অবরুদ্ধ দিনলিপি

অ্যান ফ্রাঙ্ক
অ্যান ফ্রাঙ্ক

অ্যান ফ্রাঙ্ককে নিয়ে নানা দেশের মানুষ গবেষণা করেছে, এপিক ছবি তৈরি করেছে। তাঁর আত্মস্মৃতি আর গল্প দৃশ্যে দৃশ্যে অঙ্কে অঙ্কে তুঙ্গ মুহূর্তকে স্পর্শ করেছে। অ্যান ফ্রাঙ্কের মৃত্যুর পর ডকুমেন্টারিতে তাঁর চলন্ত ফুটেজও দেখিয়েছেন স্বনামধন্য পরিচালক জন ব্লেয়ার।
‘আমি পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চাই মানুষকে আনন্দ দিতে। মানুষের জন্য একটি অর্থময় পৃথিবী তৈরি করতে। মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে চাই আমি। আমি ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে দিয়েছেন এমন এক উপহার, (লেখার ক্ষমতা) যার মধ্য দিয়ে আমি আমাকে প্রকাশ করতে পারি।’ লিখেছিলেন অ্যান ফ্রাঙ্ক তাঁর ৫ এপ্রিল ১৯৪৪ তারিখের দিনলিপিতে।
অ্যান ফ্রাঙ্কের ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন কি ঈশ্বর? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবের সময়ে লেখা তাঁর অতিনিভৃত দিনলিপের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর আত্মস্মৃতির আখ্যান তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।
এই দিনলিপি লেখার সময়টি অশেষ মূল্যবান ছিল বিশ্বের ইতিহাসে। নাৎসিরা মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সে সময়ে লেখা তাঁর কৈশোর আর বয়ঃসন্ধিকালের আখ্যান হাতে পেলাম আমরা। এক কিশোরী বেড়ে উঠছে, আর তাঁর নারীতে পরিণত হওয়ার পথে তাঁর সময়কে নানাবিধ রোমাঞ্চকর রূপকল্পে প্রশস্ত করছে। সে ভাবছে, কিছুতেই সে মায়ের মতো হবে না, মায়ের জীবন তাঁর কাছে শুধুই গার্হস্থ্যকর্মের অর্থহীন একঘেয়ে বিষাদ। সে অবশ্যই বাইরের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে, নারীবাদী চিন্তাকল্প বিস্তারিত হওয়ার দিকে ইঙ্গিত রয়ে যায়। কোন ফ্রেমে আমরা অ্যান ফ্রাঙ্ক পড়তে চাই, সেটাই আসল।
সারা পৃথিবীতে হলোকস্ট নিয়ে গবেষণা চলছে বিস্তর। অ্যান ফ্রাঙ্কের জীবনকে আমরা কীভাবে বন্দনা করব, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বোঝাপড়া। সারা বিশ্বে অ্যান ফ্রাঙ্কের আত্মস্মৃতি, আখ্যান বা গল্প হয়ে উঠল হলোকস্টের এক আভিধানিক শব্দকোষ। এই লেখার মধ্যে পাওয়া গেল সাংস্কৃতিক কল্পনার একটি আধুনিক বুনট। আত্মস্মৃতির চেনা কাঠামোতে একটি বিশেষ সময়ের জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন, চিন্তা, অবরুদ্ধতার ঘটনাবিন্যাস।
অ্যান ফ্রাঙ্কের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক আউশভিৎস ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে মেয়ের লেখা দিনলিপিটি হাতে পেয়ে নিজের কন্যার ব্যক্তিত্বকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন। মেয়ের লেখা প্রাণবন্ত শব্দের ভেতরে তিনি দেখলেন নতুন এক আশ্চর্য পৃথিবী চমকপ্রদ ফুটে উঠেছে। বাবা হিসেবে তিনি মেয়ের লেখার দক্ষতার দিকেও তাকিয়েছিলেন। প্রগাঢ় সেই কল্পনাশক্তির মুখোমুখি হয়ে তিনি শোক করার ভাষা হারিয়েছিলেন।
আমাদের নিজস্ব জানাশোনার বাইরের যে দুঃখ বা বঞ্চনা, তার জন্য আমরা কী করে শোক করি? আমরা কি সারা পৃথিবীতে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত, প্যারানয়েড আতঙ্কের বাণিজ্যিক অনুপ্রবেশ, নোংরা, দুর্গন্ধময় গোপন রাষ্ট্রের চর হিসেবে ইহুদিদের প্রতিপন্ন করার সেই ফ্যাসিস্ট চক্রান্তের বলি হিসেবে অ্যান ফ্রাঙ্কের মৃত্যুকে দেখতে পারি? আমরা কি আসলে অনুধাবন করতে পারি সেই দস্যুতার ইতিবৃত্তকে? আমাদের অনভিজ্ঞতার পরিসরহীন স্মৃতিতে যেখানে আউশভিৎস বা বেরগেন-বেলজেন নামের কোনো ভূখণ্ড ছিল না?

