অপার সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প নিয়ে গবেষণা করছি

>
উচিংলয়েন
উচিংলয়েন
রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। গবেষণা করছেন বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প নিয়ে।

আমার বাড়ি বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার ছাতনপাড়ায়। তালতলীকে উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৩ সালে। আমার ছোটবেলায় তালতলী শিক্ষার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। আমার বাবা পড়াতেন ছাতনপাড়া বৌদ্ধবিহারের একটি পাঠশালায়। গ্রামের অধিকাংশই হাতেখড়ি নিতেন বাবার কাছ থেকে। পশ্চাৎপদ এলাকায় স্বল্প বেতনে কিংবা বিনা বেতনে ছেলেমেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দিয়ে তিনি মানুষ গড়ার গুরুদায়িত্ব পালন করতেন নিরলসভাবে। তাই আয় স্বল্প হলেও শিক্ষক হিসেবে এলাকায় বাবার সুনাম ও সম্মান ব্যাপক ছিল। তাঁকে দেখেই অনুভব করেছিলাম যে শিক্ষকতার চেয়ে মহৎ পেশা আর কিছুই হতে পারে না। তাই ছোটবেলা থেকে শিক্ষক হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করার স্বপ্ন দেখতাম। তবে, যেহেতু কলেজে পড়ার আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতাম না এবং আমার আগে রাখাইন সম্প্রদায়ের কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল না, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব, এমন স্বপ্ন দেখার সাহস পাইনি।
বাবার হাতেই হাতেখড়ি নিয়ে ছাতনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তালতলী ডিগ্রি কলেজ তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এ যাত্রা আমার মতো সামান্য বেতনের শিক্ষকের ছেলের জন্য তেমন সহজ ছিল না। নতুন প্রতিষ্ঠিত আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে বেঞ্চ ছিল না। মাদুর বিছিয়ে ক্লাস করতাম। বর্ষাকালে হাঁটুপরিমাণ কাদা মাড়িয়ে, মাদুর ও স্লেট হাতে নিয়ে স্কুলে যাওয়া খুব কষ্টের ছিল। তবু পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছিলাম। তারপর তালতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং তালতলী ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক—দুই পর্যায়েই সেন্টারের একমাত্র জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ছিলাম আমি। আমাদের স্কুলের ইতিহাসে আমিই ছিলাম প্রথম জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী, তাই রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার দিন প্রধান শিক্ষক থেকে স্কুলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী—সবাই হাজির হয়েছিলেন। গ্রামে যেন উৎসব লেগেছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ পর্যন্ত ভালো রেজাল্ট করার কারণে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেতাম। তাই ওই সময়গুলোতে তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু বিপত্তি বাধে, কলেজ পাস করার পর। তাই জিপিএ-৫ পাওয়ার কারণে মা খুশির সঙ্গে সঙ্গে আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কান্নাও করেছিলেন। কলেজের একমাত্র জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রটির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে—খবরটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে এগিয়ে এসেছিলেন গ্রামের এক কলেজ শিক্ষিকা—চানমে কাকি। তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন, তাঁর বাসায় থেকে আমি দীর্ঘদিন পড়েছি। চানমে কাকির ভাই অং ম্যান্ট কাকাও আমাকে পড়াশোনা–সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিলে বুঝিয়ে দিতেন। যা হোক, কাকির আর্থিক সহায়তায় ঢাকায় কোচিং করতে আসি। মা–বাবার একমাত্র সন্তান বলে কখনো তাঁদের কাছ থেকে দূরে ছিলাম না। তাই ঢাকায় কোচিং করতে এসে প্রথম মাসেই নানা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাড়িতে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। অনেক আর্থিক টানাপোড়েনের সংসারে কাঠখড় পুড়িয়ে আমাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন মা–বাবা, সেই কথাটা তখন মনে পড়ে যায়। তা ছাড়া আমি যে মাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বাড়িতে ফিরে আসার পণ করেছিলাম! তাই ফিরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দিনরাত পড়াশোনা করে ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাতালিকায় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তির জন্য মনোনীত হই। সেদিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখারও শুরু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর জগন্নাথ হলে উঠলাম। কিন্তু আর্থিক সংকট পড়াশোনার পথে একটি বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। টিউশনি না পাওয়ায় মা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আমার পড়াশোনার খরচ জোগান দিতেন। মায়ের কষ্টের কথা ভেবে তাই খুব মন খারাপ করতাম। পড়াশোনায় মন বসত না। ফলে প্রথম বর্ষে ফলাফলও ভালো হলো না। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন প্রায় ফিকে হয়ে এসেছিল। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট শিক্ষাবৃত্তি’ পাই। বছর দুয়েকের মধ্যে একটা টিউশনিও পেয়ে যাই। তারপর মনে জেদ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। অতঃপর, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ডিনস্ অ্যাওয়ার্ডসহ ভালো ফল করার পর ২০১৫ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই।
একজন আদর্শ ও দক্ষ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলাই এখন আমার প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও আদর্শ বুকে ধারণ করে বিভাগে পাঠদানের পাশাপাশি নিজেও নিয়মিত পড়াশোনা করছি। পঠিত বিষয় নিয়ে গবেষণাও করতে চাই। এর অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। একই সঙ্গে নিজের এলাকার সর্বস্তরের সব সম্প্রদায়ের মানুষের এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রান্তিক রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা সম্প্রসারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করতে চাই।
সোনার বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। এ দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত করের টাকায় আমি পড়াশোনা করেছি। নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে দেশকে প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ আমি পেয়েছি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিজের অর্জিত জ্ঞান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করতে চাই। দেশ গড়ার কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে চাই এভাবেই। দেশের অপার সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প নিয়ে গবেষণা করে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পর্যটনশিল্প বিকাশে কাজ করে যেতে চাই।