আবাই থেকে আমাদের

>

মাত্র ২৫ বছরের আয়ুষ্কাল নিয়ে আবুল বরকত হয়ে উঠেছেন আমাদের আজন্ম প্রেরণার ‘আইকন’

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ

দুপুর বেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়

বরকতেরই রক্ত।

—‘একুশের কবিতা’, আল মাহমুদ

আবুল বরকত । জন্ম: ১৬ জুন ১৯২৭, মৃত্যু: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
আবুল বরকত । জন্ম: ১৬ জুন ১৯২৭, মৃত্যু: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

সেদিন বৃষ্টি নামেনি, তাজা-টকটকে রক্তই ঝরেছিল; ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েছিল অনেকগুলো প্রাণ—আবুল বরকতও। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের মিছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে বেরিয়ে এল রাজপথে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে তাঁদের গন্তব্য পরিষদ ভবনের দিকে। কণ্ঠে তাঁদের স্লোগান, ‘চলো, চলো, অ্যাসেম্বলি চলো।’ প্রতিটি দলে ছিলেন ১০ জন। পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন ছিল সেদিন। এর মধ্যে ছাত্রদের ওপর নেমে এল নিপীড়ন—কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ। পরে বিকেলে গুলি চলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে, রাস্তায়, সেই সময়ের ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাঠে; কলেজের ভেতরে ছাত্রদের জন্য নির্মিত ছাত্রাবাসও বুলেট থেকে পেল না নিস্তার।
বেলা তখন তিনটার মতো। ছাত্র-জনতার সঙ্গে তীব্র হয়ে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের পুলিশ বাহিনীর সংঘর্ষ। মেডিকেল কলেজের ভেতরে ছাপরার তৈরি যে ছাত্রাবাস, পুলিশ সেগুলো ঘেরাও করে দাঁড়িয়েছে, গুলি ছুড়ছে। পুলিশের এই আক্রমণে আত্মরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের পক্ষ থেকে আসছে প্রতিরোধও—পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করছেন তাঁরা। ছাত্রাবাসের ১২ নম্বর ব্যারাকের বারান্দা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ুয়া দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবুল বরকত দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই বারান্দায়, তাঁর বন্ধু শামসুল বারী ওরফে মোহন মিয়াকে দেখে এগিয়ে আসছিলেন তিনি। দীর্ঘদেহী। শ্যামলা ছিপছিপে একহারা গড়ন। পরনে নীল রঙের হাওয়াই হাফ শার্ট ও খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল। কিন্তু হঠাৎ এল বুলেটের আঘাত—তাঁর তলপেটে গুলি লেগেছে। প্রথমে কেউ বুঝতে পারেনি কী ঘটেছে। ১২ নম্বর ব্যারাকের বারান্দায় বরকত যখন লুটিয়ে পড়লেন, সংবিৎ এল সবারই। তবে যে মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লেন রাঢ়বঙ্গের বরকত, তখন কি তাঁর মনে পড়ছিল ছোটবেলার কথা, নিজের ভেতরে থাকা ‘আবাই’-এর কথা?
প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সবই প্রায় পুরোনো কথা। পুরোনো কথা এ-ও, ছাত্ররা ধরাধরি করে আহত বরকতকে নিয়ে ছুটলেন মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের দিকে। ছাত্রদের এই দলে অন্যান্যের সঙ্গে ছিলেন সেদিনের তরুণ শিল্পী মতুর্জা বশীরও। গণসাহিত্য পত্রিকায় তিনি লিখেছেন ওই সময়ের স্মৃতিভাষ্য, ‘দৌড়ে গেলাম। বেশ লম্বা, শ্যামবর্ণ, মুখমণ্ডল পরিষ্কারভাবে কামানো।...পরনের প্যান্টের পেটের নিচে থেকে কল ছেড়ে দেয়ার মত অঝোরে রক্তের ঢল। সবার সঙ্গে আমিও তাকে ধরেছি, আমার সাদা পায়জামায় কে যেন আবীরের রং পিচকারী দিয়ে রাঙিয়ে দিলো। আমি তাকে ধরেছি বুকের কাছে, আমার মাথা তার মুখের নিকট। একসময় সে চোখ তুলে তাকাল।...পরমুহূর্তে জবাই করা মুরগীর মত হাঁ করে জীভ কাঁপিয়ে ফিস্‌ফিস্ করে বলল, পানি। পানি।’

