সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হবে একদিন

>
কিশোর কুমার দাশ
কিশোর কুমার দাশ
পেরুপ্রবাসী এই তরুণ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছেন ‘বিদ্যানন্দ’ নামের এক সংগঠন। যেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শুধু পড়াশোনাই করে না, জীবনের নানা আনন্দে মেতে থাকে।

ভালো কিছুতে সহজে প্রভাবিত হই আমি। সেরা কোনো কাজ দেখলেই সেটা করতে ইচ্ছা করে। ছোটবেলায় স্বপ্নগুলো ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়, স্বপ্ন দেখতাম আইসক্রিম বিক্রেতা কিংবা ফেরিওঅলা হব!
নির্দিষ্টভাবে জনহিতকর কোনো প্রতিষ্ঠান চালু করব, এমনটা মাথায় আসেনি কোনো দিন। অন্য সাধারণ মানুষের মতো সুযোগের আশায় ছিলাম আশ্রয়হীনের পাশে দাঁড়ানোর। নিগৃহীত আর নিপীড়িত মানুষ, যেমন: যৌনকর্মী কিংবা মেথরদের পাশে দাঁড়ানোর দুঃসাহসী চিন্তা মাথায় খেলত মাঝেমধ্যে।
নিজেকে এখনো সফল মনে করি না। আমার কাছে সাফল্য হলো, বিশ্বকে প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে তোলা, ইতিবাচক কোনো কাজে লেগে থাকা কিংবা সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু। এর কোনোটাই আমি অর্জন করিনি এখনো। আর এখনকার এই অবস্থানের জন্য কয়েকটি নিয়ামক কাজ করেছে। প্রথমেই বলব, বর্ণিল ক্যারিয়ারের সঙ্গে রংহীন ব্যক্তিগত জীবনের অসামঞ্জস্যতা। একদিকে তরুণ বয়সেই বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষপদ নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় স্থানান্তরিত হয়েছি আর অন্যদিকে আমার নতুন সংসার ভাঙে অকল্পনীয়ভাবে। ভারসাম্যহীন জীবনে মাথায় আসে শৈশবের ইচ্ছাগুলো পূরণ করার কথা। তবুও এভাবে বিশাল প্রতিষ্ঠান করব, সেটা মাথায় ছিল না। চিন্তাও করিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত আমার প্রতিষ্ঠিত ‘বিদ্যানন্দে’র পাঁচটি শাখায় ৭৫০ জন শিশু পড়বে দুই বছরের মাথায়।
‘ভাগ্যক্রমে’ আমি পদে পদেই ভুগি, কিন্তু সেখান থেকেই জেদ চাপে কিছু করার। এই যেমন ২০১১ সালে প্রথমবার বিমানবন্দর ব্যবহারের সময় বেশ ভুগতে হয়েছে নিয়মকানুনের জন্য। এ কারণেই গত বছর ‘অভিবাসন সহায়িকা’ বের করি আমরা। ২০ হাজার কপি ছাপি বিনা মূল্যে শ্রমিকদের দেওয়ার জন্য। তেমনি বাসায় পড়ার পরিবেশ পাইনি বলে বিদ্যানন্দেই তৈরি করছি ৭ হাজার ৫০০ বইয়ের চারটি পাঠাগার। নিজের শৈশবের ছবি ছিল না বলে ১০ হাজার শিশুর ছবি তুলে প্রিন্ট-লেমিনেটিং করে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। নিজের জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিংয়ের টাকা জোগাড় করতে না পারায় আমরা নিজেরাই চালু করেছি বিনা মূল্যে ভর্তি কোচিং। তরুণ লেখকদের লেখা বিনা মূল্যে প্রকাশ করছি—শৈশবের নিজের কবিত্ব ভাবটিকে শ্রদ্ধা করতে গিয়ে।
আরেকটা ব্যাপার। বিদ্যানন্দের প্রাতিষ্ঠানিক অর্জনের জন্য মূলত স্বেচ্ছাসেবকদের আত্মত্যাগ বড় অবদান রেখেছে। আমি পরিকল্পনা ভাগাভাগি করেই শেষ, বাকিটা তাঁরা অন্ধবিশ্বাসে এগিয়ে নিয়ে চলেন। আর তাঁরা অন্য ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতো স্বেচ্ছাসেবক নয়, পেশাদার রুটিনে দায়িত্ব মেনে কাজ করে বলেই এত অল্প সময়ে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন।
আর্থিক আর সামাজিক বাধা অনুমিত ছিল শুরুতে। তাই এটাতে তেমন প্রভাবিত হইনি। উদার হিসেবে জানা–চেনা নিজেকে ভিন্নভাবে খুঁজে পেলাম প্রকল্পের শুরুর দিকে, বেশ কয়েক মাসের বেতন (বেশ মোটা অঙ্কের) তুলে দেওয়ার সময়। সিদ্ধান্তটি এতই প্রভাবিত করেছিল যে রণে ভঙ্গ দেওয়ার অবস্থা। বাহ্যিক একটা বাধা এখনো বিদ্যানন্দের কাজকে প্রভাবিত করে—ভালো কাজের ওপর আমাদের অবিশ্বাস। ভালো কাজের মধ্যেই আমরা ‘কিন্তু’ খুঁজতে থাকি। খুঁজে না পেলে ‘লোকদেখানো’ তকমা দিয়ে নিজেদের হীনম্মন্যতা ঢাকি। এই অবিশ্বাস গ্রহীতার মধ্যেও আছে। আমি একই ধরনের স্বেচ্ছাসেবী কাজ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর রাজধানী লিমাতেও করি। বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে শিশুদের মধ্যে খাবার বিতরণ করি, আনন্দ অনুষ্ঠান করি, অনুপ্রেরণা দিই।
