল্যাপটপ, মুঠোফোন ও ফাইলের স্তূপ। বৈদ্যুতিক পাখা চলছে। নিচে সবুজ কার্পেট বিছানো সুসজ্জিত কক্ষ। কক্ষটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সংস্থা প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিসিআইই), ঢাকার নিয়ন্ত্রক মো. শহিদুল হকের।
সরকারি এই কক্ষে বসেই ঘুষের কারবার চালাচ্ছেন শহিদুল হক। পাঁচটি ভিডিওচিত্রে ঘুষ গ্রহণের এ দৃশ্য ধরা পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, শহিদুল হক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন, গুনে গুনে টাকা বুঝে নিচ্ছেন। হাসতে হাসতে সেই টাকা আবার নিজের প্যান্টের পকেটে পুরছেন। শহিদুল হকের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে করা গোপন ভিডিওচিত্রসহ সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী। অভিযোগ আমলে নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
বিদেশ থেকে কোনো পণ্য আমদানি করতে গেলে সিসিআইই থেকে আমদানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি) নিতে হয়। বিদেশে কোনো কিছু রপ্তানি করতে গেলেও এই দপ্তর থেকে নিতে হয় রপ্তানি নিবন্ধন সনদ (ইআরসি)। এই দুই সনদের ক্ষেত্রেই ঘুষের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে জানা গেছে। কাগজপত্র ঠিক থাকুক আর না-ই থাকুক, ঘুষ ছাড়া তাঁর কাছ থেকে কেউ কোনো সনদই নিতে পারেন না বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানান, পুরো ঘুষ-বাণিজ্যেরই নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিসিআইইর ঢাকা কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রক শহিদুল হক। যোগাযোগ করা হলে বাণিজ্যসচিব
হেদায়েতুল্ল­াহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত চলছে। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
আমদানি-রপ্তানির পরিমাণের ভিত্তিতে আইআরসি ও ইআরসির মাশুল (ফি) নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, সনদের জন্য নগদ টাকা লেনদেনের সুযোগ নেই। আর ভিডিওগুলোতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, শহিদুল হক নগদ টাকা নিচ্ছেন। বাণিজ্যসচিবকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে অপরাধ উঠে এলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই নেওয়া হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, গত ঈদুল আজহার আগে বাণিজ্যসচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থিত সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত সবাই শহিদুল হকের ঘুষ গ্রহণের ভিডিওচিত্র দেখেছেন। কর্মকর্তারা খোলামেলা ঘুষ গ্রহণের ঘটনায় যতটুকু বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয়েছেন এই ভিডিও করা কীভাবে সম্ভব হলো তা নিয়ে। এরপরই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন সচিব।
জানতে চাইলে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সদর আলী বিশ্বাস গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তদন্তের কাজ শুরু করেছেন এবং আশা করছেন দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিবেদন শেষ করতে পারবেন।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ অক্টোবর সিসিআইই কার্যালয় পরিদর্শন করবেন সদর আলী।
রাজধানীর মতিঝিলের জনতা ব্যাংক ভবনের পেছনে সিসিআইইর প্রধান কার্যালয়। সারা দেশে ১৫টি শাখা রয়েছে সংস্থাটির। ঢাকা ও চট্টগ্রামে রয়েছেন একজন করে নিয়ন্ত্রক এবং রাজশাহী ও খুলনায় রয়েছেন একজন করে যুগ্ম নিয়ন্ত্রক। এর বাইরে বরিশাল, রংপুর, কুমিল্ল­া, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, সিলেট, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁয় রয়েছেন একজন করে সহকারী নিয়ন্ত্রক। তাঁরাই যে যাঁর কার্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি।

এর মধ্যে প্রধান কার্যালয় যে ভবনে, ঢাকা কার্যালয়ও একই ভবনে। এ বিষয়টিও ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন।

এদিকে সংস্থাটির প্রধান ব্যক্তি হিসেবে যেসব ফাইলে সই করার কথা প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক মজিবুর রহমানের, সেগুলোতেও সই করছেন ঢাকা কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রক শহিদুল হক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ঢাকা কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রক এ কাজ করলেও প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক কিছু বলছেন না।

এর রহস্য কী, জানতে চাইলে প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক মজিবুর রহমান বলেন, তাঁর সই শহিদুল হক করছেন ঠিক, তবে ব্যাপারটি নিয়ে তিনি বাণিজ্যসচিবের সঙ্গে মৌখিক আলাপ করে সম্মতি নিয়েছেন।

শহিদুল হক ঘুষ গ্রহণ করে থাকলে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি কীভাবে দায় এড়াবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে মজিবুর রহমান বলেন, ‘এটা ঠিক, আমি দায় এড়াতে পারি না। তবে আমি নিজে ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই।’

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিলে সিসিআইই থেকে একই দিনে এমনকি দুই ঘণ্টার মধ্যে আইআরসি ও ইআরসি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কাগজগুলো হচ্ছে ট্রেড লাইসেন্স, চেম্বার বা স্বীকৃত বাণিজ্য সংগঠনের বৈধ সদস্যতা সনদ, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), ব্যাংক প্রত্যয়নপত্র এবং লিমিটেড কোম্প­ানির ক্ষেত্রে যৌথ মূলধন কোম্প­ানি ও ফামর্সমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে অনুমোদিত সংঘস্মারক ও সংঘবিধি এবং সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন।

গত মঙ্গলবার সিআইআইই কার্যালয়ে গিয়ে জানতে চাইলে শহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নিজের দপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ও বাইরের দালালেরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে পারেন, আগেও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কিছু হয়নি এবং হবেও না বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ‘আপনি নগদ টাকা গুনে গুনে নিচ্ছেন এবং এক টাকাও কম নেবেন না বলে জানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে মন্তব্য করুন।’ এ কথা শুনেই তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। বলেন, ‘দপ্তরটা অনেক অগোছালো ছিল। অনেক চেষ্টা করে শৃঙ্খলার মধ্যে এনেছি। আর আমার এখানে তো কেউ ঢুকতেই পারে না। এই যে দেখুন, দুপুর ১২টা বাজে। একটা লোককে আসতে দেখেছেন?’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদেতর মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় আছেন বলেও জানান তিনি।

শহিদুল হক ১৯৮৫ সালে বিসিএস বাণিজ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরি শুরু করেন। সিসিআইইর আগে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে (ইপিবি) গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শৃঙ্খলাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে চাকরিজীবনে একাধিকবার তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজড) হন শহিদুল হক।

আরও পড়ুন :