এই পুরোনো কথা আর জানাশোনা স্মৃতিতে নজর বুলিয়ে ভাষা আন্দোলনের পটভূমিও চোখে ভাসে। মুর্শিদাবাদে জন্ম নেওয়া ছেলেটি, ভূখণ্ডের সীমানা ডিঙিয়ে কীভাবে তিনি ভাষাসংগ্রামের—আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে ‘আমাদের’ হয়ে উঠলেন, ভাষাশহীদ আবুল বরকতের অবয়বকে পূর্ণতা দিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমি অবধারিতভাবেই আসবে সামনে।

দেশভাগের প্রাপ্তি মুসলমানের ‘স্বপ্নভূমি’ পাকিস্তান গঠিত হলো ১৯৪৭ সালে। দেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানা ধরনের শাসন-শোষণ-বঞ্চনার শুরু। ফলে মাত্র তৈরি হওয়া স্বপ্নঘোর কাটতেও সময় লাগেনি।

আঘাতের সূচনা ১৯৪৮ থেকে। প্রথম আঘাত বাংলা ভাষার ওপর। শুরুতে মানি অর্ডার ফরম, পোস্টকার্ড, খাম ও কাগজের টাকার নোট থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়া হলো। ১৯৪৮ সালের মার্চে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন সভায় তিনি বললেন, ‘উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ জিন্নাহর এই বক্তব্যে বাঙালির মনে সেদিন যে ক্রোধের বীজ রোপিত হলো, চারাগাছ থেকে সেটি বৃক্ষ হয়েছে—প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, পরের ধাপে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং সবশেষে রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারিতে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে।

এর মাঝখানে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনও যখন জিন্নাহর সুরে গলা মেলালেন বাংলা ভাষার বিপক্ষে; তখন দিনে দিনে প্রস্তুত হওয়া ভাষার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট স্পর্শ করল তুঙ্গ পরিণতি। ছাত্র-জনতা একাকার হয়ে অগ্রাহ্য করলেন শাসকের রক্তচক্ষু, ১৪৪ ধারা। আর ’৪৮ থেকে ’৫২—এই চার বছরে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন। পরবর্তী সময়ে যা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পথরেখা তৈরি করবে, আমাদের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সব স্তরে দেবে নতুন ভিত্তি—বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই উদ্বোধন-কর্তা হলেন আবুল বরকতরা। বলা ভালো, বায়ান্নই নতুন করে জন্ম দিয়েছে বরকতদের। মাত্র ২৫ বছরের আয়ুষ্কাল নিয়ে আবুল বরকত হয়ে উঠেছেন আমাদের আজন্ম প্রেরণার ‘আইকন’।

হ্যাঁ, এগুলোও পুরোনো গল্প। গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরে বরকত যে পানি চেয়েছিলেন, কাছে-ধারে পানি না পেয়ে মর্তুজা বশীর যে নিজের ঘর্মাক্ত রুমালটি গুঁজে দিয়েছিলেন তাঁর মুখে এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে বরকত তাঁদের বলেছিলেন, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচব না। পুরানা পল্টনে খবর পৌঁছে দেবেন।’ নিঃসন্দেহে এ-ও পুরোনো, জানা। তবে নতুন কথা কী?

নতুন কথা কি এই: ১৯২৭ সালের ১৬ জুন ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্ম নেওয়া ‘আবাই’—আমাদের কাছে যাঁর পরিচয় শহীদ আবুল বরকত—শৈশবে তিনি ছিলেন ফুটবলপ্রেমী, শৈশবে কই মাছের কাঁটা বাছতে পারতেন না। না, এ তথ্যও ভাষাশহীদ আবুল বরকত শিরোনামে বাংলা একাডেমি থেকে বেরোনো পাপড়ি রহমানের বইয়ে লেখা আছে।

২.

মৌলভি শামসুজ্জোহা ভুলু মিয়া ও হাসিনা বেগম দম্পতির দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। বরকত তাঁদের প্রথম সন্তান—সবার বড়। স্বাভাবিকভাবে তাই আদরও খানিক বেশি। শীতের দিনে ছেলে যদি পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে চায়, মা বলেন, ঘরেই গোসল কর, বাবা। পানি গরম করে দিই। পুকুরে যে বড় ঠান্ডা। কে শোনে কার কথা।

