প্রোগ্রামিং ও পদার্থবিজ্ঞানে কাজ করে যাব

>
রুহান হাবীব
রুহান হাবীব
এ বছর জাতীয় হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় জুনিয়র বিভাগে চ্যাম্পিয়ন। আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী।

আমি এখন ঢাকার রিজেন্ট এডুকেয়ারে ‘ও’ লেভেলে পড়াশোনা করছি। আরও ছোটবেলায় ডাক্তার হতে চাইতাম। আমার বাবা একদিন একটা এনসাইক্লোপিডিয়া কিনে দিলেন। তারপর থেকে আমার বিজ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছা বেড়ে যায় অনেকগুণ। সেখান থেকেই বিজ্ঞান ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা আমাকে ল্যাপটপও কিনে দেন। ল্যাপটপে অনেক শিক্ষামূলক সফটওয়্যার ছিল। গণিত ও সাধারণ জ্ঞানের গেম ছিল। ল্যাপটপ ধরলেই গেমগুলো খেলতাম। তারপর ইন্টারনেট এল। ইন্টারনেটে খান একাডেমির খোঁজ পেলাম। সেখানে গণিত শিখতে শুরু করলাম। বাসায় সব সময় ল্যাপটপ থাকত না (আব্বু অফিসের জন্য ব্যবহার করতেন)। প্রতিদিন ল্যাপটপের জন্য অপেক্ষা করতাম, অধিকাংশ সময়ই আশাহত হতাম। যখন ল্যাপটপ আসত, তখন সারা দিন ল্যাপটপে নতুন নতুন গণিত শিখতাম। মাঝেমধ্যে এটা মধ্যরাত পর্যন্ত গড়াত। আম্মু আমাকে ঘুমাতে বলতেন, আর আমি বলতাম, ‘আর পাঁচ মিনিট।’
ল্যাপটপে গেম ঢোকাতে পারতাম না। তাই মনে কষ্ট হতো। আর গেম ঢোকাতে পারতাম না বলেই হয়তো বেশি গণিত করার সময় পেতাম। পরে ল্যাপটপ বাসায় স্থায়ীভাবে এল। স্কুল থেকে আসার পরপরই ল্যাপটপ নিয়ে বসে যেতাম। তবে একই জিনিস একটানা করলে একঘেয়েমি লাগে, আমারও তেমন একঘেয়েমি লাগতে শুরু করল। আমি গণিত বাদ দিয়ে প্রোগ্রামিং ভাষা জাভাস্ক্রিপ্ট শেখা শুরু করলাম খান একাডেমিতে। আমার ইন্টারনেট সার্ফিং তখন খান একাডেমি ও গুগলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর আমার কাজিন রিফাত ভাইয়া আমাকে কিছু টিউটোরিয়াল দিল, সেখান থেকে আমি আসল জাভাস্ক্রিপ্ট, তারপর এইচটিএমএল শিখলাম।
ধীরে ধীরে গুগলও ঠিকমতো ব্যবহার করা শিখে ফেললাম। তখন কিডস টিউটোরিয়ালে পড়ি। ২০১৩ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলাম। এটাকে বলা যায় আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ওই সময় রিজওয়ান স্যারের কাছ থেকে অলিম্পিয়াড সম্পর্কে জানলাম। সে বছর ইম্পেরিয়াল কলেজে আমি অলিম্পিয়াডে অংশ নিই। তবে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হওয়ায় ওই অলিম্পিয়াডের নিয়মের কারণে আমি গণিত বা বিজ্ঞানের প্রতিযোগিতাগুলোয় অংশ নিতে পারিনি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্সাহ দেওয়ার মতো শিক্ষক ছিলেন অনেক। আলি স্যার, রিয়ান স্যার, আজিম স্যারসহ অনেক শিক্ষক আমাকে গণিত ও বিজ্ঞানসংক্রান্ত বিষয়ে উত্সাহ দিতেন, অনেক অজানা বিষয়ে জানাতেন।

