একদিন সত্যি সত্যি অলিম্পিকে পদক জিতবে বাংলাদেশ

>
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত
গত বছর কমনওয়েলথ জুনিয়র ও যুব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতেছেন। সেরা হয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ান গেমসেও। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে তাঁর কান্নার দৃশ্যটি সবার হৃদয় ছুঁয়েছে।

মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়। ভাগ্যবতী মনে হয় এ জন্য যে আমি বাংলাদেশে জন্মেছি। আগে যতবার বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে বিদেশে গেছি, চেয়ে চেয়ে দেখতাম, বাংলাদেশের পতাকা দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারিতে থাকলেও আমাদের অনেকে এতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দিত। বয়সে সবার ছোট হওয়ায় মনের মধ্যে পুষে রাখা যন্ত্রণার কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারতাম না। শুধু মনে হতো, কবে এই লাল-সবুজের পতাকাটা সবার ওপরে তুলে ধরতে পারব। মনে হতো, কবে আমার জন্য বাজবে জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...। ’
আমার খেলাধুলার ক্যারিয়ার খুব বেশি দিনের নয়। কিন্তু এই ছোট্ট ক্যারিয়ারে বাংলাদেশকে গর্বে ভরিয়ে দেওয়ার প্রথম সুযোগ এল গত বছর। সুযোগ এল বাংলাদেশের পতাকাটাকে সবার ওপরে তুলে ধরার। সেটা গত ডিসেম্বরের ঘটনা। ভারতের পুনেতে কমনওয়েলথ জুনিয়র ও যুব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে গেছি। ওই প্রতিযোগিতায় ভারতের ভারোত্তোলকদের হারিয়ে সোনা জিতলাম। অমনি বেজে উঠল সেই সুমধুর সুর, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...। ’
যদি বলি আমার ক্যারিয়ার, আমার জীবনের বাঁকবদলের শুরুটা হলো সেখান থেকে, এতে নিশ্চয় কেউ আপত্তি করবেন না। কে জানত আমার জন্য আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল দুই মাস পর! ভারতের গুয়াহাটিতে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে খেলতে গেলাম।
গেমসের তিন দিন পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সোনার পদকের দেখা মিলছিল না। আমার আগে সিনিয়র আপুরা খেলেও ভারোত্তোলন থেকে সোনার পদক আনতে পারলেন না। আমার ইভেন্ট ছিল বিকেলে। কিন্তু ভার তোলার মঞ্চে উঠতে পারব কি না তা নিয়েই ছিলাম সংশয়ে। আগের দিন অনুশীলনে ব্যথা পেয়েছিলাম। দলের ডাক্তার বলেছিলেন, এই ব্যথা নিয়ে খেলা ঠিক হবে না। রাতে হাতের ব্যথাটা অনেক ছিল। হাত ভাঁজ করতে পারছিলাম না। কনুইয়েও ব্যথা ছিল। গরম সেঁক দিয়ে ঘুমাতে যাই; হতাশ হয়ে পড়ি। মনে হচ্ছিল, হয়তো সত্যি সত্যি খেলতে পারব না। এত কষ্ট করে এলাম, কিন্তু না খেলে ফিরে যেতে হবে ভেবে খুব খারাপ লাগছিল। পরদিন সকালে উঠে মুখ ধুতে গিয়ে দেখি আমার হাতের ব্যথা অনেক কম। এরপরই খেলার সিদ্ধান্ত নিই। বাকিটুকু তো ইতিহাস।

কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ ও দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সফল হয়েছেন মাবিয়া, স্বপ্ন দেখেন এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিকে পদক জয়ের। ছবি: ​িদলীপ ব্যানার্জি
কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ ও দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সফল হয়েছেন মাবিয়া, স্বপ্ন দেখেন এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিকে পদক জয়ের। ছবি: ​িদলীপ ব্যানার্জি

