গণিতের প্রহেলিকা

শ্রীনিবাস রামানুজন
শ্রীনিবাস রামানুজন

এক আকুল মা ১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে দ্য হিন্দু পত্রিকায় ‘হারানো বালক’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞপ্তিতে দিয়েছেন, আনুমানিক ১৮ বছরের এক তরুণ ভুল-বোঝাবুঝির কারণে বাসা থেকে চলে গেছে। কয়েক দিন আগেও সে কুম্বাকোনাম কলেজে পড়ত।
এখনকার দিনে এমন একটা বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় ছাপা হলে আমরা অনেক কিছুই ভেবে বসতাম। তবে ওই বালকের ঘর ছাড়ার কারণ নিজের পছন্দের বিষয়ে আরও বেশি সময় দেওয়ার জন্য। বালকের নাম শ্রীনিবাস রামানুজন, আর তাঁর প্রিয় বিষয়ের নাম গণিত। গণিতকে ভালোবেসে ঘর ছাড়ার দ্বিতীয় কোনো নজির নেই।
এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বেশ কিছুদিন আগে রামানুজনের স্কুল শেষ হয়েছে। কিন্তু কলেজে গণিত ছাড়াও আরও অনেক বিষয়। কোনোটাই তার ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে শুধু গণিত আর গণিত। কাজেই বাকি বিষয়গুলোতে কৃতকার্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বাড়ি ছেড়েই পালিয়ে যায় রামানুজন!
তো, রামানুজন গণিতকে কেমন ভালোবাসতেন?
সেটা ইন্টারনেটের যুগ নয়, তবে পড়ালেখার যুগ বটে। ১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর রামানুজনের জন্ম। পরাধীন ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রামে। রামানুজনের কয়েকজন ভাইবোন বাঁচেনি বলে রামানুজন একটু বাড়তি খাতির পেত। ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান নিরামিষাশী রামানুজনের মুখস্থশক্তির ক্ষমতা দেখে পাড়ার লোকেরা চমকিত হতে শুরু করে ছোটবেলায়। পাই (বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত) বা ২-এর বর্গমূলের মান দশমিকের পর অনেক দূর পর্যন্ত বলে যেতে পারতেন রামানুজন। প্রাইমারি ডিঙিয়ে যখন হাইস্কুলে পড়তে শুরু করলেন, তখনই লোকজন টের পেল, এটা শুধু মুখস্থের ব্যাপার নয়। এমন সবকিছু তিনি বলেন বা করেন, যা কিনা কোনো বই-পুস্তকে আছে কি না সেটাই কেউ বলতে পারে না।
ছোটবেলা থেকে মৌলিক সংখ্যা নিয়ে রামানুজনের আগ্রহ। কোনো একটা সংখ্যা মৌলিক কি না, এটা জানতে হলে দেখতে হয় সেই সংখ্যাটিকে অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করা যায় কি না। গণিতবিদদের ভাষায় একে বলা হয় সংখ্যাকে মৌলিক উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা। রামানুজন কাজটা করে ফেলতে পারতেন আশ্চর্য দ্রুততায় ও নির্ভুলভাবে। সে সময়েই রামানুজন অয়লারের ধ্রুবক আর বার্নোলির সংখ্যা নিয়েও কাজ করতে শুরু করেন। গণিতবিদেরা জানেন, এই কাজটা মোটেই সহজ নয়।
ঝামেলা হলো মাদ্রাজের কুম্বাকোনাম শহরে রামানুজনের কাজ বুঝতে পারে এমন কেউ তো নেই। কাজেই কলেজের পাততাড়ি গুটিয়ে রামানুজন পাড়ি জমালেন মাদ্রাজে। ছেলের মতি ফেরানোর জন্য মায়েরা যা করেন, রামানুজনের মা কোমলতাম্মালও তা-ই করলেন। ১৯০৯ সালে ২১ বছর বয়সে রামানুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেন ৯ বছর বয়সী জানকি দেবীর সঙ্গে। তাতে রামানুজন একটু সুস্থির হলেন বটে, তবে তার প্রথম প্রেম কিন্তু ছুটল না।

এরই মধ্যে মাদ্রাজ শহরে রামানুজনের নাম ছড়িয়ে পড়েছে গণিতের জাদুকর হিসেবে। আর দিন কাটাতে গণিতের টিউশনি। ঠিক এই সময়েই ভারতীয় গণিত সমিতি তাদের জার্নাল অব দ্য ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি প্রকাশ শুরু করে। রামানুজন ভাবেন, ওরাই তাঁর কাজ বুঝতে পারবে। ১৯১১ সালে বার্নোলি সংখ্যার বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর প্রথম নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তখনই লোকে বুঝতে পারে তাঁর প্রতিভা। তাঁর প্রাপ্ত ফলাফলগুলো খুব যে আকর্ষণীয় ছিল তা নয়, কিন্তু তাঁর অভিমুখের মধ্যে নতুনত্ব ছিল। কারণ একই সঙ্গে মান কতভাবে আর কীভাবে পাওয়া যায়, তিনি এই দুইয়েরই সন্ধান করতেন।

জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশের পর থেকে অনেকেই রামানুজনের জন্য বৃত্তির চেষ্টা করে সফল হননি। বাধ্য হয়ে মাদ্রাজ বন্দরে কেরানির চাকরিতে যোগ দেন রামানুজন। শেষমেশ রামানুজন নিজেই ব্রিটিশ গণিতবিদদের কাছে চিঠি লিখতে শুরু করেন। এভাবেই ১৯১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম যুগান্তকারী চিঠিটি লেখেন তিনি (দ্বিতীয়টি ঢাকা থেকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে লিখেছিলেন সত্যেন বসু)।

প্রায় ১৫ দিন পর ৩১ জানুয়ারি ওই চিঠি কেমব্রিজের গণিতবিদ জি এইচ হার্ডির হাতে পৌঁছায়। প্যাকেট খুলে হার্ডি পেলেন ১১ পাতার সংযোজনীসহ একটি পত্র। রামানুজন নিজেকে ‘মাদ্রাজ বন্দরে বছরে ২০ পাউন্ড বেতনের একজন কেরানি’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাঁর ‘গাণিতিক বিষয়গুলো’ দেখার জন্য হার্ডিকে অনুরোধ করেছেন। রামানুজনের ধারণা ছিল, তাঁর বেশির ভাগ কাজই একেবারে নতুন—কারণ মাদ্রাজের কেউ বিষয়গুলো ধরতে পারতেন না—কিন্তু হার্ডি একনজর দেখেই তাঁর অনেকগুলোই চিনতে পারেন। ১১ পাতায় প্রায় ১২০টি গাণিতিক হিসাব ও ফলাফল। এর মধ্যে সবচেয়ে বিদঘুটে ব্যাপার হলো পৃথিবীর সব ধনাত্মক সংখ্যার যোগফল হলো ঋণাত্মক এক-দ্বাদশাংশ।

তামিলনাড়ুর কুম্বাকোনাম শহরে রামানুজনের পৈতৃক বাড়ি
তামিলনাড়ুর কুম্বাকোনাম শহরে রামানুজনের পৈতৃক বাড়ি

এগুলো কী? কোথা থেকে এল? হার্ডি প্রথমে দৌড়ালেন লিটলউডের কাছে। দুজনে মিলে বোঝার চেষ্টা করলেন রামানুজন উদ্ধৃত সূত্র বা উপপাদ্যগুলো ঠিক কিনা। শেষমেশ দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে এগুলো অবশ্যই সত্য, নইলে এগুলো উদ্ভাবনের কথা কারও কল্পনাতেও আসত না। সে সময়ে বাট্রা৴ন্ড রাসেল কেমব্রিজে। তাঁর ভাষায়, ‘হার্ডি আর লিটলউডের তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা দ্বিতীয় নিউটনকে খুঁজে পেয়েছে।’
হার্ডি রামানুজনকে চিঠি লিখে জানান, চিঠি ও উপপাদ্যগুলোতে তাঁর ‘বেজায় আগ্রহ’। রামানুজন যেন কয়েকটা উপপাদ্যের প্রমাণ লিখে পাঠান। সেই চিঠির জবাবে রামানুজন বলেন, কেন? পৃথিবীর তাবৎ ধ্বনাত্মক সংখ্যার যোগফল ঋণাত্মক এক-দ্বাদশাংশ।
রামানুজনের উত্তর দেখে হার্ডি বুঝলেন, ওই মাদ্রাজি তরুণ আসলে অয়লারের জেটা ফাংশন নিজেই খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু সেটিকে ভুলভাবে ব্যবহার করেছেন। হার্ডির যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। এই মানব-ক্যালকুলেটরকে তিনি ইংল্যান্ডে আনার ব্যবস্থা করেন। কাজটা সহজ ছিল না। তিনি কলেজ পাস নন। কিন্তু রামানুজন কেমব্রিজে হাজির হলেন।

রামানুজনের নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে বিজ্ঞাপন, দ্য হিন্দু, ২ সেপ্টেম্বর ১৯০৬
রামানুজনের নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে বিজ্ঞাপন, দ্য হিন্দু, ২ সেপ্টেম্বর ১৯০৬