প্রোগ্রামিং ও পদার্থবিজ্ঞানে দারুণ কিছু করার স্বপ্ন দেখেন রুহান। ছবি: সংগৃহীত
প্রোগ্রামিং ও পদার্থবিজ্ঞানে দারুণ কিছু করার স্বপ্ন দেখেন রুহান। ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সালে জাতীয় অলিম্পিয়াডগুলোতে অংশ নিতে শুরু করি। প্রথমে গণিত অলিম্পিয়াডে গিয়ে আঞ্চলিক পর্ব পার করার পর জাতীয় পর্যায়ে বাদ পড়লাম। সেখান থেকে ফিজিকস ও ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড সম্পর্কে জানতে পারলাম। ফিজিকসে আঞ্চলিক পর্ব পার করতে পারলাম না, তবে অনেক কিছু শিখতে পারলাম, অনেককে চিনলাম। ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে জুনিয়র গ্রুপে দ্বিতীয় হলাম। আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের জন্য জাতীয় দল গঠনের প্রতিযোগিতায় তিন দিন মিলে ৯০০–তে ১৮ পেলাম। এটা আমাকে একটি ভালো শিক্ষা দিয়েছিল।
পরের দুবছর গণিত অলিম্পিয়াডে আঞ্চলিক পর্ব পার করতে পারিনি। মন খারাপ করে ফিজিকস অলিম্পিয়াডে গিয়ে জাতীয় পর্যায় পার করলাম। পরপর দুবারই দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের ডিভিশনাল পার করতে পারিনি। তারপর সে বছরই প্রথম ন্যাশনাল হাইস্কুল প্রোগ্রামিং কনটেস্ট (এনএইচএসপিসি) হলো। আমি আবার যথারীতি জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হলাম। জাতীয় পর্যায়ে আমি শুধু দ্বিতীয় হই—এই ভেবে মন খারাপ করে পুরস্কার নিলাম। এনএইচএসপিসি ক্যাম্পে গেলাম। আমার স্কুল আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। ওটা হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার সময় ছিল। স্কুল আমাকে ক্যাম্প করতে দিল। ওখানে অনেক কোডারের সঙ্গে দেখা হলো, অনেক কিছু শিখলাম।
ক্যাম্পের পরে আমি ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে প্রোগ্রামিং, কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিষয় শিখতে শুরু করি। codeforces.com, lightoj.com—এ রকম সাইট থেকে অংশ নিতে শুরু করি প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের প্রতিযোগিতায়। আমি তখন ক্লাসের পড়াশোনা বাদে বাকি সময়টা প্রোগ্রামিংয়ে দিতে লাগলাম। পরের বছর এনএইচএসপিসিতে জুনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হলাম। তারপর ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে হলাম তৃতীয়। সুযোগ পেলাম বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন ইনফরমেটিকস (আইওআই) টিমে।
তারপর প্রতি সপ্তাহে বুয়েটে গিয়ে কায়সার ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু করলাম অনুশীলন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পে গেলাম। ড. এম কায়কোবাদ স্যারের বাসায় থেকেও প্র্যাকটিস করলাম। আগস্ট মাসে আমরা রাশিয়ার কাজানে যাই আইওআইয়ের জন্য।
মূল প্রতিযোগিতার আগের দিন হালকা জ্বর হওয়ায় মা–বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষমেশ আমি ব্রোঞ্জ পদক পেলাম। আমার স্বপ্ন আইওআইয়ে আরও ভালো রেজাল্ট করে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করার। আশা করি বাংলাদেশ প্রোগ্রামিং, পদার্থবিজ্ঞানে অনেক এগোবে এবং আমি যেন তাতে অবদান রাখতে পারি। দেশে অনেক রেডকোডার, বড় স্টার্টআপ দেখতে চাই।