আজ থেকে অনেক বছর আগে ছোট এক মেয়ে এসে বলেছিল, ‘আপনি বাকিদের চেয়ে আলাদা।’ অবশ্যই সেটি কোনো ভাবান্তর করেনি আশাহত আমাকে। পাগলের বুলি ভেবে আমি যতবারই মন্তব্যটি ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছি, ততবারই সে বলেছে দিনের পর দিন বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে। আস্তে আস্তে কানে বাজতে থাকত এই শব্দগুলো, অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়ার মিষ্টি এক অনুভূতি দখল করতে শুরু করল অলস মস্তিষ্ককে। অন্তত শিশুটির অপরিপক্ব কথার দাম রাখতে হলেও আবার লেখাপড়া শুরু করতে চাইলাম। দুই বছর লেখাপড়ার বিরতি কাটিয়ে মাসিক ২৫০-৩০০ টাকায় টিউশনি করে আবার ভর্তি হলাম ইন্টারমিডিয়েটে। বাকি পথটা ছিল স্বপ্নের মতো।
বিদ্যানন্দের কাজগুলোর মধ্যে মানুষ শুধু খাদ্য, শিক্ষা দেখে, কিন্তু আমি দেখি অনেকটুকু অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হয় এর প্রতিটি কাজে। ভাবুক–টাইপের মানুষ নই আমি। হুটহাট করে নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণ করে ফেলি সহজ চিন্তায়, সহজ লক্ষ্য ঠিক করে। এক যৌনকর্মীর সঙ্গে কয়েক মিনিটের আলাপে একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি একটা ভাসমান বিদ্যালয় বানাব দৌলতদিয়ার পাশে। তেমনিভাবে এক বৌদ্ধভিক্ষুর আহ্বানে গড়ে তুলি একটা এতিমখানা। তবে বড় একটা কাজ করতে চাই আমি। কাজটা হলো সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বিশেষায়িত একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া। শুধু আর্থিকভাবে বঞ্চিতদের জন্য নয়, শারীরিক প্রতিবন্ধী কিংবা সামাজিকভাবে নিপীড়িত মানুষের জন্য হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ থেকে বুদ্ধিমত্তার বিচারে বাছাই করব সেরা মেধাবীদের। তারপর তাদের নিতে চাইব সেরা অবস্থানে, আর তাদের গল্প প্রচার করে অনুপ্রাণিত করতে চাই পুরো বিশ্বকে।
আরও একটা স্বপ্ন আছে, পাগলাটে স্বপ্ন। বহুজাতিক স্বেচ্ছাসেবী গানের দল নিয়ে সারা বিশ্বে কনসার্ট করব মানবতার গান প্রচারে। প্রতিটি শহরে নোঙর ফেলব, গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করব আর আসর শেষে সবাইকে বিনা মূল্যে খাবার দিয়ে সাক্ষী করব স্বার্থহীন কাজে। ইট-পাথরের ক্যালকুলেটরের এই শহরগুলোতে কিছুটা হলেও উষ্ণ বাতাস প্রবাহিত করতে চাই গান দিয়ে, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে।
দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন মাথায় আসে না। কারণ, এটা অনেকটা বাস্তব এখন। তেমনি শিক্ষা কিংবা চিকিৎসাবিষয়ক স্বপ্ন আমার মাথায় আসে না। তবে আমি স্বপ্ন দেখি, হারিয়ে যেতে বসা বাঙালির মূল্যবোধগুলো ফিরে পাওয়ার। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা খুব দ্রুতই প্রভাবিত হয়ে গেছি বাইরের বর্ণবৈষম্য, ধর্মান্ধতা আর জাতিপ্রথা নিয়ে। দেশের সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসবের আগমন আমাদের অন্য দেশের কাতারে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানের সম্প্রীতি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে। উষ্ণ সম্পর্কের পরশ পেতে এখানে ছুটে আসবে শীতল দেশ থেকে। শেয়ারিংয়ের অর্থনীতির নতুন মডেল শিখতে এখানে আসবেন বিদ্বানেরা। জানি, এসব স্বপ্ন অমূলক, তবুও দেখি। এতেই আমি শান্তি পাই।