জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ

আনিকা বুশরা
আনিকা বুশরা

পৃথিবীতে প্রায় সাত শ কোটি মানুষের বাস। তাদের ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি সবকিছু আলাদা। শুধু একটা জায়গায় এসে সবাই এক হয়ে যায়। আর তা হলো সংগীত। ভিনদেশি মানুষটার ভাষা না বুঝলেও সে যে ধনে-মনের আনন্দে মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝে তার সঙ্গে আনন্দে শামিল হতে কোনো সমস্যা হয় না। আমার কাছে সংগীত মানেই ওই একটা অনুভূতি, এর মাধ্যমে সবার রঙে রং মেশানো যায়, নিজের যা কিছু অন্তরতম, তা অন্ধকার ঘরে বা প্রখর খরাতে রিকশায় যেতে যেতে টের পাওয়া যায়। আসলে আর কিছু দিয়ে কি সুখ-দুঃখ যুগপৎভাবে টের পাওয়া যায়, যেটা সংগীত দ্বারা সম্ভব? আমার তো মনে হয় না।

আমার সংগীতের প্রতি টান খুব সম্ভবত বংশপরম্পরায়। নানি খুব ভালো গান গাইতেন, জমিদারবাড়ির এই মেয়ের কণ্ঠে গজল, রবীন্দ্রসংগীত শুনে আমার ছেলেবেলা কেটেছে। নানার সংগ্রহে ছিল গ্রামোফোনের বিশাল রেকর্ড। গ্রামোফোনের চল যখন বিলুপ্ত হলো, নানির তো ভারী অসুবিধা, বিদেশ থেকে আনা হলো ক্যাসিও ক্যাসেট। ওনার ওষুধের বাক্স সারি সারি করে রাখা, সবাই ভাববে ‘এত ওষুধ কেন?’ আমি জানতাম ভেতরে কী আছে। ভেতরে হলো হেমন্ত, সাগর সেন, দেবব্রত, শ্রীকান্ত, কলিম শরাফী, মোহাম্মদ রফি, শামসাদ বেগম, আশা ভোসলে, লতা মঙ্গেশকর। একবার বিটলসের ক্যাসেট দেখে তো আমি হতভম্ব। নানার লাজুক উক্তি, ‘শুনে দেখলাম বুবু, ভালোই আছে। শুধু ইংরেজি উচ্চারণ একটু শুদ্ধ করতে হবে ওদের।’ এ কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায় আর তাঁর ক্যাসেট নিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করে, উচ্চারণ শুদ্ধ করে দেওয়ার মানুষ এখন অন্য কোনো স্থানের গান নিয়ে মেতে আছেন হয়তো।

বাবা ছিলেন আমার নিত্যদিনের সঙ্গী, আমি হলফ করে বলতে পারি, কোনো মেয়ে তার বাবার এতটা কাছের ছিল না যতটা ছিলাম আমি। বাবা আমাকে শোনাতেন ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, লোকগান আর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের গান। কী যে সুন্দর ছিল দিনগুলো! আধো আধো বোলে ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে’ গেয়ে ঘরময় পায়চারি করার মতো সুখ আমাকে এই মিউজিকই দিয়েছে। বড় খালাম্মা, ছোট খালাম্মা দুজনেই অসম্ভব সুন্দর গাইতেন। বড় খালু গাইতে পারতেন না, কিন্তু এসে বাহবা দিতে তাঁর জুড়ি ছিল না, ‘বুশরা, গাও তো মা’, এটা বললেই গান শুরু করতাম। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা বোনেরা ছিলাম আমরা। বোনেরা ছিল বিদেশি গানের ভক্ত। তখন নতুন নতুন হানা মন্টানা, টেইলর সুইফট, জোনাস ব্রাদার্স এসেছে। সেগুলোও ভালো লাগত, কথা বুঝতে না পেরে ইংলিশ শেখার চেষ্টা সেই সেদিন থেকেই।

