দেশের মাটির গল্পটাই বলে যেতে চাই

>
মো. তাওকীর ইসলাম
মো. তাওকীর ইসলাম
ভারতের এশিয়ান স্কুল অব মিডিয়া স্টাডিজে সিনেমা নিয়ে পড়ছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে অর্জন করেছেন দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার।

ছোটবেলা থেকে আমার তেমন কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। ঝোঁক ছিল বিভিন্ন বিষয়ে। যেমন রাজশাহীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় পলি আপার সংগঠন ছিল, সেখানে গান শিখতে যেতাম, ছবি আঁকা শিখতে যেতাম। কিন্তু এই ঝোঁকগুলো খুব বেশিদিন ছিল না। তবে এসব থেকে একটা ভূত চাপে। তা হলো অভিনয়ের ভূত। সংগঠন করতে গিয়েই ছোট ছোট নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে এই ভূতটা আরও ভালোভাবে চেপে বসে। এরপর যোগ দিই রাজশাহী থিয়েটারে। সেখানেই অভিনয় শিখি; তখন পড়ি সপ্তম শ্রেণিতে। এত ছোট কাউকে থিয়েটারে সাধারণত নিত না। আমিই সবার ছোট ছিলাম।
অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় যোগ দিই চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহীতে। তখন ফিল্ম সোসাইটিতে ছিলেন রফিক মুয়াজ্জিন ভাই। তাঁকে আমরা সবাই গুরু বলে ডাকতাম। আমার সমকালীন হেমন্ত সাদিক, আজাদ, রায়হানসহ আরও অনেকে মিলে ফিল্ম সোসাইটি শুরু করি। এরপর চলে সিনেমা নিয়ে কাজ। কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম, কোনো সিনেমা একা বানানো সম্ভব নয়। তখন থেকেই একটা দল গড়ার চেষ্টা ছিল। হাত দিলাম সিনেমা তৈরিতে। কিন্তু কারিগরি দিকটা আমি তেমন কিছুই বুঝতাম না। আমার বড় ভাই উমায়ের ইসলাম আমাকে পুরো কারিগরি সহায়তা দিল। নির্মিত হলো আমার প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কঙ্ক পূরাণ। ২০১০ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উত্সবে প্রদর্শিত হলো সিনেমাটি। এবার সিনেমার ভূত খুব ভালোভাবে চেপে বসল। চতুর্থ আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উত্সবে প্রদর্শিত হলো দুটি ছবি—গ্যাস বেলুন ও লামা।
পঞ্চম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উত্সবে প্রদর্শিত হলো আমার পরবর্তী স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দ্য ইউনিট। অর্জন করল সেরা চলচ্চিত্রের খেতাব। আমার প্রতিষ্ঠিত ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম প্রোডাকশনের ব্যানারে ইতিমধ্যে একটা শক্ত দলও দাঁড়িয়ে গেল। গোল ও যোগ নামের পরের সিনেমাটা বানালাম। কাজ করে আমি যেমন খুব আনন্দ পেয়েছি, তেমনি সিনেমাটাও কুড়িয়েছে অনেক সুনাম। যা ছিল আমার জন্য বড় টার্নিং পয়েন্ট। গোল ও যোগ ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উত্সবে সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হলো। ইন্ডিয়ান সিনে ফিল্ম ফেস্টিভাল-২০১৪–তে অর্জন করল সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র (জুরি) পুরস্কার। প্রদর্শিত হলো সাউথ এশিয়ান চলচ্চিত্র উত্সবসহ আরও কয়েকটি উত্সবে। এই সিনেমার বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরো সিনেমা এক শটে নির্মিত।
আমার এই ছোট্ট পথচলায় আমি একটা সিনেমা থেকে আরেকটা সিনেমায় গল্প বলার ধরন, ছবির ট্রিটমেন্টে নতুন কিছু করার চেষ্টা করি। প্রতিবার একটু অন্যভাবে ভাবি। এমন কিছু করতে চাই যেটা আমি আগে করিনি। চেষ্টা করি নিজের সেরাটা দেওয়ার। সেই ধারাবাহিকতায় তৈরি করলাম পরবর্তী স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সিনেমার নাম খুঁজছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এটি। যা নয়ডা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব, ২০১৫–তে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। এই সিনেমার জন্য আমি একদম নতুন পাঁচজনকে খুঁজে বের করলাম। যাঁদের চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে তেমন কোনো পরিচয় ছিল না। তাঁদের শিখিয়ে নিয়ে কাজটা তুলে নেওয়াই ছিল আমার লক্ষ্য। এই পাঁচজনের একজন ছিলেন তুষার ভাই। যিনি চলচ্চিত্রটিতে প্রধান সহকারী পরিচালকের পাশাপাশি সম্পাদনার কাজটিও করেছিলেন। কিন্তু কাজ শেষের কিছুদিন পর তুষার ভাই আত্মহত্যা করেন। এতে আমরা সবাই একদম ভেঙে পড়েছিলাম।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দেশ ও দেশের বাইরে সুনাম কুড়াচ্ছেন তাওকীর। ছবি: সংগৃহীত
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দেশ ও দেশের বাইরে সুনাম কুড়াচ্ছেন তাওকীর। ছবি: সংগৃহীত

এরপরের প্রজেক্ট শুরু হয় বন্ধু সজীব জামানের গল্প থেকে। তাঁর গল্প নিয়েই শুরু করি আয়নার কাজ। খুবই সাধারণ একটা গল্প। নানা সংকটের কারণে বংশপরম্পরায় একজন মানুষকে পারিবারিক পেশাতেই থেকে যেতে হচ্ছে। অন্যকিছু করার ইচ্ছা থাকলেও বাস্তবতার কাছে তাকে হার মানতে হচ্ছে। আমাদের সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে প্রায় একই চিত্র। একজন নরসুন্দর আর তার ছেলেকে নিয়েই এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সিনেমাটি নবম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উত্সবে বাংলাদেশি ইয়াং ট্যালেন্ট পুরস্কার, ভারতের আলপাভিরামা এশিয়ান শর্ট ফিল্ম অ্যান্ড ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোন্ডেন কমা পুরস্কার, ভারতের দাদা সাহেব ফালকে চলচ্চিত্র উত্সব-২০১৬–তে সেরা শর্ট ফিল্ম (স্টুডেন্ট ক্যাটাগরি), সিমলায় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব ২০১৬–তে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের (আন্তর্জাতিক ক্যাটাগরি) পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করে। প্রদর্শিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। এই ছবিতেই প্রথমবারের মতো সেরা পরিচালকের পুরস্কারটি পেলাম। এটা এসেছিল ভারতের পঞ্চম ব্যাঙ্গালুরু ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০১৬–তে, শর্ট ফিল্ম বিভাগে।
আয়নার কাজটা শুরুর পর কেন যেন খুব হতাশ ছিলাম। কিন্তু আমার পুরো ইউনিট আমাকে সমর্থন করেছিল। সবাই কাজটা করার জন্য উত্সাহ জোগাল। তাদের উত্সাহেই কাজটা দাঁড়িয়ে গেল। ছোট্ট এই চলার পথে অনেক মানুষকে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পাশে পেয়েছি। তাঁদের একজন ইমরান হাসান ভাই। আমার যখন যেভাবে দরকার তাঁকে সেভাবেই পাশে পেয়েছি। আর একজন মানুষ, যিনি সব সময় খুব সাহস দিয়েছেন, তিনি হলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম স্যার। আর শুরু থেকেই বলতে গেলে আমাকে সব রকম সমর্থন দিয়ে গেছেন আমার বাবা শহিদুল ইসলাম ও মা মুস্তারি বেগম।
কাজ করতে গেলে বাধা আসে। বাধা জয় করাই হচ্ছে আসল কাজ। বাধায় পড়েছি, কিন্তু সেটা পেরিয়েও এসেছি; আটকে থাকিনি। আমার মনে হয়, রাজশাহীতে থেকে কাজ করার কারণে একটা ওপেন ফিল্ড পেয়েছি। নিজের মতো করে নিজের কাজটা করতে পেরেছি। রাজধানীতে থাকলে হয়তো এই ফিল্ডটা না–ও পেতে পারতাম। অনেকের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারতাম, নিজের মতো করে কিছু করা হতো না।
রাজশাহীতে সবাই এত আন্তরিক, সবাই এত মিলেমিশে থাকে, যা আমার কাজের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। শুরুর জার্নি থেকে এখন পর্যন্ত সবাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। কোনো কাজ করতে গেলে এখনো আহসান কবির লিটন ভাই, মাসুদ ভাই, জাহিদ আঙ্কেলসহ অনেকের সহযোগিতা আমি পাই। আমাদের বাড়ির চারতলায় থাকতেন ফয়সাল মাহমুদ। বয়সে আমার চেেয় বড় হলেও তিনি ছিলেন আমার বন্ধু। কোনো একটা কাজ হাতে নিলেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছায়ার মতো আমার সঙ্গে থাকতেন।
সিনেমা নিয়ে কাজ করতে করতে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনার একটা ইচ্ছা ছিল। পরিবারও আমাকে সমর্থন করল। তারপর ভারতের এশিয়ান স্কুল অব মিডিয়া স্টাডিজে বিএসসি ইন সিনেমায় ভর্তি হলাম (মেজর সিনেমাটোগ্রাফি)। আর কয়েক মাস পর এটাও শেষ হবে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি অনেক ভাগ্যবান। জীবনে অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার, তাঁদের অনেক সহযোগিতাও পেয়েছি। এখানে এসেও সবার অনেক সহযোগিতা পাচ্ছি। এখানে এখন বন্ধুবান্ধব-সিনিয়ররা মিলে নিজের একটা প্রোডাকশন হাউস খোলার চেষ্টা করছি। পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছু কাজ করেছি। বর্তমানে বলিউডের একটা সিনেমাতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করছি। নিজেকে নিয়ে তেমন কোনো স্বপ্ন কখনো মাথায় ছিল না, এই মুহূর্তেও নেই। তবে জীবনে ভালো কিছু সিনেমা বানিয়ে যেতে চাই।
আমার মনে হয়, সিনেমার ক্ষেত্রে একজন পরিচালক নিজেই নিজের টিচার। যত কাজ করছি, ততই মনে হচ্ছে সিনেমাটা শিখছি। একটা অনুষ্ঠানে কোনো একজন বক্তা বলেছিলেন, ‘সিনেমা বানাতে গেলে একজন পরিচালকের তিনটি বিষয় খুব জরুরি—এক. ধৈর্য, দুই. ধৈর্য এবং তিনও ধৈর্য।’ আমারও তা–ই মনে হয়।
সিনেমা নিয়ে অনেক উৎসবে ঘুরেছি। যখন কোনো উৎসবে বা কোনো মঞ্চে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়, তখন আপনাআপনি কেন জানি চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সেটা যে কী আনন্দের, সেটা যে কী সম্মানের, সেটা যে কী অসাধারণ অনুভূতি! তা আমি বোঝাতে পারব না। আমি মনে করি, নিজের কাজটা দায়িত্ব নিয়ে সততার সঙ্গে করলে তা নিজের দেশের জন্য করা হয়। এখন হয়তো দিল্লিতে পড়ছি, নানা ধরনের কাজে যুক্ত হচ্ছি। কিন্তু শেষমেশ দেশের মাটির গল্পটাই বলে যেতে চাই।
(অনুলিখিত)