মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি

>

একটু চুপ করে থেকে রুমী বলেছিলেন, ‘বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন একটা কথা আছে না, আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমার মতো জানি না, ভোগও করিনি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা-বিষ—সবকিছুর স্বাদ আমি এরই মধ্যে পেয়েছি, আম্মা

শাফি ইমাম রুমী ।  জন্ম: ২৯ মার্চ ১৯৫১, মৃত্যু: তারিখ অজানা
শাফি ইমাম রুমী । জন্ম: ২৯ মার্চ ১৯৫১, মৃত্যু: তারিখ অজানা

রুমীর আম্মা জাহানারা ইমাম যখন রুমীকে বলেছিলেন, ‘রুমী। রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না।’ উত্তরে রুমী প্রথমে একটু হেসেছিলেন। সে হাসিতে অনেক বেদনা ছিল বলে জাহানারার মনে হলো। একটু চুপ করে থেকে রুমী বলেছিলেন, ‘বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন একটা কথা আছে না, আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমার মতো জানি না, ভোগও করিনি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা-বিষ—সবকিছুর স্বাদ আমি এরই মধ্যে পেয়েছি, আম্মা।যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না।’ ২৮ আগস্ট ১৯৭১ সালে শাফি ইমাম রুমী বলেছিলেন এই কথাগুলো। ২৯ আগস্ট রাত ১২টার পর, মানে যে সময়টায় ৩০ আগস্ট শুরু। সেদিন রুমীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সঙ্গে তাঁর বাবা শরীফ ইমাম, ভাই জামীকেও। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন তাঁদের বাসায় থাকা হাফিজ ও মাসুমকেও।
রুমী বাবা-মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন দুবারের চেষ্টায়। প্রথমবার ৭ মে রওনা হয়ে ফিরে আসেন ১১ মে-তে। আবার ১৪ মে রওনা দিয়ে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ফেরেন ৮ আগস্ট। ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সদস্য হিসেবে অপারেশনে অংশ নেন ২৫ আগস্ট। এর পরপরই ২৯ আগস্ট রাতে সারা এলাকা ঘেরাও করে ধরা হয় রুমীকে। গ্রেপ্তারকারী দলটির নেতা ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলেছিলেন, তাঁরা বাড়িটা শুধু একটু সার্চ করবেন। রুমীদের নিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, কেবলই একটু রুটিন ইন্টারোগেশন হবে। আধা ঘণ্টা কি পৌনে এক ঘণ্টায় ফিরে আসবেন বাড়িতে। কিন্তু রুমী সেই যে গেলেন, আর ফিরে আসেননি। ফলে ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ জন্ম হলেও তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় বা তথ্য যেখানে যেখানে মেলে, যেমন উইকিপিডিয়ায়, সেখানে মৃত্যুর জায়গায় লেখা আছে ‘নিখোঁজ’ কোলন দিয়ে ‘৩০ আগস্ট ১৯৭১’।
আদমজী স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, তথা বর্তমানে যেটি বুয়েট, সেখানে। সেই সঙ্গে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির বিভাগে ক্লাস করতেন। এর মধ্যেই তাঁর ভর্তির সুযোগ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। যাওয়ার কথা ছিল সেই বছরই সেপ্টেম্বরে। কিন্তু সবকিছু বাদ দিয়ে রুমী একটি বিষয়কেই আঁকড়ে ধরেছিলেন, সেটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা।

রুমী যখন ই​উওটিসির (এখনকার বিএনসিসি) পোশাকে। ছবি: সংগৃহীত
রুমী যখন ই​উওটিসির (এখনকার বিএনসিসি) পোশাকে। ছবি: সংগৃহীত