কিন্তু আমার গান গাওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। আমার মা একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। মা নিজের প্রথম বেতনের টাকায় হারমোনিয়াম কিনেছিলেন। এই হারমোনিয়াম আমার বড় বোনের মতো, আমার চেয়ে ওর যত্ন বেশি করা হয়! বয়স হয়েছে ২১ বছর। এই হারমোনিয়ামের রিড ছুঁয়ে যখন উনি ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’ গাইতেন, আমার যে কী ভালো লাগত! ভাবতাম, আহা রে, না জানি কোন বাবাকে আমার মা বকা দিচ্ছেন, তাঁর শিশুরা সকাতরে কাঁদছে তাই। ওই হারমোনিয়াম ছোঁয়ার ইচ্ছাতেই গান শুরু করি। বাসায় গান শেখাতে আসতেন পাপ্পানা নামে এক তরুণী। তাঁর সঙ্গে আর দেখা নেই আমার। কোনো দিন যদি দেখা হয়, তাহলে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলব। কারণ উনিই প্রথম আমাকে মিউজিকের এই রহস্যময়, ভালোবাসাময় জগতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কী মিষ্টি কণ্ঠ তাঁর! হাতে-পায়ে টেবিলে তাল দিয়ে দিয়ে আমার তালজ্ঞান পাকা করেছিলেন। জীবিকার তাগিদে তাঁকে এই পেশা ছেড়ে চলে যেতে হয় ঢাকায়। ভর্তি হই হিন্দোল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে। ওস্তাদ রবিউল হোসেন, উনিও আজ ভিনদেশি তারকা। খুব ভয় পেতাম ওনার রাশভারী চেহারা দেখে। আর আমার গানের গলাও ওপরে উঠত না। ভয়ে ভয়ে থাকতাম। উনি নিজে ডেকে ডেকে বলতেন, ‘বুশরা, গান কর। গান শেষ হলে বলবি, “হয়েছে ওস্তাদজি।’” সেই থেকে আমি এখনো কাউকে গান শোনাতে গেলে ‘হয়েছে’ না বলে গান শেষ করতে পারি না। রাগ আর শাস্ত্রীয় সংগীত ওনার কাছ থেকেই ভালোবাসতে শেখা। এর পরে ওস্তাদ সানোয়ার হোসেনের কাছে শেখা। উনি আমাকে আমার এই ভালোবাসাকে জনসমক্ষে আনতে সাহায্য করেন।

স্কুল-কলেজ পার করেছি রবীন্দ্রসংগীত নিয়েই। আসলে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি টানটা এত বেশি ছিল যে ঠিক করে ফেলি, গাইবার ক্ষেত্রে এই জেনারকেই প্রাধান্য দেব। আমি আমার দেখা এমন অনেক সময় পার করেছি, এখনো করি, যেখানে শাস্ত্রীয় সংগীত বা পুরোনো দিনের গানকে অবজ্ঞা করা হয়। ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর জাতীয় সংস্কৃতি উৎসবে গান গাইতে উঠেছি মঞ্চে। সব দর্শক নতুন প্রজন্মের। তারা রবীন্দ্রসংগীত শুনতে রাজি না, তারা হাল আমলের ‘হিট’ গান শুনতে চায়। রাগে টগবগ করতে করতে আমি পুরো গান শেষ করে নেমেছিলাম। সেদিন থেকে আমার ব্রত হয়ে গিয়েছিল, আমার প্রজন্মকে এভাবে নিম্ন মানে নামতে দেব না। তখন স্কুল-কলেজেও রবীন্দ্র, নজরুল বা পঞ্চকবির গান গাওয়া খুব একটা হতো না। আসলে স্কুলেরও দোষ দেওয়ার কিছু নেই। তখন যে গানের হাওয়া, সেই গান গাইতে না দিলে তো অনুষ্ঠান ‘হিট’ হবে না। আমিও কাঁঠালগাছের আঠা। লেগে থাকতাম অহর্নিশ, প্রতিবাদ করতাম। এরপর থেকে স্কুলে এখন পর্যন্ত ক্ল্যাসিক্যাল গান ছাড়া অনুষ্ঠান হয় না।

