সিনেমায় একঝলক বাংলাদেশ

অমিত আশরাফ
অমিত আশরাফ

যদিও আমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে, তবে প্রায় প্রতিটা গ্রীষ্মকাল আমরা বাংলাদেশেই কাটাতাম। দেশে থাকার সময় মানুষের গল্প আর প্রকৃতি আমাকে খুব টানত। এখানকার স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। তাই ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর আমি বাংলাদেশে ফিরে এসে আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উধাও বানানোর সিদ্ধান্ত নিই। এই সিনেমার গল্পটা এমন একজন মানুষের যে কিনা তার পরিবারকে গ্রামে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় আর তাকে ফিরিয়ে আনতে কোনো একজনকে জীবন বাজি রাখতে হয়। সিনেমার গল্পটা একটা সত্যি ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। গল্পটা এমন একজন নারীর গল্প, যে তার স্বামীকে ঠিক একইভাবে হারিয়েছিল।

এই গল্প বানাতে গিয়ে আমি টের পেলাম চলচ্চিত্র বানানোর আসল ক্ষমতা হলো, যাদের কথা শোনা হয় না তাদের কণ্ঠে ভাষা দেওয়া, তাদের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। একজন দর্শককে এমন একজন মানুষের জীবনে প্রবেশ করানো, যে মানুষের জীবন সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। উধাও বাংলাদেশের সিনেমা হলোগুলোসহ বিশ্বের ৩০টি ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছিল। আমি এই সিনেমা দিয়ে বিশ্বকে একঝলক বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছিলাম। তাদের এমন এক দেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলাম, যে দেশ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।

আসলে সিনেমা হলো আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও মানুষের দূতস্বরূপ। কারণ, গল্পই আসলে দেশের সীমানা পার করতে পারে। সময় অথবা ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিতে পারে। তাই এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় অংশ হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে যখনই যথোপযুক্ত প্রক্রিয়ায় ছবিটি মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলাম, অনেক বাধাবিপত্তিতে আমি অনুধাবন করলাম যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সত্যিকার অর্থে পুরোদস্তুর ইন্ডাস্ট্রি এখনো হয়ে উঠতে পারেনি। এমনকি দেশের বেশির ভাগ জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলো পর্যন্ত ব্যাপক হারে প্রচারাভিযানের পরও লগ্নি করা টাকা তুলে আনতে বহু ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছে। তাহলে আমরা টিকে থাকব কী করে? কীভাবে গল্প বলে জীবিকা নির্বাহ করব? যেখানে ভালো সিনেমা হলের সংখ্যা হাতে গোনা যায়, টিকিট বিক্রির অধিকাংশ টাকাই চলে যায় সরকারের ঘরে, টিভি স্বত্বের জন্য প্রদান করছে অতি নগণ্য মূল্য! তাই এত এত ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও এ দেশে একজনের চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন দেখা আমার কাছে নির্ঘাত পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। তবে আমি আশা করি, যথেষ্ট মেধার অধিকারী এসব উঠতি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য আমরা উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারি।

আমরা আমাদের চলচ্চিত্র দেখানোর জন্য নতুন পথ উন্মোচন করতে পারি। আমি সব সময় বড় পর্দায় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে চাই। কিন্তু এটাও চাই চারদিকে অনলাইন ডিস্ট্রিবিউশনের জয়জয়কার হোক। অনলাইনের নেটফ্লিক্স অরিজিনাল থেকে আমি আমার কিছু প্রিয় গল্পের আইডিয়া পেয়েছি। যখন ‘বায়োস্কোপ লাইভ ডট কম’-এর টিম এসে আমাকে বলল তারা নেটফ্লিক্সের মতো একটা প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে তৈরি করতে চায়। তখন আমি তৎক্ষণাৎ আমার আগ্রহ প্রকাশ করি। কারণ, যেভাবে অনলাইনের ইউজার বাড়ছে, আগামী পাঁচ-দশ বছরের অনলাইন ভিউয়ারের সংখ্যা সব ধারার ভিউয়ারকেই ছাড়িয়ে যাবে। এটা শুধু ভবিষ্যৎ ভিউয়ার দিয়ে চিন্তা করলে ভুল হবে, গল্প বলার ধরনও পাল্টে যাবে। যদিও ইতিমধ্যে পুরোনো ধ্যান ধারণা বিকল হয়ে পড়েছে, তাই তরুণ ও নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতারা এর ফলে নতুন গল্প বলারও সুযোগ পাবে, যেমন ধরুন ভৌতিক গল্প, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ইত্যাদি।

