দেশ থেকে 'সুবিধাবঞ্চিত' শব্দটা মিলিয়ে দেব

>
জায়েদ হাসান
জায়েদ হাসান
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে স্টেজ লাইট মিউজিক কনটেস্ট প্রতিযোগিতায় বিশ্বের কয়েক হাজার তরুণ কম্পোজারকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন ঢাকার এই তরুণ। পেয়েছেন বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড লিনকিন পার্কের সঙ্গে কাজের সুযোগ।

আমি স্বপ্ন দেখি না। ইচ্ছা ছিল এমন কিছু করব, যাতে অন্তত আম্মু–আব্বু গর্ব করতে পারেন। আমার পরিবারই আমার কাছে সব সময় মুখ্য। সত্যি বলতে, আমি আংশিক বাস্তববাদী, পুরোপুরি বর্তমানবাদী। আমি কাজপাগল। ফলাফলের অপেক্ষা না করে কাজ করে গেছি সারাক্ষণ। কাজ করার যে আনন্দ তাঁর কাছে আসলে সাফল্য-ব্যর্থতা খুবই ক্ষুদ্র ব্যাপার। তারপরও সাফল্য বলে কী যেন একটা ব্যাপার আছে। আমার যে কাজ, শুধু আমাকেই আনন্দ দেয় না; বরং আমার কাজের আনন্দ অন্যদের ভেতরেও ছড়িয়ে যায়—সেটাই বোধ হয় সাফল্য।
এখন পর্যন্ত সেই অর্থে কোনো সাফল্য আমি পাইনি। আমি মনে করি, সফল হতে হলে আমাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে, অনেকটা পথ চলতে হবে। কখনো মনে হয়েছে, সাফল্য মানে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছানো, যেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে এতটুকুও অহংকারী মনে হবে না। সাফল্য না থাকলেও কিছু অর্জন আমার জীবনে যোগ হয়েছে। আর সেসব সম্ভব হয়েছে ‘একাগ্রতা’, কাজের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা, আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের অনুপ্রেরণা আর সবার নিরন্তর ভালোবাসার জন্য। আমি বিশ্বাস করি, সামান্য উৎসাহ একটা জীবনকে গড়ে দিতে পারে। আর আমি শুধু উৎসাহ নয়, সবকিছু পাচ্ছি। আমি এ জন্য সত্যি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে বাধ্য হই।
আমার পথটা খুব সহজ ছিল না। বাধা এসেছে সব সময়। সেগুলো পেরোতে পারা একধরনের অভিজ্ঞতা। আমার বাবা সব সময়ই বলতেন, শর্টকাট খুঁজো না; পথ হারিয়ে যাবে; বরং শিক্ষা অর্জন করো সব সময়। আমি তাই শুরু থেকেই প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে ভাবতাম না। ভাবতাম, প্রতিবন্ধকতাগুলো উত্তরণের উপায় নিয়ে। যেমন শুরুতে সবার মতো আমিও চাইতাম একটা বিশ্বমানের কোনো প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে। তাতে নিশ্চিত নাম-ডাক হবে। কিন্তু বাস্তবতা আমাকে শেখাল, চাইলেই সব পাওয়া যায় না। এরপর থেকে বিকল্প রাস্তা, বিস্তর পড়াশোনা, সামাজিকতা আর শেখার মনোভাব নিয়ে কাজে মন দিই। একা একাই রাস্তাগুলো আমার সামনে খুলে যেতে শুরু করে।
আমার মনে হয়েছে, আমার জীবনে কতগুলো টার্নিং পয়েন্ট আছে। কিছুদিন পরপর জীবন একেকটা দিকে মোড় নিচ্ছে। প্রথম মোড়টা নিল যখন আমি বৃত্তি নিয়ে স্পেনে পড়তে যাই। সে সময় বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় সংগীতব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হই। যেমন ফরাসি শিল্পী মিশেল স্যানসেজ। বিখ্যাত ব্যান্ডদল ডিপ ফরেস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর কাছ থেকেও আমি অনেক প্রেরণা পেয়েছি। এরপর ২০১৩ সালে গ্র্যামি ইউ কমিউনিটিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ আসে আমার। ২০১৫ সালে আসে আমার জীবনের সব থেকে বড় সুযোগ। সেটা হচ্ছে লিনকিন পার্ক ব্যান্ডের সঙ্গে কাজের সুযোগ; সরাসরি তাদের কাছ থেকে গানের স্ট্রাকচার, প্রোগ্রেস, মাস্টারিং ও মোনিটাইজেশন নিয়ে পরামর্শ পাই। তাদের স্টুডিওতে ঢোকার পর থেকে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। কেননা শৈশব থেকে আমি তাদের গান শুনে আসছি। দলটি সারা বিশ্বে ভীষণ জনপ্রিয়। আমিও তাদের পাগল ভক্ত ছিলাম। দমবন্ধ একটা অনুভূতি। একজন বাঙালিকে তারা সাদরে অভিবাদন জানাচ্ছে দেখে আমি ভীষণ গর্বিত হয়েছি। তাদের স্টুডিওতে ঢুকে প্রথম মনে পড়ল আমার বাবার কথা। গানবাজনা তিনি খুব একটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু বিবিসি থেকে একবার আমার নামে একটা চেক আসে। সেটা দেখার পর থেকে আমার গানবাজনার ব্যাপারে বাবার মনটা বদলে যায়। বিবিসি একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে আমার করা একটা মিউজিক ট্র্যাক ব্যবহার করেছিল। সেটারই সম্মানীর চেক ছিল ওটা।

বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড লিনকিন পার্কের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে জায়েদ হাসানের। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড লিনকিন পার্কের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে জায়েদ হাসানের। ছবি: সংগৃহীত

এই প্রাপ্তিগুলো জীবনের একটি চলমান প্রক্রিয়া। ২০১৬ সালে এসে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম টাইডাল থেকে নানা ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। এ ছাড়া ডগস ডে অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সির সঙ্গে জিপি-মিউজিকের জন্য স্কোরিং করি। এটাই বাংলাদেশে আমার প্রথম কোনো কাজ। আগে আমি দেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করিনি। বলা যায়, এভাবে প্রতিটি দিনই যেন নতুন করে টার্ন নিচ্ছে আমার ক্যারিয়ার।
আমার জীবনে কিছু লক্ষ্য আছে। সেগুলো বাস্তবায়নেই আমি বেশি মনোযোগী। ইচ্ছে আছে, বাংলার বাউলদের জন্য কিছু একটা করা। একেবারেই অন্য রকম কিছু। কাজটি এমন হবে যে, এই জাদুকরি সুরের মানুষগুলোর জীবন যাতে আরও একটু সচ্ছল হয়, প্রজ্বলিত থাকে তাঁদের সুর আর কথাগুলোর মতো। একই সঙ্গে শ্রোতারাও পান শেকড়ের ছোঁয়া। ব্যাপারটা বেশ কঠিন হবে আমার জন্য। এ কাজটি করার জন্য পাশে আমি বন্ধুদের চাই। আমি বিশ্বাস করি, সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারলে সেটা সম্ভব হবে। শেষ বয়সে গিয়ে বাউলদের যে মানবেতর জীবন, সেটা কোনো সংগীতপ্রেমী মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। যাঁদের গান সারা জীবন আমাদের ভাবায়, আনন্দ দেয়, তাঁদের জন্য কিছু করতে না পারলে সারা জীবন নিজেকে অপরাধী মনে হবে।
প্রত্যেক মানুষের দেশকে নিয়ে কিছু স্বপ্ন থাকে। আমরা জাতিগতভাবে কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো শক্তিশালী হয়ে বিকশিত হয়। আমি বিশ্বাস করি, যখন আমরা নিজেকে নিজে চেনার চেষ্টা করি, সম্মান ও বিশ্বাস করি, তখন আমাদের সেই প্রতিভার আসল ক্ষমতা জেগে ওঠে। এই বিশ্বায়নের যুগে প্রতিভায় বৈচিত্র্য আনা আরও সহজ। চারপাশে সাহায্য করার অনেক মানুষ ছড়িয়ে আছে। সঠিক শিক্ষক খুঁজে নিতে না পারলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পড়াশোনার ও চর্চার জিনিসপত্র। নিজেকে এগিয়ে নিতে সেগুলো খুবই কার্যকর।
আমার আর একটি স্বপ্ন আছে। সেটি হচ্ছে, এই দেশে ‘সুবিধাবঞ্চিত’ শব্দটি আর থাকবে না। একদিকে মানুষের হাতে কোটি কোটি টাকা, মানুষ প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে অদ্ভুত সব খাতে। আমরা যারা সুবিধাপ্রাপ্ত, তারা যদি সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াই তাহলে কিন্তু তারা আর সুবিধাবঞ্চিত থাকবে না। এটা আমাদের দেশের জন্য সহজ। আমি অভিভূত হয়েছি, বন্যা ও নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য মানুষ ত্রাণ পাঠাচ্ছেন, যাঁরা পারছেন ছুটে যাচ্ছেন। ফেসবুকের কল্যাণে সেটা আরও সম্ভবপর ও সহজ হয়ে উঠেছে। শুধু মানুষের জানার অপেক্ষায়, কোথায় মানুষ কষ্টে আছে, সেখানেই পৌঁছে যাচ্ছে মানুষ। এটা তরুণ উদ্যোক্তা জাকারবার্গের কারণে সম্ভব হয়েছে। তিনি যে শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট বানিয়েছেন তা–ই নয়, মানুষের কল্যাণে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চমৎকার একটা সুযোগও করে দিয়েছেন। আমি অপেক্ষায় আছি সেই দিনের, যেদিন আমরা সবাই মিলে একত্রে এ দেশ থেকে ‘সুবিধাবঞ্চিত’ শব্দটাকে মিলিয়ে দেব।