যে পৃথিবীতে যুদ্ধ নেই

জন লেনন
জন লেনন

এমন একটি পৃথিবী যদি হতো, যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, নেই ক্ষুধা বা দারিদ্র্য, নেই মানুষের মধ্যে বিভেদ। এমনকি নেই কোনো ধর্ম বা দোজখ বা বেহেশত বলতে কিছু। জন লেনন বিশ্বের কাছে অতি সাধারণ এমন একটি প্রশ্ন তোলেন। বলেন, একটু চেষ্টা করলেই এমন কিছু ভাবা যায়। আরও বলেন, এমন চিন্তাধারায় তিনি একা নন; তাঁর মতো অনেকেই এমন ভেবে থাকেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের শুরুতে যখন ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ একটি রক্তাক্ত লড়াইয়ে জড়িত, যেটিকে এখনো অনেকে উল্লেখ করে থাকে সেই শতাব্দীতে মানবতার বিরুদ্ধে এক বিশাল অন্যায় হিসেবে। জন লেনন মানুষকে আহ্বান করেন তাঁর সংগীতের মাধ্যমে মন খুলে একবার শুধু পৃথিবীটিকে ভিন্ন চোখে দেখতে। লেননের ‘ইম্যাজিন’ গানটিকে বলা হয়েছে বিশ্বের সেরা পাঁচটি গানের মধ্যে একটি। সরল মনের মানুষের কাছ থেকে সরল একটি গান, শুধু পিয়ানোর সঙ্গে খালি গলায় গাওয়া, যেটি আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে বিশ্বশান্তির একটি প্রতীক হিসেবে। কিন্তু যিনি, দ্য বিটলসের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং বাণিজ্যিক দিক থেকে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ব্যান্ডদলের একজন সদস্য, তিনি কীভাবে এত খ্যাতি ও সুনাম ছেড়ে মানবতার কাজে নামলেন?

১৯৪০ সালে ব্রিটেনের লিভারপুল শহরে জন লেননের জন্ম। লিভারপুলের পরিচয় ছিল তখনকার কালে শুধু জাহাজের ঘাঁটি হিসেবে, এখনো অনেকটা তা-ই। তবে বলা বাহুল্যও, তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে দ্য বিটলসের জন্মস্থান হওয়ার সুনাম। এই ঐতিহাসিক ব্যান্ড সম্বন্ধে কিছু জানে না, এমন লোক খুব কমই আছে। কিন্তু আমাদের জানার বাকি রয়ে যায় জন লেনন একজন ব্যক্তি মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে বিশ্বে কী অবদান রেখে যান।

একটি শ্রমিক শ্রেণির পরিবারে তাঁর জন্ম, মাত্র দুই বছর বয়সে লেননের বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তিনি তাঁর খালার কাছে মানুষ হন। ১৭ বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। এখান থেকে ধরে নেওয়া যেত যে আর দশটা শ্রমিক শ্রেণির মানুষের মতো তিনিও অভাবের মধ্যে একটি কষ্টের জীবনের পথে অগ্রসর হতে চললেন। কিন্তু লেনন সেদিকে যান না। মায়ের মৃত্যুর দুই বছর আগে তিনি দ্য কোয়্যারিমেন নামে একটি ব্যান্ডদল গঠন করেন। যেটি পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে দ্য বিটলস এবং সহগীতিকার স্যার পল ম্যাকার্টনির সঙ্গে তিনি সৃষ্টি করতে নেমে যান ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন একটি ব্যান্ডদল, যার ফলে—প্রকৃত অর্থে বলা যায়—পৃথিবীতে ‘পপ-কালচার’ বলে একটি জিনিসের জন্ম হয়।

১৯৬০ থেকে মাত্র একটি দশকের মধ্যে জন লেনন সৃষ্টি করে ফেলেন এক নতুন ধরনের কৃষ্টি, নতুন মানসিকতা, বিশ্বজুড়ে প্রচুর ভক্ত এবং তার ফলে প্রচুর টাকাও। অনেকে ভাবতে পারেন যে এখানেই কাহিনির শেষ। নিশ্চয়ই আজকালকার অন্য জনপ্রিয় শিল্পীদের মতো লেননও তাঁর অর্জন করা টাকা ও খ্যাতি উপভোগ করে বাকি জীবনটি আরামে কাটান। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাঁর জীবনের মূল কাজটি তখন থেকে সবেমাত্র শুরু হয়।

১৯৬৬ সালে দ্য বিটলস ভেঙে যাওয়ার কয়েক বছর আগে লেনন একটি কথা বলেন, যেটিকে অনেকে ধরে নেন মাত্র ৪০ বছর বয়সে তাঁর হত্যা হওয়ার পেছনে একটি কারণ বলে। তিনি বলেন, ‘আমরা (দ্য বিটলস) এখন যিশুখ্রিষ্টের চেয়ে জনপ্রিয়।’ কথাটি যুক্তরাজ্যে যখন বলেন, তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। কিন্তু তার কয়েক মাস পর যুক্তরাষ্ট্রে সেটি প্রচারিত হলে সেখানে তীব্র প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ যুক্তরাজ্যে অনেক গির্জায় পোড়ানো হয় বিটলসের অ্যালবাম ও পোস্টার, হুমকি আসে ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান থেকে। এর ফলে একসময় তাঁরা লাইভ শো সম্পূর্ণ বন্ধ করে একটি স্টুডিও ব্যান্ডে পরিণত হন। কিন্তু এখানে এ কথা উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, এ ঘটনায় প্রমাণ হয় যে বিটলসের সৃষ্টি করা এই পপ-কালচার পৃথিবীর বুকে কতখানি প্রভাব ফেলেছিল, যার ফলে তাঁরা নিজেরাও এমন ভুল ভাবতে পারলেন যে তাঁরা ধর্মের চেয়েও জনপ্রিয়। ব্যাপারটি দুঃখজনক হলেও এটির সঙ্গে শুরু হয় লেননের শেষ জীবনের কাজ, যেখানে তাঁর অবদান সংগীতের চেয়েও বেশি।

‘ইম্যাজিন’ গানের পোস্টারে পিয়ানোর সামনে জন লেনন
‘ইম্যাজিন’ গানের পোস্টারে পিয়ানোর সামনে জন লেনন

১৯৭১ সালে ‘ইম্যাজিন’ গানটি দিয়ে সরাসরি বুঝিয়ে দেন, যিশুখ্রিষ্টকে নিয়ে তাঁর মন্তব্যে আসলে তিনি কী বলতে চাইছিলেন। এর আগে ১৯৬৯ সালে ‘গিভ পিস আ চান্স’ (‘শান্তিকে সুযোগ দাও’) গানটি ছিল সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে উল্লেখ করে লেখা, ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে। একই সঙ্গে তিনি তাঁর সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস ব্যবহার করতে থাকেন বিশ্বশান্তির পেছনে।

এ সময় তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ইয়োকো ওনো নামের একজন শিল্পীকে। তিনি তখন তাঁর নিজের নাম বদলে জন ওনো লেনন করে নেন। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নিয়মকানুনের বিপরীতে চলে যান। ১৯৭০-এর দশকে এমন একটি কাজ কম কথা ছিল না। কিন্তু এখানেই দেখা যায় লেননের সবচেয়ে বড় অবদান মানুষের চিত্তে। ‘সমাজ চায় বলে আমি কেন করব?’ ধর্ম কী, যুদ্ধ কেন, লোভ-লালসা, চুরিচামারি, একে অপরকে অশ্রদ্ধা করা—এগুলো নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন এবং এই প্রশ্নগুলোকে তিনি তুলে ধরেন তাঁর সংগীতের মাধ্যমে।