আর আমি নিয়ে এসেছি কালি, বাংলাদেশের প্রথম সুপারহিরো সিরিজ, যেখানে অমায়া নামে অ্যাসিডদগ্ধ একটি মেয়ে, সে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এটা এমন একটি গল্প, যা অনেক দিন ধরেই আমার মনের মধ্যে ফুটন্ত পানির মতো টগবগ করছিল। সুপারহিরো এমন একটি রূপক চরিত্র, যে কিনা সমাজের অসামঞ্জস্যের ওপর বিরক্ত হয়ে কোনো উপায় না দেখে নিজের হাতেই সামঞ্জস্য ফিরিয়ে আনতে প্রতিবাদের ভাষায় রূপ নেয় এবং দেশের ও সমাজের মানুষরূপী জানোয়ারগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে একটি রহস্যময় সত্তায় রূপ দিয়ে সবার চোখের আড়াল হয়ে থাকে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্তিম বা সর্বশেষ যোদ্ধা হলো সুপারহিরোরা এবং কালি হলো আমাদের দেশের অবহেলিত নারীদের প্রতিবাদের জোরালো কণ্ঠস্বর। যদিও কালি যখন তৈরি করছিলাম, তখনই সময় ও আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছিল। তবুও আমি অনেক আনন্দ নিয়ে কাজটা করেছি। ওয়েব সিরিজ হলেও একটা ফিল্ম তৈরি করতে যে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়, আমরা ঠিক তাই করেছি এবং চমত্কার ও প্রতিভাবান একটা টিমের সঙ্গে যখন কাজটা করছিলাম আমি উত্তেজনাপূর্ণ একটা সময় পার করেছি। তারপর যখন কালি রিলিজ পেল অনেকেরই প্রশংসা আমাকে মুগ্ধ করেছে, যা কিনা আমি কল্পনাও করিনি। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ওপর আমার আগ্রহটা আবার ফিরে এসেছে।

>শিগগিরই বাংলাদেশ নবযুগের ফিল্মের পথে যাচ্ছে এবং তা হবে নতুন ধারার। নতুন আঙ্গিকের

আমি আশা করি, আমরা আমাদের গল্পগুলো বলার জন্য ‘বায়োস্কোপ লাইভ ডট কম’-কে একটা চমৎকার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তৈরি করতে পারব। বিশ্বাস করুন আর না–ই করুন, এখানে অনেক প্রতিভাবান লেখক ও পরিচালক রয়েছেন, যাঁরা মূল ধারার কাজে সুযোগ পাচ্ছেন না। কারণ চ্যানেল, পরিবেশ​েকরা মনে করে দর্শক এসব দেখতে চায় না। কিন্তু দর্শকদের নিয়ে তাদের এই কথাটা বানোয়াট। তারা নতুন ও তাজা আইডিয়ার গল্প দেখতে চায়। কারণ, বায়োস্কোপ আমাকে আমার গল্পে কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে এবং কালি তৈরি করার পরপরই তারা দর্শকদের জন্য ইন্টারনেটে রিলিজ করে এবং বিশাল পরিমাণ দর্শক এটা দেখেছেও। কিন্তু উধাও বানানোর পর তিন বছর সময় লেগেছে সেটা হলে রিলিজ করতে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। কারণ, আমি মনে করি ছবি দেখতে গেলে, যখন একটার পর একটা ঘটনা এসে ফিল্মের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়, সেই ডুবে যাওয়াটাই হলো চলচ্চিত্রের জাদুকরী অভিজ্ঞতা। আমি ভবিষ্যতে আরও চলচ্চিত্র বানাব এবং আমার পরবর্তী প্রজেক্ট হচ্ছে আরও একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। কিন্তু আমি অনলাইন ডিস্ট্রিবিউশনকেই প্রাধান্য দেব। তবে অবশ্যই দুই মাধ্যমকেই আলিঙ্গন করে নেওয়া উচিত। এখন আপনি অডিয়েন্স হিসেবে ভোট দিতে পারেন। কোনটা আপনি চান? শুধু দেখার জন্যই তো আমরা হলে কিংবা ওয়েবে ঢুকি অথবা বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করব বলে।

 আমি মনে করি, আমাদের চলচ্চিত্র আমদানি করারও কোনো দরকার নেই। আমরা আমাদের বাস্তবধর্মী ও আকর্ষণীয় দেশীয় গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে পারি। কারণ, আমরা চরিত্রে, গল্পে, লোকেশনে কোনো অংশেই কারও চেয়ে কম নই। শিগগিরই বাংলাদেশ নবযুগের ফিল্মের পথে যাচ্ছে এবং তা হবে নতুন ধারার। নতুন আঙ্গিকের। চলুন আমরা আয়নাবাজির মতো ফিল্ম হলে গিয়ে দেখি এবং ওয়েব সিরিজ জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে ‘বায়োস্কোপ লাইভ ডট কম’-এ গিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সুপারহিরো সিরিজ কালি দেখি। আর আমাদের সুযোগ দিন আপনাদের বিনোদিত ও অভিভূত করার। কারণ, আপনারাই বাঁচাতে পারেন আমাদের এই চলচ্চিত্রশিল্প।

অমিত আশরাফ

তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা