সারা জীবন কাটুক বিজ্ঞান গবেষণায়

>
আয়েশা আরেফিন
আয়েশা আরেফিন
মানুষের কৃত্রিম ফুসফুস তৈরির গবেষক দলের একজন এই ন্যানোবিজ্ঞানী। স্নাতক গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যালামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে।

শৈশবেই আমি খুব পরিশ্রমী ছিলাম। কেউ আমার জীবনের লক্ষ্য জানতে চাইলে একেকবার একেক উত্তর দিতাম। তবে আমাকে প্রথাগত ধারার বাইরে কোনো পেশা বেছে নিতে হবে, এমন তাগিদ কোনো না কোনোভাবে অনুভব করতাম।
সাফল্য অর্জন ও স্বপ্নপূরণের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। মনে হয়, এসব লক্ষ্যের কোনোটাই আমার ছিল না। তবে আমি স্বপ্নবান। আর যে পথে আছি, সেই পথে হেঁটে আরও অনেকদূর যেতে চাই। ঠিক এ সময়ে আমি ও আমার দল মিলে মানুষের কৃত্রিম ফুসফুস তৈরির কাজটায় প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছি। ওষুধের পরীক্ষায় এই কৃত্রিম ফুসফুস দ্রুত সাড়া দেবে। ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ওষুধ মানুষের ওপর প্রয়োগের আগে এই যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখতে পারবে। ফুসফুসের অসুখবিসুখ, রোগজীবাণুর কার্যক্রম ও ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করতে এই যন্ত্র খুবই সহায়ক হবে।
আমি সবে পিএইচডি প্রাির্থতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আর নিজের গবেষণামূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করব আগামী বছর। এরপর আমি ডক্টরাল-উত্তর গবেষণা করতে চাই। আমার আগ্রহের বিষয়, শারীরবৃত্তিক কারণে প্রাসঙ্গিক অঙ্গ তৈরি করা, যা নতুন নতুন ওষুধ পরীক্ষায় সহায়ক হবে। পাশাপাশি আমি রোগীর ব্যক্তিগত ব্যবহার উপযোগী চিকিৎসাযন্ত্র বানাতে চাই।
কলেজের প্রথম বর্ষে রসায়ন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ছিলাম অপেক্ষমাণ তালিকায়। বুয়েটে ভর্তির আবেদন করার যোগ্যতা আমার ছিল না। অবশেষে আমি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) পড়ার সুযোগ পাই। তাই আমার শুরুর পথটা বেশ অমসৃণ ছিল। কিন্তু আমি হতাশ হইনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ধরন আমার পছন্দ হয়নি। আমি নিজেকে বললাম, থাক। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি গতানুগতিক ধারায় গা ভাসাব না।
প্রতিবন্ধকতাগুলো কঠিন হলেও সামলে নেওয়ার উপযোগী ছিল। আমার মনে পড়ে, ক্লাসে কেউ আমাদের গুরুত্ব দিত না। কারণ, সবাই ধরে নিত আমরা কেবল একটা ডিগ্রি নিতে ওখানে গেছি। তাই আমরা সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো ছেলেকে বিয়ে করে ফেলতে পারি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও আমাদের নিরুৎসাহিত করতেন। তাঁরা বিদ্রুপ করে এমন সব কথা বলতেন, যেগুলো একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এসব কিছুই আমাকে আরও শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছিল।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে জিন প্রকৌশলে স্নাতক হই আমি। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোতে থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ২০১৩ সালে। পিএইচডি শেষ করলাম একই প্রতিষ্ঠান থেকে। ন্যানো সায়েন্স ও মাইক্রো সায়েন্স ছিল আমার বিষয়ে। পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ওষুধ পরীক্ষার জন্য কৃত্রিম অ্যালভিওলি নির্মাণ। ন্যানো মানে হচ্ছে ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। অতি ক্ষুদ্র পরিমাপ এটি। বিজ্ঞানের নতুন প্রজন্ম এই ন্যানোবিজ্ঞান ঘিরেই। যাকে আমি বলি ‘কাটিং এজ’। শরীরে ওষুধ সরবরাহ, টিউমারের ছবি তোলা বা শনাক্ত করা, রোগ নির্ণয়ের কাজে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন বিজ্ঞানীরা |

মানুষের শরীরের কৃত্রিম অঙ্গ নিয়ে গবেষণা করছেন আয়েশা আরেফিন। ছবি: সংগৃহীত
মানুষের শরীরের কৃত্রিম অঙ্গ নিয়ে গবেষণা করছেন আয়েশা আরেফিন। ছবি: সংগৃহীত

স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হওয়াটা ছিল আমার জন্য মনে রাখার মতো। চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য আমাদের একটা প্রজেক্ট শেষ করতে হয়েছিল। সেটা শুরু করতে গিয়ে টের পাই আমার ভেতরে অন্য একটা সত্ত্বার উপস্থিতি, যে কিনা সত্যিকার অর্থেই বিজ্ঞান উপভোগ করে। আমার পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোই আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এসব প্রজেক্টের ফলাফলের ওপর আমার সুখগুলো নির্ভর করতে শুরু করল। আমি আবিষ্কার করলাম, কোনো কিছু সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানতে বা খুঁজে বের করতে এবং সেগুলোর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে কতটা ভালো লাগা আমার মধ্যে কাজ করে। আমি গবেষণার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারলাম। আর সেটা ছিল মোহনীয় একটা ব্যাপার। সেই দিন থেকে আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম, গবেষণায় নিজেকে নিবিষ্ট রাখতে যা কিছু প্রয়োজন, আমি করব। আর সারা জীবন বিজ্ঞান গবেষণায় কাটিয়ে দেওয়ার পথ বেছে নিলাম।
আমার বেশ কয়েকটি স্বপ্নের প্রজেক্ট রয়েছে। কিন্তু আমি অর্থবহ কিছু করতে চাই, যা বিশ্বজুড়ে জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে সহায়ক হবে। আমি এ যাত্রাটাকে নিজের জন্য এবং সেই সব তরুণীর জন্য বেছে নিয়েছি, যাঁরা নিজেদের পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে উৎসাহ পাননি। আমি একজন শক্তিশালী নারী বিজ্ঞানী হতে চাই, যে বিশ্বের সব তরুণীর জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে।
আমার হৃদয়টা আনন্দে ভরে যায়, যখন দেখি শিশুরা নিজেদের কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়ে কিছু করতে চাইছে। আমার প্রত্যাশা, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা শিক্ষাব্যবস্থাসম্পন্ন দেশ হবে। যেখানে ভালো সিজিপিএ অর্জন করায় তেমন কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু শিশুরা একটি মুক্ত পরিবেশ পাবে, যেখানে তারা সঠিক সহায়তা পেয়ে বেড়ে উঠবে এবং নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে।
আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি শিশু বিশেষ মেধা নিয়ে জন্মায়। তবে আমাদের একঘেয়ে শিক্ষাব্যবস্থা সেই মেধা ধ্বংস করে দেয় এবং সব শিশুকে একইভাবে গড়ে তুলতে চায়। আমি তরুণ শিক্ষকদের যতটা সম্ভব সাহায্য করব, যাতে তারা শিশুদের কল্পনাশক্তিকে লালন ও সহায়তা করতে পারে। আমি বাংলাদেশের তরুণীদের জন্যও বড় স্বপ্ন দেখি। তারা এই পৃথিবীতে বড় কোনো প্রভাব সৃষ্টি করার বিপুল সম্ভাবনার অধিকারী। এখন তাঁদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখে পরবর্তী ধাপে পা রাখতে হবে।