পয়ঃশোধনাগারে বিষাক্ত মাছ ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামের বাজারে

>

বিষাক্ত বর্জ্যের পা​িনতে চাষ হয় মাছ। সে​ই মাছও হয়ে ওঠে বিষাক্ত। রাজধানীর পাগলার শ্যামপুরে ওয়াসার প​য়ঃশোধনাগারের লেগুন বা জলাশয়ে চাষ ​হতো এসব মাছ। আর তা বিক্রি হতো ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে। জনস্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর এই বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয় ২০০২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি।

.
.

রাজধানীতে পাগলার শ্যামপুরে পয়ঃশোধনাগারের লেগুন বা জলাশয়ে এখন শুধু পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, আফ্রিকান মাগুর, সিলভার কার্প ও নাইলোটিকা নয়, ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে রুই, কাতলা, মৃগেল আর নলা অর্থাৎ​ সাধারণ প্রচলিত দেশি মাছও। ঢাকার বাজারে এগুলো বিক্রি হচ্ছে। তেলাপিয়া ও মাগুর মাছ চট্টগ্রামেও যাচ্ছে। ক্রেতাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, তঁারা ওই মাছ কিনছেন এবং সেসব স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর।
গোটা রাজধানীর লাখ লাখ মানুষের প্রাত্যহিক মল এবং অন্য বর্জ্যসহ নর্দমার দূষিত পানি জমা হওয়া ওই জলাশয়ে অতি দ্রুত যে মাছ বেড়ে ওঠে তাতে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম, মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকর ধাতব, রাসায়নিক ও অণুজীব থাকে। এ মাছ খাওয়ার পরিণামে ভোক্তা অজ্ঞাতসারে জন্ডিস প্রভৃতি যকৃৎ​, পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্রের কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
নব্বইয়ের দশকে কয়েক বছর এখানে কিছু লোক স্বাধীনভাবে পোনা ছেড়ে প্রায় নিখরচায় মাছ চাষ করে লাভবান হওয়ার পর ওয়াসা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ওই সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোগ্যপণ্য সমবায় সমিতি জায়গাটি লিজ দিতে শুরু করে। তবে ১৯৯৭ সালে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগেই একাধিক বৈজ্ঞানিক সংস্থায় পরীক্ষা করিয়ে মাছ বিষাক্ত প্রমাণ হওয়ায় লিজ নবায়ন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওয়াসার কর্মচারী নেতাদের একটি চক্র এই লাভজনক ব্যবসা ছাড়তে চায় না এবং ব্যবসাটির সঙ্গে সন্ত্রাসী মাফিয়া চক্র জড়িত হয়ে পড়ে।

তবে লিজ গ্রহীতারা লিজ নবায়ন না করার মাধ্যমে পাঁচসালা লিজ বাতিল করার কর্তৃপক্ষীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে বিস্ময়করভাবে স্থগিতাদেশ পেয়ে মাছ চাষ চালিয়ে যাচ্ছে।

২০০০ সালের জুলাই ও ২০০১ সালের এপ্রিলে প্রথম আলোয় দুবার এই পরিস্থিতি সম্পর্কে গুরুত্বসহকারে খবর প্রকাশিত হলেও কোনো ফলোদয় হয়নি। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ মামলায় দুর্বলতা দেখাচ্ছে। একাধিক সূত্র অভিযোগ করেছে, ওয়াসার এই ভূমিকা ইচ্ছাকৃত। হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন ২০০০ সালের আগস্টে। গত প্রায় দেড় বছরে ওয়াসা এ বিষয়ে শুনানির উদ্যোগ নেয়নি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষয়ে রিট মামলার আগাম শুনানির তারিখ নির্ধারণের ব্যবস্থা আছে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় নিয়মিতভাবে রাত ৩টায় লেগুনে জাল ফেলে টানা হয় ভোর ৫টার দিকে। ১৬টি লেগুনের একটিতেই একবার জাল ফেললে একসঙ্গে উঠে আসে কমপক্ষে এক ট্রাক মাছ।

