পৃথিবীর প্রতিটি সমস্যাই একেকটি পর্বতশৃঙ্গ

>
নিশাত মজুমদার
নিশাত মজুমদার
প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালে পা রাখেন এভারেস্টের চূড়ায়।

শুরু করা যাক ছোট একটা গল্প দিয়ে। এটা ঠিক গল্প নয়, সত্যিকারের ঘটনা। বিখ্যাত পর্বতারোহী এড ভিসচার্স, যিনি পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের ১৪টিই আরোহণ করেছেন বোতলজাত অক্সিজেন ছাড়া। পর্বতারোহণে এই অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের জন্য পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন। ভিসচার্স ১৯৯২ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কে–টু অভিযানে যান। সাত হাজার মিটার উঁচু তিন নম্বর ক্যাম্পে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন পরের দিন চার নম্বর ক্যাম্পে যাবেন এবং তারপরই কাঙ্ক্ষিত সামিট পুশ। কিন্তু রাতেই ওয়াকিটকির রেডিও কলের মাধ্যমে খবর পেলেন, অ্যালেক্স ও শঁতাল মাদুই নামের দুজন পর্বতারোহী সামিট করে নেমে আসছিলেন; তবে নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও তাঁরা ফিরে আসেননি। তাঁদের খুঁজে বের করা আর নিরাপদে নিচে নেমে আসার জন্য সাহায্য প্রয়োজন। তখন স্কট ফিশার নামের আরেকজন বিখ্যাত পর্বতারোহীকে সঙ্গে নিয়ে ভিসচার্স কে-টু সামিটের পরিকল্পনা স্থগিত করে তাঁদের নিচে নেমে আসতে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু সিদ্ধান্ত নয়, এর জন্য তাঁদের বহু কাঙ্ক্ষিত গৌরবজনক পর্বতচূড়া স্পর্শ না করেই সে মুহূর্তে ফিরে আসতে হয়। এই ত্যাগ স্বীকারের জন্য পরবর্তী সময়ে আমেরিকান অ্যালপাইন ক্লাব ভিসচার্সকে সম্মানজনক ‘ডেভিড এ সোলেস মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে ভূষিত করে। পদকটি পেয়ে তিনি খুশি হলেও কিছুটা বিব্রত হয়েছিলেন। কারণ, তিনি মনে করেন এই সম্মান তাঁর একার প্রাপ্য নয়। বিশেষ করে উদ্ধারকাজের সময় আরও যাঁরা সঙ্গে ছিলেন, যেমন স্কট ফিশার, রব হল, থর কিজার আর চার্লি ম্যাক নামের অন্য পর্বতারোহীরাও এর অংশীদার।

২০১২ সালের ১৯ মে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন নিশাত মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত
২০১২ সালের ১৯ মে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন নিশাত মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

নিজের কাঙ্ক্ষিত অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য এগিয়ে যাওয়া আর সহযাত্রীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার এমন গুণ তারুণ্যেরই সহজাত প্রবৃত্তি। পৃথিবীর বড় বড় যত বিপ্লব, পরিবর্তন, উন্নয়ন—তার মূলেও তারুণ্যের এই বিশেষ গুণটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের সেরা যে অর্জন ভাষা আন্দোলন, মুক্তির সংগ্রাম—তার পেছনেও এই অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল সহজ স্বতঃস্ফূর্ততায়।
যার ফলে আমরা এখন বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি; বাংলাদেশ নামের অসম্ভব সুন্দর, সবুজ, অমিত সম্ভাবনার স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছি। পেয়েছি প্রাণপ্রিয় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা আর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র মতো উদ্দীপনা জাগানিয়া জাতীয় সংগীতের উপহার। কিন্তু এই ভাষা-স্বাধীনতা-জাতীয় সংগীত আর পতাকার সম্মান বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের জীবনকে আলোকিত করার দায়িত্বও আমাদের এই প্রজন্মের তরুণদের। জানি, আমরা সফল হবই। কারণ, আমাদের আছে সেই সব সহজাত গুণ, যা সফল মানুষের চরম আকাঙ্ক্ষিত।
এই গুণগুলো যেমন তারুণ্যের সহজাত; আবার এর চর্চা করারও প্রয়োজন হয় নিবিড় মগ্নতায়। পর্বতারোহণেও এই ধরনের চর্চা করা হয়। তাই আমার কাছে এটি কেবল একটি ‘এক্সট্রিম স্পোর্টস’ বা নেশা অথবা পেশাই নয়, তার চেয়েও একটু বেশি কিছু। যখন একটি দল অভিযানে বেরোয়, তখন সেখানে অনেক নির্দেশনার মধ্যে একটি হলো, দলের যেকোনো প্রয়োজনে, যে কারও প্রয়োজনে অভিযান বাতিল হতে পারে বা দলের একজনের জন্য হয়তো একজনকে এমনকি পুরো দলকেই অভিযান বাতিল করে ফিরে আসতে হতে পারে। এর জন্য সবাইকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। ঠিক একই কথা আমাদের প্রজন্মের জন্য প্রযোজ্য। দেশের যেকোনো প্রয়োজনে, যেকোনো সংকটময় সময়ে স্বার্থের চিন্তা ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। যার মাধ্যমে আমরা পেতে পারি এমন একটি দেশ, যেখানে প্রতিটি শিশু মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে অধিকারগুলো তার প্রাপ্য, তা পাবে। মানুষে মানুষে থাকবে না দ্বন্দ্ব-বিবাদ-যুদ্ধ-হতাশা। আমরা এমন একটা পৃথিবী পাব, যে পৃথিবীই ভালোবেসে আমাদের আগলে রাখবে।
পর্বত আমার কাছে তাই একটি চ্যালেঞ্জের নাম; একটি প্রতীক মাত্র। পৃথিবীর প্রতিটি সমস্যাই একেকটি পর্বতশৃঙ্গ। মেধা, শ্রম, সততা আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলা করার মানসিকতা থাকলে সেই শৃঙ্গে আরোহণ কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। তরুণদের আছে অসম্ভব স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা আর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার দুর্দমনীয় প্রচেষ্টা। যার ফলে কোনো পর্বতপ্রমাণ বাধাই আর বাধা থাকে না। আমাদের আছে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। দৃঢ় বিশ্বাস, সেই স্বপ্ন আমাদের পূরণ হবেই। একটু একটু করে আমরা সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই পথ হেঁটে চলেছি।
এড ভিসচার্সের আর একটা কথা দিয়ে দিয়েই শেষ করছি, ‘জীবনভর অভিযান করে শিখেছি যে পর্বতকে কখনো জয় করা যায় না। তাকে শ্রদ্ধা করতে হয়। পর্বত থেকে শেখা ধৈর্য কাজে লাগাতে পারলে সে তাকে আরোহণের অনুমতি দেয়। জীবনের অনেক আরাধ্য ব্যাপারই আসলে এ রকম।’