অ্যান ফ্রাঙ্কের দিনলিপির একটি পাতা
অ্যান ফ্রাঙ্কের দিনলিপির একটি পাতা

চলচ্চিত্রকার ব্লেয়ার মনে করান অ্যান ফ্রাঙ্ক লিখেছিলেন, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করি, সবকিছুর পরও মানুষ কখনো খারাপ হতে পারে না।’
এই তথ্যচিত্রের রয়েছে নানাবিধ চেহারা। সেখানে ফ্রাঙ্ক পরিবারকে আমস্টারডাম থেকে সরানো, তাঁদের আদি বসতিস্থলের শিকড়বাকড়, স্মৃতিময়তা, যুদ্ধদিনের বন্দী দিনগুলোতে অ্যানের লুকিয়ে থাকার গোপন কুঠুরি—এসবের মধ্য দিয়ে অ্যান ফ্রাঙ্কের নিষ্পাপ মুখচ্ছবিটি তাঁর জীবনের সত্যদৃশ্যকে অপরিহার্য আর প্রান্তিক করে তুলল। পৃথিবীর মানুষের কাছে অ্যান ফ্রাঙ্ক হয়ে উঠলেন অঙ্কিত দেবীপ্রতিমা। তিনি হয়ে উঠেছেন ‘নান্দনিক জ্ঞান’-এর জীবনপুরাণ। আমাদের ভেতরে পরিব্যাপ্ত হয়েছে তাঁর কান্তিময় কৈশোরকালের রূপ। এই দুঃখের জন্য আমরা কী আকারে শোক পালন করব, সেটা এখন এক সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছে। শোকের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ যে আখ্যানটি চালু রয়েছে তা দগদগে রক্তমাখাও নয়, বরং এখন ভক্তির জায়গা নিয়েছে। অ্যান ফ্রাঙ্কের দিনলিপির ভেতরে লোকে দেখে তাঁর ইচ্ছাটাই শেষমেশ সত্যে পরিণত হয়েছে। কারণ তিনি লিখেছিলেন, ‘মৃত্যুর পরও আমি বেঁচে থাকতে চাই।’
অ্যানের লেখা দিনলিপি তাঁর জীবনে অমরত্ব নিয়ে এসেছে। তাতে যেন এই অনপনেয় ক্ষতির, অপ্রবোধনীয় বঞ্চনার গুরুত্ব হ্রাস পায়। আমরা ভাবি কী করে একটি আশ্চর্য বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ের জীবনাবসান হলো এক মুহূর্তে। অ্যাটম বোমার মাশরুম ইমেজের মতো অ্যান ফ্রাঙ্ক এক মুহূর্তে বনে যান চিরকালের স্থির ফ্রেমবন্দী। তাঁর জীবনাবসানের ইতিহাস চাপা পড়ে যায় সহস্র জীবন ধ্বংস হওয়ার সেই যুদ্ধাস্ত্র, ক্যাম্পের বীভৎস চিত্র, একটি ধর্মসম্প্রদায়ের বিলোপ সাধনের চেষ্টার অন্যায় ইতিহাসের নিচে।

আমস্টারডামের এই বাড়িতে অ্যান ফ্রাঙ্কের পরিবার বসবাস করেছে ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত
আমস্টারডামের এই বাড়িতে অ্যান ফ্রাঙ্কের পরিবার বসবাস করেছে ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত

আধুনিক বিশ্ব এসব মৃত্যুকে যতিচিহ্ন আকারে দেখাতে চায়। রাজনৈতিক ইতিহাসের রাতের আকাশে বোমাবর্ষণের দীপাবলি কত সুন্দর, কোনো অবরুদ্ধ শহরের যুদ্ধে লুট হিসেবে দিনের পর দিন কোনো ক্যাম্পে মানুষের মৃত্যুর খঞ্জতা, উদ্বাসন, আতঙ্ক, স্মৃতি প্রধান উপাদান আকারে জারি থাকে। তাঁর মৃত্যুর কোনো ছবি কোথাও নেই বলে আমরা মনে করতে থাকি, যেন অ্যান ফ্রাঙ্ক মরেননি, ক্ষুধা আর ঠান্ডায় তিনি তাঁর জৈবরসায়ন প্রতিহত করতে পারেননি বলে চলে গেছেন নিরুদ্দেশে। যাওয়ার সময় তিনি মৃতদেহ সঙ্গে নিতে পারেননি। বাস্তবের চেয়েও বেশি প্রত্যক্ষ তিনি। নিজেকে তিনি সেই প্রত্যক্ষের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন। তিনি এক রূপকহীন বাস্তব। আমাদের ভাষা, আমাদের জীবন পরিস্থিতি বিশেষ কুশলতাতেও আর তাঁকে ধরতে পারে না। এটি ছিল এক অনন্ত প্রক্রিয়া, সেখানে কে মারা যাচ্ছে আর কে মারা যাচ্ছে না, তার হিসাব ছিল না। সে সময়কে মানচিত্রের ছকে তোলা যায় না।
হ্যানলিস গসলার নামে একজন অ্যান ফ্রাঙ্কের সঙ্গে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বেলজেন-বেলসেনে ছিলেন। তিনি ফিরে এসে বলেছেন, ‘অ্যান মারা গেছে নিঃসঙ্গতার আতঙ্কে, কারণ সে ভাবছিল তার মা অথবা বোন অথবা বাবা কারোরই আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই, তাহলে সে একা বেঁচে থাকবে কী করে?’
এই নিপীড়নের কর্তব্যনির্ণয়, যুদ্ধ, দেশহীনতা, সন্দেহ, বিদ্বেষ আর এভাবে মানুষকে মেরে ফেলা আর মৃত্যুর প্রক্রিয়াটিকে অগ্রিম, অভিপ্রেত করে তোলার যে কৌশল, সেটি এমন করে তৈরি করা, যেন মানসিক ও শারীরিকভাবে কর্তা নিজেও এই প্রক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যুযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘ বিলম্বিত এই প্রক্রিয়া, যেখানে শরীর আর ঠিক শরীর থাকে না।
নির্যাতন শিবির থেকে জীবিত ফিরে আসা আরেক লেখক প্রাইমো লেভি বলেছেন, ‘আমরা যারা বেঁচে ফিরেছি তারা কিছুতেই সত্যদৃশ্য বলতে পারব না। কারণ আমরা সত্য কী জানি না। সংগতিহীন বিসদৃশ ঊনজন আমরা। আমরা সেই ভাগ্যবান, যারা কৌশলে পলায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। যারা দেখেছে সেই ভয়ংকর প্রলয়কে, তারা ফিরে এসে সাক্ষ্য দিতে পারেনি। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী একজনও ফিরে আসতে পারেনি। তাদের মৃত্যু শুরু হয়েছিল তাদের শরীরেরও আগে। তাদের স্মরণশক্তি লোপ করা হয়েছিল। তাদের শোনা, বোঝা ও দেখার ক্ষমতা লোপ করা হয়েছিল। অনাহারে কাতর শরীরকে দগ্ধ করা, মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করার মধ্য দিয়ে তার সমুদ্রবেষ্টিত চেতনার দেশহীনতা, স্মৃতিহীনতা কালশূন্য করে ফেলা হতো। নিজের শবদেহ তারা নিজেরা টেনে টেনে গর্তে ঢোকাত পরে।’

অ্যান ফ্রাঙ্ক তাঁর দিনলিপিতে তাঁর ভাষার ভেতরে নিজের জীবনকে নথিবদ্ধ করেছেন। দুঃসহ সেই প্রহর মানব ইতিহাসে অচেনা।

কার জন্য আমরা এখন শোক করব? এই মৃত্যু সংরুদ্ধ নয়। সীমিত নয়। অতীত নয়। এ মৃত্যু এখনো অন্য কোথাও হয়ে চলেছে। আর এই অপরাধে আমরা সবাই সংশ্লিষ্ট আছি। 

শিকোয়া নাজনীন: লেখক