ছেলেটি বড় হতে থাকেন। প্রথম শিক্ষাজীবন শুরু হয় বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবে বাবলা গ্রামে আবুল বরকত নামে তাঁকে কজনই-বা চেনে, চেনেন হয়তো স্কুলের মাস্টারমশাইরা। গ্রামের মানুষ তাঁকে চেনে ডাকনামে—আবাই। আবাই লেখাপড়ায় ভালো। তবে দিনে দিনে ছেলেটি যে অস্বাভাবিকভাবে তালগাছের মতো লম্বা হচ্ছে। পরিচিতরা বলেন, বাবলা গ্রামের অন্য সব ছেলের চেয়ে লম্বা আবাই একটু অন্য রকম।

সারা দিন কী যেন ভাবেন আর বই পড়েন। মাধ্যমিক স্তর পার করলেন তালিবপুর স্কুলে। ১৯৪৫ সাল। আবাইয়ের টেস্ট পরীক্ষা শেষ। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। রাত জেগে ছেলেটি তাই পড়ালেখা করেন। মা জানেন, তাঁর বড় ছেলের প্রিয় খাবার ডিম। প্রায়ই রান্না করেন ছেলের প্রিয় খাবার; কিন্তু পড়াশোনার তোড়জোড়ে রোগাপটকা ঢ্যাঙা ছেলেটি প্রায় কিছুই খেতে পারেন না।

এর মধ্যে শুরু হয়েছে দেশভাগের আবহ—হিন্দু-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভাগ হবে দুটি রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। চারদিকে সেই উত্তেজনা। এদিকে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বরকতের মাথায় বেশ ভালোভাবেই ঢুকেছে। পাকিস্তান মানে নাকি স্বপ্নের দেশ? একদিন কথাটি তিনি পাড়লেন মাকে, মা, পাকিস্তান হলে আমি পাকিস্তানে যাব। তবে চৌদ্দপুরুষের ভিটে ছেড়ে মা হাসিনা বেগম পাকিস্তানে যেতে নারাজ।

১৯৪৬। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবেই পাস করলেন আবাই। এবার তো পাততাড়ি গুটিয়ে পাকিস্তানে যেতে কোনো বাধা নেই। ভারত না পাকিস্তান—ভাইবোনদের ডেকে পারিবারিকভাবে রীতিমতো ভোটাভুটির ব্যবস্থা করলেন বরকত। রায় গেল পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু মা অনড়—ভিটে ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না তিনি। অগত্যা বহরমপুর কলেজে আবাই বা বরকতের ভর্তি হওয়া, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে। ১৯৪৮-এ উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন। এবার অবশ্যই পাকিস্তানে যাওয়া যায়। তবে মা অরাজি এবারেও।

বাবাকে লেখা বরকতের চিঠি
বাবাকে লেখা বরকতের চিঠি

তাঁর দুই মামা। বড় মামা আবদুল মালেক সরকারি কর্মকর্তা। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি থিতু হলেন এখানে। এখানেও তিনি বড় চাকুরে। তাঁকে দেখে চলে এলেন অন্যান্য স্বজনও। একদিন বরকতের মামাতো ভাই চিঠি লিখলেন তাঁকে। ‘বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে’ নামে এক লেখায় বশীর আল্‌হেলাল জানাচ্ছেন, ‘আটচল্লিশ সালে হলো ভাষা আন্দোলন। ওর সেই মামাতো ভাই খুব একখানা বাংলা ভাষার আবেগ আর দরদ-মাখানো চিঠি লিখেছিল আবাইকে। আবাই সেই চিঠি পড়ে কেমন একরকম করে হাসল। বলল, আরে দূর, এক বাংলা থেকে যাব আর-এক বাংলায়। আরে, কিসের তোমার ভারত-পাকিস্তান।’
উচ্চমাধ্যমিকের পর একরকম ঘুরতেই বরকত এলেন ঢাকায়, পুরানা পল্টন লাইনের বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে, মামাবাড়িতে। সেই তাঁর পয়লা ঢাকা-দর্শন। তবে দেখতে এসে মায়ায় জড়িয়ে গেলেন শহরটির। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে (১৯৪৮)। রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে তাঁর ভাবনার শুরু অবশ্য কলেজজীবনে, ‘পাকিস্তান যদি মুসলমান রাষ্ট্র হয়, ইসলামে তো জাতিতত্ত্ব নাই। মুসলমান হচ্ছে বিশ্ব-নিখিল জাতি।’
মামাবাড়িতে থেকেই বরকত পড়েন স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে; আমৃত্যু ছিলেন এখানেই। মা-বাবার সঙ্গে নিয়মিত চিঠি যোগাযোগ হয়। ১৯৫০-এর ৪ জানুয়ারি বাবা শামসুজ্জোহা ভুলু মিয়াকে তিনি লেখেন, ‘এখানে আমার প্রায় দেড় বৎসর আসা হইল। তাহার মধ্যে এখানে একটি সার্ট তৌয়ারি করাইয়াছিলাম এবং এবার বাড়ি হইতে আসার সময় বহরমপুর হইতে ২টা পায়জামা মাত্র তৌয়ারি করাইয়াছিলাম। লুঙ্গি, সার্ট, পায়জামা সবই ছেঁড়া অবস্থা।’ তখনকার অধিকাংশ মধ্যবিত্ত মুসলমান যুবকের যে অবস্থা—তাঁরা যেমন মিতব্যয়ী জীবন যাপন করতেন—বরকতও যে এর ব্যতিক্রম নন, বাবাকে লেখা চিঠিই তার সাক্ষ্য দেয়।