বিভিন্ন পুকুরে জাল ফেলে একবারে অনেক ট্রাকভর্তি মাছ নিয়ে যাত্রাবাড়ী-বিশ্বরোড এলাকা ও শনির আখড়ার মাছের আড়ত এবং কারওয়ান বাজার আড়তে আনা হয় এবং পাইকারি বিক্রি করা হয়। খুচরা বিক্রেতাদের হাতে এসব বিষাক্ত মাছ মিশে যায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আনা ভালো মাছের সঙ্গে ও ছড়িয়ে পড়ে সারা ঢাকার কাঁচাবাজারে। ঢাকার বেশ কয়েকটি হোটেল আড়ত থেকে সরাসরি লেগুনের বিষাক্ত মাছ কিনে নিয়ে যায়। কারণ এ মাছ অপেক্ষাকৃত সস্তা।

সম্প্রতি এক ভোরে সাড়ে পাঁচটায় যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা–সংলগ্ন ডেমরা থানার মাত্র দেড় শ গজ দূরে বিশ্বরোড এলাকায় অবস্থিত আড়তে কৌশলে তথ্য সংগ্রহে গেলে একজন আড়তদারের স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় যে, শ্যামপুর থেকে আসা মাছ তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া যায় বলে সেগুলো কিনতে পাইকারি বিক্রেতারা আগ্রহী এবং খুচরা বিক্রেতারাও সেসব মাছ বিক্রি করে বেশি লাভবান হয়।

শ্যামপুর ওয়াসা গেটের একাধিক দোকানি জানান, বর্তমানে লেগুনে মাছ চাষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত আছেন শ্যামপুর ওয়াসা গেটের বাসিন্দা মমতাজ মিয়া, তার জামাতা, ছেলে এবং বাবুল মিয়া ও ফজল মুন্সি নামের আরো ২ ব্যক্তি। মাছ ধরার সময় থেকে ওয়াসা গেটে অপেক্ষমাণ ট্রাকে ওঠানো পর্যন্ত পুরো সময়ই মমতাজ মিয়ার দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকে। সংবাদসূত্র আরো ইঙ্গিত দেয়, মাছ চাষী চক্র বিষয়টির ক্ষতিকর দিক জনসমক্ষে ঢেকে রাখতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সূত্রাপুর থানা পুলিশকে নিয়মিত লভ্যাংশ দেয়।

১৯৯৭ সালে পয়ঃবর্জ্যভর্তি লেগুনের মাছ পরীক্ষা করেছিল বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার এবং মত্স্য অধিদপ্তর। ওই মাছে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম, ইকোলাই, অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা, ক্যাডমিয়াম, পারদ প্রভৃতি পদার্থ ও অণুজীব পাওয়া যায়।

ওই মাছ চাষ বন্ধ করার আইনি লড়াইয়ে ওয়াসা পিছিয়ে আছে কেন—এই প্রশ্নের জবাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. খন্দকার আজহারুল হক জানান, এ বিষয়ে ওয়াসার আইন কর্মকর্তাকে বারবার তাগিদ দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কাজ এগুচ্ছে না।

আইন কর্মকর্তা মাহবুব হোসেন খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কার্যত তার করার কিছু নেই।

ওয়াসার পক্ষের আইনজীবী সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামনের সপ্তাহে মরিয়া হয়ে বিষয়টির শুনানির তারিখ নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

এদিকে ওয়াসার বাইরে পেশাজীবী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত ওয়াসা বোর্ড আগামী বোর্ডসভায় মাছ চাষের সার্বিক বিষয় সম্পর্কে আইন কর্মকর্তাকে রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দিয়েছে।

মত্স্য ও পশুসমপদ মন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকার কাছে পাগলার লেগুনের বিষাক্ত মাছ চাষের বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য মত্স্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন :