মাতিয়া যখন উঠেছে পরান

পূজা সেনগুপ্ত
পূজা সেনগুপ্ত

স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না, স্বপ্নের পেছনে কখনো ছুটতে নেই—এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করেন। তবে বিজ্ঞান বলে অন্য কথা। স্বপ্ন জন্মায় মস্তিষ্কে আর কল্পনা আমাদের স্মৃতিশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই স্বপ্ন যতই বড় হোক না কেন, যিনি স্বপ্নকে ধারণ করেন সেই মানুষটা সব সময় তাঁর স্বপ্নের চেয়ে বড়। স্বপ্ন সত্যি করতে প্রয়োজন পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস ও নিজেকে জানা। আমাদের সবার ভেতরে অন্য এক আমি বাস করে, যে অনেক বেশি সৎ আর স্বতঃস্ফূর্ত। আমরা ভালো কিছু করলে সে বাহবা দেয়, খারাপ কিছু করলে ধিক্কার জানায়। ভেঙে পড়লে সামলে নেয়, উদ্ধত আচরণ করলে সংযত হওয়ার সংকেত দেয়। আমাদের মতো সবকিছুতে সে লাভ-ক্ষতির হিসাব করে না। বৈষয়িক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, পারিবারিক চাপ ইত্যাদি কারণে আমরা অনেক সময় আমাদের স্বপ্ন থেকে দূরে সরে যাই। ‘আমি’ আর ‘আমার ভেতরের আমি’র মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে তুলি। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি টিকে থাকার লড়াইয়ে। কিন্তু আমার ভেতরের আমি শুধু টিকে থাকতে চায় না, বাঁচতে চায়। টিকে থাকার জন্য নাচ, গান, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি—এর কোনোটারই প্রয়োজন নেই, কিন্তু বাঁচার জন্য আছে। আমার চারপাশে অসংখ্য মানুষকে যখন প্রতিদিন জীবনযুদ্ধের চক্রে কিংবা ভোগবিলাসিতার ফাঁদে পড়ে একটু একটু করে ক্ষয় হতে দেখি, আমার ভেতরের আমি তখন আমাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘পূজা! তুমি বেঁচে আছ!’

সংগীত-রত্নাকর–এ দেওয়া গুরুর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যিনি অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যান, তিনিই গুরু। আমার জীবনটাকে মুহূর্তেই আলোকিত করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আমার শিক্ষক কবীর স্যার। মায়ের অনুপ্রেরণায় আশৈশব নাচ শিখেছি নৃত্যশিল্পী শুক্লা সরকারের কাছে। ২০১১ সালে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে নাচে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ পেলাম রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটা নতুন দুয়ার খুলে গেল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করেছি, জার্মানিতে একটা আন্তর্জাতিক জার্নালে আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে, ন্যানো ফিজিকসে পিএইচডি করার একটা অফারও জুটেছে। ভীষণ দোটানায় পড়লাম; একদিকে বিজ্ঞানী হওয়ার সুযোগ, যে পেশা লোকের চোখে অত্যন্ত উচ্চমার্গীয়; অন্যদিকে নাচ, যা আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের সমাজে নাচকে কেউ কোনো কাজই মনে করে না, ‘নাচ-গান আমরা শখের বশে করি, এটা কখনোই কারও পেশা হতে পারে না’—অন্য সবার মতোই বললেন আমার বাবা-মা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব এক্সেলেন্সের লেজার ল্যাবে গোল্ড ন্যানো পার্টিকেল নিয়ে আমার থিসিস-পরবর্তী কাজ করছি। ওই ভবনের চারতলায় শিক্ষক আর শিক্ষানবিশ গবেষকদের জন্য একটা অত্যাধুনিক ফুড কোর্ট আছে। দুপুরে খেতে গেলাম, সামনের টেবিলে কবীর স্যার। স্যার আমাকে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ করার আমন্ত্রণ জানালেন। এটা একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত অংশ নিতাম, সেই সুবাদে সবাই জানত আমি ভালো নাচি। স্যারকে জার্মানির পিএইচডি অফারের কথা জানালাম, স্যার খুশি হলেন। আমি বললাম, জার্মানি গিয়ে সেই দেশের কিছু নাচও শিখে আসব। স্যার শুনে বললেন, ‘তুমি জীবনের যে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানে নাচ ও ফিজিকস আর একসঙ্গে চালানো যাবে না, নাচ বাদ দিতে হবে।’ আমি বললাম, ‘দুটোই চালিয়ে নিতে পারব, নাচ বাদ দেওয়া অসম্ভব।’ স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘তাহলে ফিজিকস বাদ দাও।’ আমি বললাম, ‘শুধু নাচ করে তো জীবন চালানো সম্ভব না, আর আমার মা-বাবাও রাজি হবেন না।’ স্যার বললেন, ‘তুমি জীবনে একটা রিস্ক নাও, সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হতে হবে—এগুলো অনেক পুরোনো চিন্তাভাবনা। আর ভুলেও সরকারি চাকরির ধারেকাছে যাবে না, যে কাজে তোমার প্রতিভা আছে সেটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নাও। আমার বিশ্বাস তুমি সফল হবে।’ স্যার আমাকে খাবারের বিল দিতে দিলেন না। বললেন, ‘নাচ করে যেদিন অনেক উপার্জন করবে সেদিন দিয়ো।’

জীবনে নতুন একটা অধ্যায় শুরু হলো কলকাতা গিয়ে। যতটা সম্ভব শেখার চেষ্টা করলাম। একেকজন গুরু কলকাতার একেক প্রান্তে থাকেন। বাস, ট্রাম, মেট্রো, অটো এগুলোতেই তাঁদের নিত্য যাতায়াত, কিন্তু খুব কষ্টের। আমি এসবে অনভ্যস্ত। অনেক সময় এক ঘণ্টা লাইন দিয়ে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়। সবকিছু সামলে পড়াশোনা আর নাচের অনুশীলন। কিন্তু কী আশ্চর্য, সারা দিন পরিশ্রম করেও আমি ক্লান্ত না। আমার মনেপ্রাণে শুধুই আনন্দ। মাঝে মাঝে চা বিক্রেতা কিংবা অটোচালক কাকুদের সঙ্গে আড্ডা জমে যেত। ভীষণ সংগ্রাম ওদের জীবনে, তবুও কী সুখী আর সন্তুষ্ট! চারপাশের স্বতঃস্ফূর্ততা আমাকে প্রভাবিত করতে শুরু করল। একসময় আবিষ্কার করলাম, আমি আর কারও মুখাপেক্ষী না, আমি স্বাধীন। চারপাশের মানুষগুলোকে একেকটা চরিত্র মনে হতে লাগল।

আমি ভাবলাম, আমরা নাচে শুধু ঈশ্বরকে বন্দনা করি, চারপাশে এত ঘটনা, এত চরিত্র—এসব নিয়ে নাচের মাধ্যমে গল্প বলতে পারি, মানুষের গল্প। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলো নিয়ে শুধু কাজ হয়, আমি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা কাজ করব। ওয়াটারনেসের ভাবনা নিয়ে তখন থেকেই কাজ শুরু করি। কলকাতায় গুরু হিসেবে পেলাম দক্ষিণ ভারতীয় সুজাতা রামালিঙ্গামকে। তাঁর সান্নিধ্যে নাচকে নতুন করে চিনলাম, জানলাম। কলকাতায় পড়ার সময় বেশ কিছু ভালো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ হলো। একবার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন হলো। সবাই নিজের দেশের নাচ আর গান করল। আমি ভরতনাট্যম শিখেছি সব সময়, তাই তিল্লানা করলাম। এক ইতালীয় বন্ধু বাংলাদেশের নাচ সম্পর্কে জানতে চাইল। আমি তেমন কিছু বলতে পারলাম না। মনে মনে লজ্জিত হলাম। ভাবলাম, এমন কিছু করব, যার মাধ্যমে আমাদের দেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরা যাবে। বাংলাদেশের নাচ খুঁজতে শুরু করলাম। সমসাময়িক নাচ শিখতে আগ্রহী হলাম, নিজে নিজে নতুন স্টেপ বানানোর চেষ্টা করলাম। কয়েক মাসের চেষ্টায় ‘অনামিকা সাগরকন্যা’ নামে একটা পাণ্ডুলিপি দাঁড় করালাম।

>ভাবলাম, এমন কিছু করব, যার মাধ্যমে আমাদের দেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরা যাবে। বাংলাদেশের নাচ খুঁজতে শুরু করলাম। সমসাময়িক নাচ শিখতে আগ্রহী হলাম, নিজে নিজে নতুন স্টেপ বানানোর চেষ্টা করলাম

একজন প্রেমিকের গল্প, হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় নানা সভ্যতার পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে যে তাঁর প্রেমিকা বনলতা সেনকে খুঁজছে। জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সাহিত্য আর ফিরোজা বেগমের কণ্ঠের সঙ্গে সমসাময়িক নাচের সংশ্লেষ ঘটিয়ে এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। ২০১৩ সালের নভেম্বরে দেশে ফিরে প্রযোজনাটি করার জন্য কিছু টিভি চ্যানেল আর এজেন্সিতে প্রস্তাব দিলাম। কেউ আগ্রহ দেখাল না। পাণ্ডুলিপিটা এভাবেই পড়ে থাকল প্রায় ছয় মাস। ‘ওয়াটারনেস’-এর মতো বিশাল বাজেটের প্রযোজনা তখন স্বপ্নবিলাস। আমার বান্ধবী মঞ্জুলিকার পরামর্শে ইন্টারনেটে ব্যাংককের একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করলাম। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা আমার স্বপ্ন ছিল। শুরুতেই বলেছি, মানুষ তাঁর স্বপ্নের চেয়ে বড়। বিশ্বের বড় বড় দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমার ‘অনামিকা সাগরকন্যা’ ব্যাংককের উৎসবে নির্বাচিত হলো। ব্যাংকক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাজের ওপর একটা কর্মশালাও পরিচালনা করলাম। মজার ব্যাপার, খবরটা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে যারা আগে অনাগ্রহ দেখিয়েছিল, তারা সবাই এবার অনেক বেশি আগ্রহ দেখাল। বুঝলাম, বিদেশের তকমা লাগলে আমাদের দেশীয় বাজারে সবকিছুর চাহিদা বেড়ে যায়।

সময় আমাদের এমন অনেক কিছুই শেখায়, যা অন্য কেউ শেখাতে পারে না। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি উপলব্ধি করলাম, আমি আর ভয় পাই না। ব্যাংকক থেকে ফিরে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে বিশাল বাজেটের ‘ওয়াটারনেস’ মঞ্চে আনলাম আমার সংগঠন ‘তুরঙ্গমী’ থেকে। পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আক্কু চৌধুরীর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমার এই সীমিত সময়ের চলার পথে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীকেও পেয়েছি, যাঁরা সত্যিকার অর্থেই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁদের নাম এখানে উল্লেখ করে ঋণ চুকিয়ে না দিয়ে আজীবন তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে চাই।

আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে অনেক নৃত্যশিল্পী তৈরি হয়েছে, আবার হারিয়েও গেছে। এর মূল কারণ পেশাদারির অভাব। আমি কখনো নাচের স্কুল খুলতে আগ্রহী হইনি; বরং যারা দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে নাচ শিখেছে, তাদের প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার ভাবনা নিয়ে তুরঙ্গমী প্রতিষ্ঠা করেছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগ, প্রদর্শনী থেকে আসা সামান্য আয় এবং করপোরেট পৃষ্ঠপোষকদের ওপর নির্ভর করে এত দূর এসেছি। কিন্তু এভাবে নাচকে একটা পূর্ণাঙ্গ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দাঁড় করানো খুব অনিশ্চিত। বাংলাদেশে নাচে অনেক সম্ভাবনা আছে। পেশাদার প্রযোজকেরা যদি এখানে বিনিয়োগ করেন, আমার বিশ্বাস তাঁরা লাভবান হবেন। নাচের প্রযোজনাগুলো দেখতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় অন্তত তা-ই ইঙ্গিত করে। পেশাদারি নিশ্চিত করার জন্য একটি নাচের দলের নিজস্ব মহড়াকক্ষ বা স্টুডিও ও অফিস স্পেস থাকা খুব জরুরি। সরকার এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। যোগ্যতার বিচারে মাসিক রেয়াতি হারে নাচের দলগুলোকে নিজস্ব মহড়ার জায়গা দিলে কাজের মান উন্নত করা আরও সহজ হবে। শুধু নাচের প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহার্য, উপযুক্ত কোনো মিলনায়তন স্বাধীনতার এত বছরেও তৈরি হয়নি—এটা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত লজ্জার। অনেক কিছুই নেই, তবে যার সৃজন করার স্পৃহা আছে, সে তার সৃজনীশক্তি দিয়ে অনেক ‘নাই’কে ‘আছে’তে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে। শিল্পের পথের পথিক আমি, সাংস্কৃতিক জগতের মৌলবাদীদের কটাক্ষ আমাকে ভীত করে না, পুলকিত করে। যতই ভ্রুকুটি দেখাও না কেন, বৃত্ত আমি ভাঙবই। এভাবেই আঘাত করব রক্ষণশীলতার শিকড়ে।

পূজা সেনগুপ্ত

নৃত্যশিল্পী ও নির্দেশক; আর্টিস্টিক ডিরেক্টর, তুরঙ্গমী