মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মুঠোফোন গেম 'হিরোজ অব সেভেনটি ওয়ান'

মাশা মুস্তাকিম
মাশা মুস্তাকিম

চার দেয়ালে ঘেরা শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রায় সব কিশোর-তরুণেরই কম্পিউটার বা মুঠোফোনে গেমস খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। গেম খেলার পাশাপাশি গেম নির্মাণেও আগ্রহ দেখা যায় নতুন প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের। আমাদেরও শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় থেকে দুজন প্রোগ্রামার ও একজন আর্টিস্টের একটি দল নিয়ে শুরু করি ফ্রিল্যান্স গেম নির্মাণ। ২০১৫ সালের শুরুর থেকে দল ভারী হতে শুরু করে, গঠন হয় একটি গেম নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান—পোর্টব্লিস। তারপর ফ্রিল্যান্সের একপর্যায়ে এসে পোর্টব্লিসের একটি নতুন উপলব্ধি হয়। দেশের বাইরে বিভিন্ন গেম নির্মাণে সরাসরি অবদান রেখেও গেমের মালিকানা থেকে যাচ্ছে দেশের বাইরের কোনো নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের। আমাদের মেধা আছে, নির্মাণশৈলী আছে—আমরা কেন নিজেদের গেম বানাব না? এই ভাবাদর্শ থেকেই তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মুঠোফোন গেম ‘হিরোজ অব সেভেনটি ওয়ান’। এখন পর্যন্ত এ গেমটির দুটি পর্ব নির্মাণ করা হয়েছে এবং প্রতিটিই আট-নয় লাখবার করে ইনস্টল করা হয়েছে গুগল প্লে স্টোর থেকে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের তৈরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এটিই প্রথম মুঠোফোন গেম।

কেন মুঠোফোন গেম? অ্যাপস ও গেমসের যে ইকো-সিস্টেম, তার জন্য প্রয়োজন হয় একটি মার্কেটপ্লেস। কম্পিউটারভিত্তিক গেমের বেশির ভাগই পাইরেটেড। কাজেই নির্মাতাদের জন্য মুঠোফোন ও কনসোল উপযোগী গেমই বেশি পছন্দের। ইউজারদের কথা চিন্তা করলেও কম্পিউটার গেমারের সংখ্যা খুবই কম, যার বেশির ভাগই স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রী, যারা পরবর্তী সময়ে ভার্সিটি-কলেজের ব্যস্ত জীবনে কম্পিউটারের টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলার সময় বের করতে পারেন না। দেশের বড় টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলোর মতে, ১৮ থেকে ২৫ বয়সসীমার ইউজাররাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।

বয়সসীমা কেন জরুরি? সব গেমেই একটি নির্দিষ্ট বয়সের রেটিং দেওয়া থাকে। এই রেটিংয়ের নিচের বয়সের হলেও কিন্তু আমাদের দেশের শিশু-কিশোরেরা সেসব গেমস খেলছে। ধরা যাক, গ্র্যান্ড থেফট অটো নামে গেমটির বয়সসীমা গেমের কভার ফটো, এমনকি প্রতিটি সিডি-ডিভিডির মোড়কেও বড় করে লেখা থাকে। গুগল প্লে স্টোর কিংবা অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে থেকে ডাউনলোড করার সময়ও এই রেটিং দেওয়া থাকে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, সব গেম সব বয়সী গেমারদের জন্য নয়।

অভিভাবকদের আমরা অনুরোধ করব—আপনারা সচেতন হোন, বয়সের রেটিং দেখে আপনার সন্তানকে গেম খেলতে দিন এবং আপনার সন্তান কী কী গেম খেলছে, সেটা খেয়াল রাখুন। হিরোজ অব সেভেনটি ওয়ান গেমটি একটি ১৬ ঊর্ধ্ব বয়সীদের গেম। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি যুদ্ধের ময়দানের আবহে তৈরি গেমে কিছুটা সহিংসতা থাকবে। কাজেই ১৬ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরের অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে অনুরোধ করব। কারণ, দিনের শেষে সচেতন ইউজারই এনে দেবে নতুন সব ক্ষেত্র ও সুযোগ; গড়ে তুলবে নতুন বাজার।

আন্তর্জাতিক মানের মুঠোফোন গেম নির্মাণ হলেও বাংলাদেশের মুঠোফোন গেম নির্মাণশিল্প এখনো পুরোপুরি পরিণত হয়নি। এ মুহূর্তে যাঁরা মুঠোফোন গেম নির্মাতা আছেন, তাঁদের জন্য কাজটি অনেক কঠিন। কারণ, তাঁদের এই শিল্পের বাজার নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হচ্ছে। হিরোজ অব সেভেনটি ওয়ান অবমুক্ত হওয়ার আগে কেউ ভাবেইনি যে বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে বানানো কোনো গেমের এত ইউজার হতে পারে।

মুঠোফোনে অ্যাপস ও গেমস কেনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় ক্রেডিট কার্ড। কিন্তু বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড নেই। কাজেই দেশীয় ইউজারদের জন্য দরকার হবে দেশি ক্রয় মাধ্যম ব্যবহার করার সুযোগ। এ ক্ষেত্রে মুঠোফোন ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, বিকাশ, মুঠোফোন ব্যালেন্স—এসবকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিভিন্ন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই বিভিন্ন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস দিয়ে আসছে, কিন্তু তা শুধু নিজস্ব বা বিশেষ কোনো পোর্টালের জন্য। দেশি গেম ক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় মুঠোফোনের ব্যালেন্স। ঠিক এই ক্রয়মাধ্যমটাই মুঠোফোন অ্যাপস ও গেমসে একীভূত করলে খুব সহজেই ইউজাররা অ্যাপস ও গেমসের মাধ্যমে ‘ইন-অ্যাপ-পার্চেজ’ করতে পারবে। এতে করে কোনো বিশেষ পোর্টাল বা টেলিযোগাযোগ কোম্পানির বিশেষ কোনো সার্ভিসে সাবসক্রিপশনের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ এক মধ্যস্বত্বভোগী চেইন বা শ্রেণি। এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিটিকে ছোট করে আনতে প্রয়োজনে বিটিআরসি থেকে শর্ট কোড লাইসেন্স কিনে সরাসরি টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া শেষ করতে ছয়-সাত মাস সময় লেগে যায়। এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

মুঠোফোন অ্যাপস ও গেমসের মতো যেকোনো আন্তর্জাতিক মানের বাজার তৈরি ও প্রসার অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সার্বিক প্রভাব ফেলবে। মূলত যেকোনো নতুন বাজার তৈরির সঙ্গেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি সম্পর্কিত। আর বাজারটা যখন মুঠোফোন ইউজারদের নিয়ে, তখন ব্যাপারটা দেশ থেকে দেশের বাইরেও প্রসারের সুযোগ আছে; যা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে ইনোভেশন ফান্ড ও কানেকটিং স্টার্ট আপের মতো বিভিন্ন স্তরে জাতীয় পর্যায়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। সব ব্যবসায়িক সম্প্রদায় ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তরুণ উদ্যোক্তাদের একীকরণ প্রক্রিয়ায় সরকার যে অবদান রাখছে, তা অব্যাহত থাকলেই কেবল উদ্যোক্তাদের এই প্রসারের সম্ভাবনা হবে অসীম।

মাশা মুস্তাকিম

ডেভেলপার, হিরোজ অব সেভেনটি ওয়ান, সিইও, পোর্টব্লিস