১৯৫১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হয়ে স্নাতক (সম্মান) পাস করলেন। এবার তিনি স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র। ‘অস্বাভাবিক’ লম্বা হওয়ার কারণে সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট পরিসরে তাঁকে চিনতে কষ্ট হতো না কারও। চেনাজানা ও হৃদ্যতা ছিল কবি হাসান হাফিজুর রহমান, রফিকুল ইসলাম (পরে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক), আবু নাসের ওয়াহেদ, মোহাম্মদ সুলতানসহ অন্যদের সঙ্গে।

১৯৫২ সালের প্রথমার্ধে আন্দোলনের উত্তুঙ্গ বাতাসের বেগ গোটা ছাত্রসমাজকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে তার দোলা পেয়েছিলেন বরকত, ছিলেন সক্রিয়ও। না হলে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই উন্মাতাল প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের বারান্দায় কেন তিনি ছোটাছুটি করবেন পোস্টার নিয়ে? একুশের সঙ্কলন ’৮০-তে এ প্রসঙ্গে ভাষাসংগ্রামী ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতানের স্মৃতিচারণা: ‘সকাল নয়টায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শেষবর্ষের দীর্ঘদেহী ছাত্র আবুল বরকত মধুর রেস্তোরাঁয় (পুরোটায় তখন অবশ্য বারান্দা ছিল) বগলে একতাড়া পোস্টার নিয়ে ছুটোছুটি করছে। তখনো সে কেন পোস্টার নিয়ে ঘুরছে জানতে চাইলে উত্তর দিয়েছিল, আর কটা তো পোস্টার রয়েছে এই বেলা লাগিয়ে দিই। কাজে লাগবে।’

কাজে লেগেছিল, কাজে লেগেছিল এই ভাষাশহীদের রক্ত। রক্তে কেনা আমাদের অ আ ক খ রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেল ১৯৫৬ সালে।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়া হলে ডা. নুরুল হক বরকতের চিকিৎসা করেন, চেষ্টা ছিল বাঁচানোর। কিন্তু রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়নি। তিনি মারা যান রাত আনুমানিক আটটায়।

একুশে ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা। হাসপাতাল থেকে কড়া পাহারায় আবুল বরকতের মৃতদেহ নেওয়া হলো আজিমপুর কবরস্থানে। এখানেই হলো তাঁর কবর। পরে ২৫ মার্চ ১৯৫২-তে ছোট ভাই আবুল হাসনাত তৎকালীন ঢাকা সদর মহকুমার হাকিম এন আহমেদের আদালতে একটি মামলা দায়েরের চেষ্টা করলেন। মামলাটি নেওয়া হয়নি। নিজেদের অপরাধ ধামাচাপা দিতে শাসকপক্ষ অবশ্য প্রথম থেকেই বরকতকে ‘ভারতের চর’ অপবাদ দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় এলেন বরকত। আর মূলত এই সময় থেকেই ভাষার সংগ্রাম হাওয়া পেতে শুরু করল ধীরে ধীরে। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও আন্দোলনের পুরো পটভূমির সঙ্গে তাঁর যে যোগসূত্র, সেটি কি কেবলই কাকতালীয়? এ আন্দোলনেই ‘আবাই’ থেকে ‘বরকত’-এর হয়ে ওঠা। জাতি হিসেবে হয়ে ওঠা আমাদেরও। আজকের এই জাতিরাষ্ট্র এবং আমাদের যে অবয়ব, তার অন্যতম নির্মাতা বরকত; বরকতরা—এ নিয়ে খুব বেশি নতুন কথা আর কী-ই বা বলা যাবে!

আলতাফ শাহনেওয়াজ: কবি ও সাংবাদিক