কিন্তু তত দিনে তিনি নিজের চোখে একজন অসাধারণ সংগীতশিল্পী নন, বিশ্বের সেরা ব্যান্ডের একজন মূল সদস্য নন, প্রয়োজনের অধিক ধনসম্পদের মালিকও নন; নিজেকে তিনি দেখছেন একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, নিজের পরিশ্রমে অর্জিত খ্যাতি, সুনাম ও অর্থ ব্যয় করতে চান শান্তির খোঁজে। তাঁর দেখাদেখি অনেক শিল্পী চেষ্টা করেছেন এই বাণী প্রচার করতে। যেমন ভূপেন হাজারিকা করেছেন তাঁর ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ গান নিয়ে। কিন্তু নিজের গানের বাণীতে মনে-প্রাণে বিশ্বাসী ছিলেন সম্ভবত কেবল জন লেননই।

এসব যুদ্ধবিরোধী কথা ও গান প্রচারের ফলে তখনকার নিক্সন-সরকার অনেক চেষ্টা করে লেননকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করতে, কিন্তু তারা সফল হয় না। বব ডিলানসহ সেখানকার অনেক শিল্পী এর প্রতিবাদ করেন। বব ডিলান বলেন, লেননের মতো একজন শিল্পীর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা দরকার। একটি মজার ব্যাপার হলো, নিক্সন-সরকার লেননকে বের করতে চায় এ কারণ দেখিয়ে যে তিনি যুক্তরাজ্যে থাকাকালে একদিন গাঁজা নিয়ে ধরা পড়েছিলেন।

অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অনুমতি পেলেও জন লেনন স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে অবিরাম তাঁর মানবিক ও মনুষ্যত্ব-সংক্রান্ত কাজ চালিয়ে যান। তাঁর সঙ্গে তিনি ‘বেড-ইন’ নামে এক নতুন ধরনের প্রতিবাদ শুরু করেন, যেটিতে তাঁরা দুজনে খোলামেলাভাবে তাঁদের শোবার ঘরে মানুষদের আমন্ত্রণ করেন তাঁদের দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছু স্বচক্ষে দেখতে। এও ছিল তাঁদের যুদ্ধের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ। যুদ্ধ মানুষের গোপনীয়তা, তাঁদের একান্ত আশ্রয় কীভাবে কেড়ে নেয় বোঝাতে।

এসব কারণে হোক কিংবা ধর্ম সম্পর্কে মন্তব্যের কারণে হোক, একজন ক্রুদ্ধ ভক্তের হাতে জন লেনন মারা যান ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে। তাঁকে সাতবার গুলি করা হয়। জন লেনন মারা যান তাঁর ৪০ বছর বয়সে। তিনি মারা যান, কিন্তু পৃথিবীতে রেখে যান একটি শান্তির বাণী। বিশ্বশান্তি ও মানবতার প্রতীক হিসেবে যেটি আজও মানুষ স্মরণ করে। লেননের অবদান যে কতটা গভীরভাবে মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে, তার প্রমাণ আছে চেক রিপাবলিকের প্রাগের একটি দেয়ালে। প্রাগের সেই দেয়ালটির নাম ‘লেনন ওয়াল’। হংকংয়েও রয়েছে এমন আরেকটি দেয়াল। সেই দেয়ালে মানুষ লিখে যায় লেননের ও বিটলসের গানের কথা, শান্তির কথা; তাঁর স্মরণে এঁকে রেখে যায় ছবি আর গ্রাফিটি।

শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের এক অগ্রণী নায়ক ছিলেন জন লেনন, যেমন ছিলেন গান্ধীজি ব্রিটিশ ভারতে। শিল্পের মাধ্যমে যে বিশ্বের চিন্তাধারা, মানসিকতা ও ব্যবহারে গভীর প্রভাব ফেলা যায়, জন লেনন তা প্রমাণ করে যান।

দ্বিতীয় সৈয়দ-হক: লেখক ও সংগীতশিল্পী