ধীরে ধীরে পরিধি বিস্তৃত হতে শুরু করল। কিন্তু যন্ত্রণার মাত্রাও বাড়তে থাকে। কেউ রবীন্দ্রসংগীত শুনতে রাজি না, আয়োজকেরাও তাই বাধ্য অন্য গান শোনাতে। আমাকে তো একদিন একজন বলেই ফেলল, ‘শোনেন, এটা শান্তিনিকেতন না যে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মাতামাতি করবেন।’ আমি বাসায় ফিরি, চেঁচামেচি করি। মা আর ছোট মামা শান্ত করেন, কবিগুরুরই বাণী শুনিয়ে শান্ত করেন। এর মধ্যে জীবনে খুব বড় একটা প্রাপ্তি এল ‘মেধা অন্বেষণ ২০১৩’তে ভাষা ও সাহিত্যে ‘দেশসেরা মেধাবী’ হওয়ার সুযোগ। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ হলো শিক্ষাদূত হয়ে। দেখলাম, ওদের সংস্কৃতি ওদের কতটা আপন। দেশে ফিরে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনে গাইবার সুযোগ হলো। তার আগে ছিল জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা। সবগুলোতেই যে প্রথম, দ্বিতীয় হয়েছি এমন না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হয়েছে, আমার জীবনপাত্র পূর্ণ করে মাধুরী দান করেছে এই মুহূর্তগুলো।

আমাদের দেশের সংগীতচর্চায় সবচেয়ে বড় যে বাধা তা হলো গতানুগতিক শিক্ষা। আমাদের শৈশব থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয় ‘Keep your chin down and nose in the books.’ একটা বাচ্চা তার সংগীতের প্রতি ভালোবাসা জাহির করার সুযোগই পায় না, রুচিসম্পন্ন সংগীত শোনা তো দূরের কথা। তাদের জীবন সংকীর্ণ হয়ে যায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যাংকারের মধ্যে। আমার দেখা কত ছেলেমেয়েকে গান করা, ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো, অভিনয়, আবৃত্তি ছেড়ে দিতে হয়েছে এই জিপিএ-৫ পাওয়ার আশায়। পরিবার বাধ্য করে, সমাজ বাধ্য করে। যে ছেলে ঘাড়ে গিটার নিয়ে ঘোরে সে বখাটে, আর যে ছেলে সারা দিন ডাক্তারি বইয়ের মধ্যে থাকে, সে আদর্শ ছেলে। যে মেয়ে নাচের তালে তালে জীবনের ভাষা খুঁজে পায়, সে ঠিক পরিবারের নয়, অথচ যে মেয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে ইভ টিজিংয়ের সম্মুখীন হয়, পরিবারের চাপে নিজের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বলি দেয়, সেই-ই হলো যোগ্য মেয়ে! কখনো এসব কন্ট্রাডিকশন, হিপোক্রেসি মানতে পারিনি। আসলে আমার সংগীত আমাকে শিক্ষা দিয়েছে মাথা উঁচু করে চলতে, বিশ্বের শতকরা ৭৫ ভাগ তরুণীর মতো বিষণ্ন না হয়ে তালে তালে জীবনকে জয় করতে, রাস্তায় কোনো ছেলেকে উত্ত্যক্ত করতে দেখলে টেনে চড় কষাতে। সবচেয়ে বড় পাওয়া, আমি বাঙালি, আমি রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলার শাশ্বত মেয়ে, আমি নজরুলের বিদ্রোহী কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে দেওয়া মেয়ে, হ‌ুমায়ূন আহমেদের মায়াবতী মেঘ আমি। এই পরিচয় আমাকে কি আর জিপিএ-৫ দিতে পারে?

সংগীত শিক্ষা যদি কেউ প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সমাপ্ত করে, তাদের সবচেয়ে বড় ঝামেলা হয় চাকরিজীবনে। আমার এক দিদি, শান্তিনিকেতনের মেধাবী ছাত্রীদের একজন। শিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এসে এখন সে বেকার। একদিন জিজ্ঞাসা করি ‘কেন?’ সে বলে, ‘মণি, গায়িকারা কখনো দেশের চালিকা হয় না।’

আমি চাই না আর কেউ আমাকে এটা বলুক। আমি চাই না। আমি চাই আরও রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা আসুক, এসে আমাদের জীর্ণতাকে পূর্ণতায় রূপান্তর করুক। ‘তরুণ প্রজন্ম একদম রসাতলে গেছে, শিকড়কে ভুলে গেছে’ এ কথার প্রতিবাদ হিসেবে আরও অর্ণব, শাহানা বাজপেয়ি, জলের গান, আর্টসেল আসুক। তার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি আমাদের মধ্যে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই চেতনাটা আসা, যেন সংগীতকে আমরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারি, নতুন সময়ের গান যেমন গাইতে হবে, তেমনই পুরোনো দিনের গান শুনে, গেয়ে, সবাইকে শুনিয়ে নতুন আর পুরোনোকে একই সুতায় গেঁথে রাখতে হবে। গানকে সম্পত্তি না ভেবে ভাবতে হবে সম্পদ। এর বাণিজ্যিকীকরণ করা যাবে না। হাল আমলের অনেক শিল্পীই গানকে বাণিজ্য ভেবে গানের যে অধঃপতন ঘটিয়েছেন, আমার অনুরোধ, আপনারা আর এ কাজগুলো করবেন না। আপনাদেরই তো অনুসরণ করে তরুণেরা। আপনারাই যদি বিপথে যান, আমরা কী করে সুপথে যাই?

অনেকেরই ধারণা, ব্যান্ড গান মানেই অশ্লীল কিছু। অবশ্যই না। আর্টসেল, শিরোনামহীন, চিরকুট, ওয়ারফেজ আমাদের যে অর্জন এনে দিয়েছে তা কখনোই অস্বীকার করা যায় না। কাজেই সুস্থ ধারার সংগীতের আওতায় যে সংগীতই পড়ুক, আমাদের গ্রহণ করতে হবে আশীর্বাদ ভেবে।

আর একটা কথা, সংগীত শিক্ষা শুধু শৌখিনতার বিষয় হলে চলবে না। ঢাকায় অনেক সংগীত শিক্ষালয় আছে। ছায়ানট, সুরের ধারা সব আছে রাজধানীতে। দেশের অন্য জেলায়, বিভাগে খুব কম। বিভাগে থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেই বললেই চলে। অথচ সেখানেই কত প্রতিভা লুকিয়ে আছে, যারা পাপড়ি মেলে ওঠার অপেক্ষায়, তাদের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। না হলে সংগীতের মূল লক্ষ্যই ব্যর্থ হবে, আর তা হলো সবাইকে এক করা।

দেশে দেশে হানাহানি, নৈরাজ্য, সংঘাত চিরতরে চলে যাবে যদি সংগীত আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে প্রোথিত হয়। মনের শান্তি তখনই আসবে। সংগীত নিয়েই আমি বাকি জীবন থাকতে চাই, বাংলার বুকে, বাংলার মেয়ে হয়ে, আর চাই পুরো দেশ ও দশের সহযোগিতা ও ভালোবাসা। কারণ, এই সুরের নাচনই তো ভালো লেগেছিল আমার, প্রকৃতিতে ও জীবনে।

আনিকা বুশরা

তরুণ সংগীতশিল্পী

অ্যাম্বাসেডর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়