জন্মেছিলেন সচ্ছল পরিবারে। বাবা-মা দুজনই উচ্চশিক্ষিত, কেবল তা-ই নয়, রুচিস্নাত সংস্কৃতি-সংলগ্ন তাঁদের জীবন। ঢাকা শহরের অভিজাত মহলে যেমন তাঁদের যোগাযোগ ছিল, তেমনি যোগাযোগ ছিল সেই সময়ের খ্যাতিমান বহু মানুষের সঙ্গে। বলতে কি চৌকস পরিবারের এক চৌকস সন্তানই ছিলেন রুমী। যে কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী থাকা এমন এক মেধাবী সন্তান রুমীকে উদ্ধারের জন্য ‘মার্সি পিটিশন’ করার চিন্তাও করেছিলেন রুমীর স্বজনেরা। তাঁরা বলেছিলেন, ‘ছেলের প্রাণটা আগে। রুমীর মতো এমন অসাধারণ মেধাবী ছেলের প্রাণ বাঁচলে দেশেরও মঙ্গল।’ কিন্তু বাবা শরীফ কোনোভাবেই তাতে মত দিতে পারছিলেন না। ‘খুনি সরকারের কাছে রুমীর প্রাণভিক্ষা করা মানেই রুমীর আদর্শকে অপমান করা, রুমীর উঁচু মাথা হেঁট করা।’ রুমীর শোকে পাগলপারা মা শুরুতে শরীফের দুই বন্ধু বাঁকা ও ফকিরের দিকে থাকলেও, শেষ পর্যন্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে স্বামী শরীফকেই সমর্থন করেন যে রুমীকে অন্যভাবে বের করে আনার যত রকম চেষ্টা আছে, সব করা হবে কিন্তু মার্সি পিটিশন নয়। তাঁরা কিন্তু সাহসী সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিলেন।
রুমী ছিলেন তুখোড় তার্কিক। পড়াশোনাও করতেন বিচিত্র ও বহুমুখী। জুডো-কারাতে শিখতেন, তবলা বাজাতে পারতেন, খেতে পছন্দ করতেন, খাওয়াতে পছন্দ করতেন, পছন্দ করতেন ক্রিকেট, শুনতেন গান—বাংলায় ও ইংরেজিতে; আর তীব্রভাবে যে রাজনীতি-সচেতন ছিলেন, সেটা তো বলাই বাহুল্য। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ঘর ছাড়ার সময় তাঁর ছোট আকারের এয়ারব্যাগে টুকিটাকি কয়েকটি জিনিসের সঙ্গে নিতে ভোলেননি জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতাসুকান্ত সমগ্র। যেমন পড়তেন রবীন্দ্রনাথ, তেমনি পড়তেন সমকালীন কবিতা। শামসুর রাহমানের ‘গেরিলা’ কবিতাটি তখনই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, ‘তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।’ জাহানারা ইমামের নন্দাই একরাম, রুমী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘রুমীর সঙ্গে আলাপ করে আমি তো হতবাক। এইটুকু ছেলে এই বয়সে এত পড়াশোনা করে ফেলেছে? আগে তো ভাবতাম বড়লোকের ছাওয়াল হুশ হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়, চোঙা প্যান্ট পরে, গ্যাটম্যাট করে ইংরেজি কয়—আলালের ঘরের দুলাল। কিন্তু এখন দেখতিছি এ বড় সাংঘাতিক চিজ। মার্ক্স-এঙ্গেলস একেবারে গুলে খেয়েছে। মাও সে তুংয়ের রাইটিংস সব পড়ে হজম করে নিয়েছে। এই বয়সে এমন মাথা, এমন ক্লিয়ার কনসেপশন, বাউরে, আমি তো আর দেখি নাই।’

সুদর্শন হলেও নিজের ফটো তুলতে মোটেও পছন্দ করতেন না রুমী। আত্মপ্রেমের ঊর্ধ্বে ওঠার এই মনটিই হয়তো তাঁকে জীবনের সব সুবিধা পেছনে ফেলে যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল। যোগ দিয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনে। ঢাকায় তাঁর ওপর ন্যস্ত গেরিলা অপারেশন সার্থকভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। ঠিক করেছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনটা উড়িয়ে দেওয়ার।

রুমীকে জানতে হলে জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি-এর একনিষ্ঠ পাঠ ছাড়া উপায় নেই। অত্যন্ত পরিমিতির সঙ্গে নিজের সন্তানের স্বভাববৈশিষ্ট্যের নানা দিক তিনি এতে তুলে এনেছেন। ত্যাগ ও সাহসে রুমী ছিলেন পরিপক্ব। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এক ফাঁকে পিতা শরীফ ইমামকে বলেছিলেন, ‘আব্বু, এরা আমাকে ধরবার আগেই জেনে গেছে ২৫ তারিখে আমরা ১৮ আর ৫ নম্বর রোডে কী অ্যাকশন করেছি, কে কে গাড়িতে ছিলাম, কে কখন কোথায় গুলি চালিয়েছি, কতজন মেরেছি, সব, স-ব আগে থেকেই জেনে গেছে। সুতরাং আমার স্বীকার না করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তোমরা চারজন কিছুতেই কিছু স্বীকার করবে না। তোমরা কিচ্ছু জানো না, এই কথাটাই সব সময় বলবে। তোমাদের প্রত্যেককে হয়তো আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তোমরা কিন্তু সব সময় এক কথাই বলবে। আমি কী করে বেড়াই তোমরা কোনো দিন কিছু টের পাওনি। দেখো, একটুও যেন হেরফের না হয়।’ এভাবেই রুমী নিজের জন্য ভাবেননি।

একজন প্রকৃত যোদ্ধা আর প্রকৃত মানুষের ভেতরে আদতে তো তফাত নেই। তিনি নিজের দায়িত্ব নিজে নেন, নিজের কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে করেন কিন্তু অন্য সবার দিকে তাঁর খেয়াল থাকে। বলা হয়, নিজেকে বা অন্য কাউকেও হারানোর ভেতর দিয়েই ফের নতুন করে পাওয়া হয়। বিশেষ মানুষ অশেষ মানুষ হয়ে ওঠে। রুমী হারিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু এই হারিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়েই আমরা তাঁকে ফিরে পেয়েছি।পেয়েছি তাঁর মায়ের লেখায়। আর স্বাধীন বাংলাদেশে পতাকা যে বাতাসে দীপ্তভাবে ওড়ে, সেই আকাশে একটু খেয়াল করলেই টের পাওয়া যাবে রুমী আছেন, রুমীরা আছেন, দিনে-রাতে, আলো-অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে তাঁদের অস্তিত্ব।

হামীম কামরুল হক: কথাসাহিত্যিক