বাংলাদেশকে এনে দিলাম গেমসের প্রথম সোনা। সোনা জয়ের পরও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। ভারতের রিনা প্রথম লিফট মিস করতেই ড্রেসিংরুমে গুঞ্জন, আজ তোর একটা কিছু হয়েও যেতে পারে। এরপর ও যখন টানা তিন লিফট ওঠাতে পারেনি, তখন কোচ স্যার এসে বললেন, তুই সোনা জিতেছিস। আনন্দে চোখে পানি চলে এল। আমার তখন খুব গর্ব হচ্ছিল। আমার জন্য গেমসে প্রথম জাতীয় সংগীত বেজেছে, ভাবতেই কান্না আসছিল। যখন জাতীয় পতাকার দিকে চাইলাম, তখন নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারছিলাম না। ওই কান্নার ভিডিওটা কে যেন ইউটিউবে আর ফেসবুকে আপলোড করেছিল। পরে শুনেছি, সারা বিশ্বে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল ওই ভিডিওটা। এখনো ইউটিউবে ওই কান্নার ভিডিওটা দেখলে মনের অজান্তে চোখের কোণে পানি চলে আসে। আমার বাবা হারুনুর রশীদ। খিলগাঁওয়ে বাবার একটা মুদির দোকান আছে। আমরা দুই বোন, এক ভাই। আমি সবার ছোট। ছোটবেলায় আমি পড়তে চাইতাম না। এ জন্য একদিন বাবা আমাকে খুব মেরেছিলেন। মামা বক্সার কাজী শাহাদৎ হোসেন ওই দিন আমাদের বাড়িতে এসে দেখেন, বাবা আমাকে মেরেছেন। মামা এরপর আমাকে নিয়ে গেলেন ভারোত্তোলন ফেডারেশনে। সেখানে মামার হাতে ভারোত্তোলনের হাতেখড়ি হয়ে গেল। যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন টাকার অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তবে ভার তুলেই বাংলাদেশ আনসারে চাকরি হয়েছে। পড়াশোনাটাও নতুন করে শুরু করি। এখন তো বলব আমার জীবনটাই বদলে গেছে। আমি কৃতজ্ঞ ফেডারেশনের যাঁরা আমাকে এ পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছেন, তাঁদের প্রতি। আমাদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন স্যার, কোচ শহীদ স্যার, শাহরিয়া সুলতানা, বিদ্যুৎ ভাই তাঁরা যদি কঠোর অনুশীলন না করাতেন, তাহলে হয়তো এতদূর আসতেই পারতাম না।
এলাকার বখাটেরা শুরুর দিকে আমাকে অনুশীলনে আসতে দেখলে ভীষণ উত্ত্যক্ত করত। নানা বাজে মন্তব্য করত। এখন দিন বদলে গেছে। বরং আমাকে দেখলে এখন ওরা এগিয়ে আসে। আমাকে সাহায্য করতে পারলে যেন ধন্য হয়ে যায়। কখনো অনুশীলন সেরে রাত হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। প্রায় সময়ই দেখি গলির মোড়ে আমার জন্য টর্চ হাতে অনেকে অপেক্ষা করছে। এসব দেখি আর ভাবি, আমি সত্যিই ভাগ্যবতী।
বাবার একার উপার্জনে সংসার চলত না। চেষ্টা করতাম বাবাকে সাহায্য করতে। ফেডারেশন থেকে নিয়মিত আমাদের বৃত্তি দিত। শর্ত ছিল। নির্দিষ্ট একটা ওজনে ভার তুলতে পারলে তবেই ওই বৃত্তির টাকা পাওয়া যেত। আমি প্রতি ট্রায়ালে চেষ্টা করতাম নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে বেশি ওজন তুলতে। আমাকে দেখে এখন অনেকে ভারোত্তোলনে আসতে চায়। অনেকে জানতে চায়, এই খেলার ভবিষ্যৎ কী। আমি ক্রিকেটের মতো ভারোত্তোলনকেও দেশের জনপ্রিয় খেলা হিসেবে দেখতে চাই। কিন্তু যে অল্প সুযোগ-সুবিধা ফেডারেশন থেকে পাই তা দিয়ে আন্তর্জাতিক আসরে লড়াই করা সম্ভব না। আমাদের অনুশীলনের জায়গাটা একেবারে ছোট। পল্টনের আইভি রহমান সুইমিংপুলের পাশের ছোট পরিসরের ওই জিমে নেই কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। নেই আধুনিক সরঞ্জাম। এত প্রতিকূলতা পেরিয়েও চেষ্টা করে চলেছি। আমি জানি পরিশ্রমের বিকল্প নেই। যে ব্যক্তি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে একদিন না একদিন সফল হবেই। আমি যে আজ এখানে এসেছি, সেটাও পরিশ্রমের সুফল।
এবার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারোত্তোলনে আমার ক্যাটাগরিতে—মানে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে সেরা হয়েছি। এরপর এশিয়ান গেমসেও পদক জয়ের স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি অলিম্পিকে খেলার। গত রিও অলিম্পিকে যেতে পারিনি বলে খুব কষ্ট পেয়েছি। তবে স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমার নামের পাশেও ‘অলিম্পিয়ান’ শব্দটা যোগ হবে। অন্যদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন সত্যি সত্যি অলিম্পিকে পদক জিতবে বাংলাদেশ। সেই পদকটা না হয় আমিই জিতলাম!
(অনুলিখিত)