বিক্ষুব্ধ অস্থির প্রতিভা

এভারিস্ত গালোয়া
এভারিস্ত গালোয়া

এভারিস্ত গালোয়া (১৮১১-৩২) এমন একটি নাম, যা বিপ্লব, অপরিণত তারুণ্য, ক্রোধ, রাজনৈতিক সক্রিয়তা, অস্থিরচিত্ততা, দুর্ভাগ্য আর অতুলনীয় প্রতিভার সঙ্গে মিশে আছে। মাত্র ২০ বছর বয়সের আয়ুষ্কালের মধ্যে গালোয়া গণিতের অন্তত তিনটি শাখায় যুগান্তকারী অবদান রেখেছিলেন।
যে বিক্ষুব্ধ সময়ে গালোয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তার সূচনা ১৭৮৯ সালের বাস্তিল দুর্গ পতনের সময় থেকে। তখনই রাজা ষোড়শ লুইয়ের খারাপ সময়ের শুরু। এর সমাপ্তি ১৭৯৩ সালে রাজার শিরশ্ছেদে। এরপর বহু রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক বিচার বা প্রহসনের শুরু হয়। এর মধ্যেই নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি সামরিক অভিযান একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনতে থাকে। ১৮০৪ সালে তিনি সম্রাট হন। তবে ১৮১২ সালে রুশ রণাঙ্গনে পরাজয়ের পর থেকে আর কোনো সামরিক বিজয় নেপোলিয়ন আনতে পারেননি। ফলে অষ্টাদশ লুইয়ের হাতে সাম্রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু ১৮১৫ সালে আবার সিংহাসন অধিগ্রহণ করেন, ওয়াটারলুর যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে, পুনরায় নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন এবং রাজা অষ্টাদশ লুই আবার ক্ষমতা দখল করেন। এসব ঘটনা ফ্রান্সে ‘এক শ দিনের ঘটনা’ নামে পরিচিত।
এ রকম রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার মধ্যে নিরপেক্ষ থাকাটা কঠিন। স্বভাবতই গালোয়ার মা-বাবাও এতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁরা ছিলেন রিপাবলিকান দলের অনুসারী ও রাজতন্ত্রের বিরোধী। এভারিস্তের বাবা নিকোলা-গাব্রিয়েল গালোয়ার দর্শনসহ নানা বিষয়ে পড়াশোনা ছিল। অষ্টাদশ লুইয়ের সময়ে তিনি একটি গ্রামের মেয়র হয়েছিলেন। গালোয়ার মা-ও ছিলেন চিন্তাশীল ও পড়ুয়া নারী। সব মিলিয়ে গালোয়ার পরিবার ছিল চিন্তাশীল এবং রাজনৈতিক মতাদর্শে সচেতন।
১৮২৩ সালে ১২ বছর বয়সে গালোয়া স্কুলে ভর্তি হন। সামাজিক ডামাডোলে স্কুলগুলোও তখন শরিক হয়ে পড়েছে। শিক্ষকেরা চাইছেন রাজকীয় ব্যবস্থায় ফিরে যেতে। কিন্তু ছাত্র ও অভিভাবকেরা চাইছিলেন গণতন্ত্র-সাম্য, মুক্তি, মৈত্রী। এই টানাপোড়েন গালোয়াকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। শোনা যায়, স্কুল কতৃর্পক্ষের সঙ্গে তাঁর প্রায়ই খিটিমিটি লেগে যেত। তিনি এতই জেদি ছিলেন যে কোনো শাস্তিই তাঁকে দমাতে পারত না।
১৮২৪ সালে প্রথম গণিত ক্লাসের স্বাদ নেন গালোয়া। মঁসিয়ে ভেরনিয়েরের ক্লাসে লেজেন্ডারের লেখা জ্যামিতির পাঠ্যবই পান। বইটার সব কটি পাতা আত্মস্থ করেন তিনি। পরে আবেলের লেখা অ্যালজেব্রার বই পড়ে বীজগণিতে সিদ্ধহস্ত হলেও গালোয়ার প্রথম প্রেম লেজেন্ডারের জ্যামিতি। গণিতের প্রতি গালোয়ার বিশেষ প্রীতি ও ক্ষমতা প্রকাশ পেতে থাকে। গালোয়া বেশির ভাগ গণনা মাথার ভেতরেই করতেন বলে গণিতের প্রয়োজনীয় ধাপগুলো স্পষ্ট করার মতো ধৈর্য রাখতেন না। কয়েকটি ধাপ ঊহ্য রেখেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতেন।
সেই সময় প্যারিসে সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একোল পলিটেকনিক। ফলে ভর্তি পরীক্ষায় ছিল অনেক প্রতিযোগিতা। বিশেষ প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণেরও দরকার হতো। ১৮২৮ সালে প্রথমবারের মতো ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি ব্যর্থ হন। কিন্তু গালোয়াকে দমায় কার সাধ্য। অবিরত ভগ্নাংশের বিষয়ে তাঁর প্রথম লেখা গাণিতিক প্রবন্ধ ছাপা হলো অ্যানালেন ডি ম্যাথমেটিকে। এর পরপর একাডেমি অব সায়েন্সে তিনি দুটি প্রবন্ধ পাঠান সমীকরণ তত্ত্বের ওপর। বিশেষ করে তিনি কাজ করছিলেন বহুপদী সমীকরণের সমাধানের বিষয়ে। আউগুস্তাঁ কশি ছিলেন সেই দুই পেপারের বিশেষজ্ঞ রেফারি। কশির উপদেশ ছিল, এ দুটি পেপারকে একত্রে প্রকাশ করার।

পলিটেকনিকে ভর্তি বিপর্যয়ের পরপর একই বছরের জুলাইয়ে গালোয়ার বাবা আত্মহত্যা করেন। এই মর্মান্তিক ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরেই তিনি একোল পলিটেকনিকে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেন। এবারও ব্যর্থ হন। নিরুপায় হয়ে এবার তিনি গিয়ে ভর্তি হলেন একোল নরমালে। এ সময় তিনি থিওরি অব ইকুয়েশন নিয়ে করা তাঁর আগের কাজ নিয়ে আরও কিছু গবেষণা করে কশির আগের উপদেশমতো একটি পেপার লেখে পাঠান একাডেমি অব সায়েন্সে, গ্রাঁ প্রি পুরস্কারের জন্য। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা সত্ত্বেও গালোয়া তো পুরস্কার পেলেনই না, উপরন্তু তাঁর গবেষণাপত্রটিও হারিয়ে গেল। তারপরও ওই বছর গালোয়া তিনটা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তাঁর সেই তিনটা পেপার এখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়—একটি গালোয়া থিওরির গোড়াপত্তন নিয়ে, একটি সমীকরণের মূল সমাধান নিয়ে এবং আরেকটি সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে। গালোয়ার বয়স তখন মাত্র ১৮!

এ সময় প্যারিসের রাজনৈতিক আবহাওয়া তুঙ্গে পৌঁছেছে। ক্ষমতার টানাটানিতে রাজা দশম চার্লস ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় তুমুল উত্তেজনা। একোল পলিটেকনিকের ছাত্ররা যখন গণতন্ত্রের দাবিতে রাস্তা মাতাচ্ছে, তখন একোল নরমালের অধ্যক্ষ প্রধান দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলেন, যাতে ছাত্ররা রাস্তার উত্তেজনায় অংশ না নিতে পারে। এতে গালোয়া চূড়ান্তভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তিনি পাঁচিল ডিঙিয়ে রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টাও করেও পারলেন না। অধ্যক্ষের একটি লেখার তুমুল সমালোচনা করে নিজের নামে পত্রিকায় চিঠি লিখলেন গালোয়া। পত্রিকায় সেই চিঠির লেখকের নাম প্রকাশিত না হলেও গালোয়া একোল নরমাল থেকে বিতাড়িত হলেন।

ছাত্রাবস্থায় ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী হিসেবে গালোয়ার কাল্পনিক ছবি
ছাত্রাবস্থায় ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী হিসেবে গালোয়ার কাল্পনিক ছবি

পরিবারে বাবা নেই, পকেটে টাকা নেই—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত গালোয়া কিছুদিন উচ্চতর বীজগণিতের প্রাইভেট টিউটর হিসেবে টাকা আয়ের চেষ্টা করলেন। সোফি জার্মেইনের এক চিঠিতে গালোয়ার এ সময়কার মানসিক অবস্থা জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘(বন্ধুরা) বলছে, (গালোয়া) অচিরেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে। আমারও মনে হয় আশঙ্কাটা সত্যি।’ ব্যর্থ মনোরথ হয়ে পুরোদমে গণিত আর রাজনীতিতে গা ভাসালেন এভারিস্ত গালোয়া। সময়টা তখন ১৮৩১।
ক্ষুব্ধ, জেদি ও সব হারানোর ব্যথা নিয়ে গালোয়া যোগ দিলেন আর্টিলারি অব দ্য ন্যাশনাল গার্ড নামে এক সশস্ত্র গণতন্ত্রকামী দলে। এদের কারণে সরকারের পতন হতে পারে ভেবে গালোয়ার যোগ দেওয়ার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বাহিনীটি ভেঙে দেওয়া হয়। এ সময় গালোয়া তাঁর গণিতবিষয়ক গবেষণায় আবার খানিকটা ফেরত আসেন। কিন্তু অতি সক্রিয় রাজনৈতিক মন তাঁকে আবার সক্রিয় করে তোলে।
১৮৩১ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবস পালনের অনুষ্ঠানে মিছিলের অগ্রভাগে দেখা যায় এভারিস্ত গালোয়াকে। পরনে নিষিদ্ধঘোষিত ন্যাশনাল গার্ডের পোশাক, হাতে রাইফেল, একাধিক গুলিভরা পিস্তল আর কোমরে গোঁজা ছুরি। ফলে একদিন আবারও গ্রেপ্তার ও জেলে। জেলের কুঠুরিতে আবার চলল গণিতচর্চাও।
১৮৩২ সালে প্যারিসে কলেরার প্রাদুর্ভাব হলে জেলখানার অন্য কয়েদিসহ গালোয়াকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে আবাসিক ডাক্তারের মেয়ে স্তেফানির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এই সম্পর্ক থেকেই গালোয়াকে নামতে হয় এক ডুয়েল লড়াইয়ে। আর সেখানেই শেষ পর্যন্ত গালোয়া মারা যান। জেল থেকে মুক্তির মাত্র এক মাস পর তাঁর মৃত্যু হয়।
ঠিক কী কারণে ও কার সঙ্গে গালোয়ার এই ডুয়েল হয়েছিল, সেটা খুব স্পষ্ট নয়। এমন হতে পারে যে স্তেফানির কিছু সমস্যা হচ্ছিল। এসব সমস্যা তিনি গালোয়াকে পত্রমারফত জানিয়েছিলেন। ফলে অতি-উত্তেজিত গালোয়া নিজের কাঁধেই ডুয়েলের ভার গ্রহণ করে নেন। আবার ভগ্নপ্রেমও হতে পারে। যা হোক, ১৮৩২ সালের ৩০ মে সকালে পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গালোয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরদিন সকালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২০ বছর। ছোট ভাইকে বলা তাঁর শেষ কথাগুলো ছিল, ‘কাঁদিস না আলফ্রেড! মাত্র কুড়িতে মরতে বসার জন্য আমার খুব সাহসের দরকার আছে।’ ২ জুন তাঁকে সমাহিত করা হয়।

ডুয়েলজনিত সম্ভাব্য মৃত্যুচিন্তা গালোয়াকে এমনভাবে সচকিত করে রাখে যে মৃত্যুর আগের রাতে তিনি অনেকগুলো চিঠি ও গাণিতিক পাণ্ডুলিপি তৈরি করে রেখে যান। চিঠিগুলো ছিল তাঁর রিপাবলিকান বন্ধুদের কাছে লেখা। গণিতের পাণ্ডুলিপিটি তিনি লিখে যান তাঁর বন্ধু আউগুস্ত শোভালিয়ের জন্য। এতে তিনি তাঁর গণিত-সম্পর্কিত সব চিন্তাভাবনা লিখে রেখেছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল গণিত নিয়ে তিনটি প্রবন্ধও। চিঠি আকারে লেখা এই পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে বিখ্যাত গণিতবিদ হেরমান ভাইল লিখেছিলেন, ‘এই চিঠি, চিন্তার গভীরতা ও নতুনত্বের মাত্রা দিয়ে বিচার করলে বলা যায়, মানবসভ্যতার সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী লেখনীগুলোর অন্যতম।’

মাত্র ২০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণকারী এই ব্যতিক্রমী তরুণটির অবদান তাহলে কোথায়? গ্রুপ থিওরি বলে আধুনিক গণিতের যে শক্তিশালী শাখাটি আছে, কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের যে গাণিতিক উপকরণটির খুব বেশি দরকার হয়, সেই শাখার ভিত্তিমূল স্থাপন করেছিলেন এভারিস্ত গালোয়া। তাঁর দেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে গ্রুপ থিওরির শাখাটি বিকশিত হয়েছে। গালোয়া ছিলেন গ্রুপ থিওরির অন্যতম জনক। এ ছাড়া থিওরি অব ইকুয়েশন নিয়ে গালোয়া থিওরির ব্যাপারটাও তাঁরই অবদান। বহুপদী সমীকরণের বীজগাণিতিক সমাধান বিষয়ে এই থিওরিতে আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া উচ্চতর বিশ্লেষণী বীজগণিতে আবেলীয় ইন্টিগ্রাল ও অবিরত ভগ্নাংশ বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।

মৃত্যুর দুদিন আগে বন্ধু শোভালিয়েকে এক চিঠিতে গালোয়া লিখেছিলেন, ‘এসব উপপাদ্যের সত্যতা নয়, এগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে জেকোবি কিংবা গাউসকে জিজ্ঞেস কোরো তাঁদের মন্তব্য প্রকাশ্যে বলতে। আশা করি, ভবিষ্যতে কেউ না কেউ এই বিশৃঙ্খল লেখালেখি থেকে হয়তো প্রয়োজনীয় কোনো কিছুর সন্ধান পাবেন।’ এ কথা সত্যি, গালোয়ার ৬০-পাতার সমগ্র রচনাবলিতে আধুনিক গণিতের অনেক দিগন্ত উন্মোচনকারী আইডিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে।

ধন্য গালোয়ার কুড়ি বছরের জীবন—তাঁর উপপাদ্যগুলোর মতোই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ!

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী: শিক্ষক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়