মাদ্রাজ বন্দরের এই বিস্ময়কর কেরানি আসলে কী খুঁজতেন? সংখ্যার ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য আর সেসব খুঁজে পাওয়ার পথ। ১৯১৪ সালে তাঁর প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি পাই-সংক্রান্ত একটা হিসাব করেন কোনো গণনাযন্ত্র ছাড়াই। অনেকেই অবাক হতে পারেন, এটি ‘কাকতালীয়ভাবে’ এখনকার হিসাবের অনেক কাছাকাছি। কিন্তু শুধু হিসাব করেই রামানুজন ক্ষান্তি দেননি। তিনি পাইয়ের আরও অনেক সম্পর্ক খুঁজে পেলেন, সারি সারি ধারা বের করলেন, সব শেষে বের করলেন আরও ভালোভাবে পাইয়ের মান বের করার উপায়। আর তা করতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করলেন নতুন এক ফাংশন, এখন যার নাম উপবৃত্তাকার ফাংশন।
তাঁর বেশির ভাগ কাজই সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে। পাশাপাশি গাণিতিক বিশ্লেষণ, অসীম ধারা ও আবৃত ভগ্নাংশ নিয়েও তাঁর প্রচুর কাজ। কিন্তু সবটা জুড়েই ওই সংখ্যা।
রামানুজন কেমব্রিজে আসার কয়েক মাস পর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তার দামামা এসে লাগল কেমব্রিজেও। লিটলউড চলে গেলেন সামরিক বাহিনীতে। শারীরিক কারণে হার্ডি পারলেন না। সমস্যায় পড়ে গেলেন আমাদের নিরামিষাশী। শাকসবজি যে সহজে পাওয়া যায় না।
১৯১৫ সালের রামানুজন গাণিতিক ফাংশনের সর্বোচ্চ মান নিয়ে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখলেন। সেখানে বাতলে দিলেন যেকোনো সংখ্যার উৎপাদকের সংখ্যা বের করার একটা কৌশল। এর পরপর কয়েক বছর ধরে রামানুজন আরও নিবন্ধ লিখলেন। এর একটি হার্ডির সঙ্গে যৌথভাবে, পার্টিশন ফাংশন নিয়ে। তাতে ছিল কোনো পূর্ণ সংখ্যাকে অন্য কিছু পূর্ণ সংখ্যার যোগফল হিসেবে প্রকাশ করার পদ্ধতি। ১৯১৮ সালে দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে রামানুজন ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন। এর আগে ৩১ বছর বয়সী কেউ এই সমিতির ফেলো হতে পারেননি। একই বছরের ৩১ অক্টোবর রামানুজন ট্রিনিটি কলেজের ফেলো নির্বাচিত হলে তাঁর আর্থিক কষ্টের অবসান ঘটে।

কিন্তু ১৯১৭ সালেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকদের ধারণা, ছোটবেলার কোনো জন্ডিসের জীবাণু তিনি লন্ডনে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটিই তাঁকে বিপদে ফেলে। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৩ মার্চ তিনি ভাঙা শরীর নিয়ে মাদ্রাজে ফিরে আসেন। এই শরীর নিয়েও তাঁর গণিতযুদ্ধ চলতেই থাকে। প্রথম থেকেই রামানুজন তাঁর সব গবেষণালব্ধ ফল নোটখাতায় টুকে রাখতেন। এ রকম চারটি নোটবইয়ের বিভিন্ন ফলাফল থেকে গণিতবিদেরা এখনো অনুপ্রেরণা খুঁজে নেন।

অসুস্থ রামানুজনকে একদিন দেখতে গিয়েছিলেন হার্ডি। হার্ডির ট্যাক্সির নম্বর ১৭২৯। হার্ডির কাছে এই সংখ্যাটির মোটেই কোনো আকর্ষণ ছিল না। অসুস্থ রামানুজন বললেন, ব্যাপারটা একেবারেই ঠিক না। এটি হলো সবচেয়ে ছোট সংখ্যা, যাকে দুটি ধ্বনাত্মক সংখ্যার ঘনকের যোগফল হিসেবে দুভাবে প্রকাশ করা যায়।

১৭২৯ = ১৩ ^+ ১২৩ ^= ৯৩ ^+ ১০৩^

হার্ডি প্রশ্ন করলেন, এর পরের সংখ্যাটি কত? রামানুজন বলেন, এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে সংখ্যাটি অনেক বড়।

কেমব্রিজেরই আরেক গণিতবিদ জামাল নজরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিতে বছর বিশেক আগে আমি চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। পৌঁছে দেখি তিনি নাশতার টেবিলে। তিনিও হিসাব করেছিলেন ক্যালকুলেটর ছাড়াই। সেখানে বসে তিনি খবরের কাগজে পরের সেই সংখ্যাটা লিখে দেখালেন। এখন তো গুগল করলেই জানা যায়, সেই সংখ্যাটা হলো ৮ কোটি ৭৫ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৯।

২৬ এপ্রিল ১৯২০ মারা যাওয়ার আগে রামানুজন গণিতবিশ্বের জন্য এমন সব সংখ্যা আর অনুমান রেখে গেছেন, যা মানবজাতির কাছে তাঁকে যুগ যুগ ধরে এক আশ্চর্য প্রহেলিকা বানিয়ে রাখবে।

মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি