রাস্তাফারিয়ান পপ আইকন

বব মারলে
বব মারলে

শহরমুখী গরিব মানুষের অভিজ্ঞতার মধ্যে কেন এবং কীভাবে লোকগানের অর্থ ও আদল পাল্টে যায়, এ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এই অতিসাধারণ বাংলা গানগুলোর গূঢ় অর্থ প্রায়ই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে গরিবের অভিবাসন-প্রক্রিয়া, ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে সরব ও নীরব লড়াই, বাউলিয়ানা ও বাউলগানের প্রথাবিরোধী চর্চার মধ্যে। এই কাঠামোর মধ্যেই একদিন বহুদূরের শিল্পী বব মারলেকে পুনরাবিষ্কার করি। তাঁর গানকে নতুনভাবে খুঁজে পাই তাঁর বেড়ে ওঠা, অভিবাসন, জ্যামাইকান রেগে মিউজিক আর রাস্তাফারিয়ান মতাদর্শের ভেতর।
জ্যামাইকার সেইন্ট অ্যান প্রদেশের পাহাড়ঘেরা গ্রাম নাইন মাইল। দরিদ্র অধ্যুষিত, বলাই বাহুল্য। সেখানে একটা ছোট্ট টিলার ওপর ছোট্ট একটা ঝুপড়ি ঘরে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে বব মারলে প্রথম দুনিয়ার আলো দেখেছিলেন, মা আর নানার কম্পিত বাহুর মধ্যে। পল এলুয়ারের ভাষায়, যেখানে জন্মালে কোনো লাভ হয় না। বাবা শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ কর্মচারী নরভাল মারলে ছিলেন তাঁর নানার সমবয়সী বন্ধু। ফলে এই অসম বয়সী বিয়ে যে ঔপনিবেশিক ক্ষমতাসম্পর্ক থেকে উদ্ভূত, সেটা বোঝার জন্য কসরত করতে হয় না। নরভাল মারলে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ ছিলেন, তবে এই সামান্য সংসারের খোরপোশটুকু তিনি ঠিকঠাক দিয়ে গেছেন মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত। মারা গেছেন ৭০ বছর বয়সে, তখন ববের বয়স মাত্র ১০।
এই ঔপনিবেশিক লিগ্যাসিসহ দুনিয়ার পথে চলতে শুরু করেন বব মারলে। স্কুলে তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধুরা তাঁকে ডাকত ‘সাদা বালক’। আর শ্বেতাঙ্গ দুনিয়ায় তিনি পরিচিত ‘কালা আদমি’ হিসেবে। ‘মারলে’ পদবিটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বাবা মারা যাওয়ার পর বব যখন ইংল্যান্ডে যান, তখন তিনি মারলে পরিবারের কাছে বহুবার ধরনা দিয়েছেন। পারিবারিক স্বীকৃতির জন্য, পাননি। না কালোদের দুনিয়ায়, না সাদাদের। দার্শনিক হোমি ভাবা এই দশাটুকুরই নাম দিয়েছেন ‘ইন-বিটুইননেস’ বা যে জন আছে মাঝখানে দশা। হোমি ভাবার মতে, যেকোনো নতুন সংস্কৃতির দিশা আসে এ রকমই একটা ‘ইন-বিটুইননেস’ থেকে। আর শুধু মাঝখানে থাকলেই হবে না। এই মাঝখানে থাকা ব্যক্তি বা কমিউনিটিকে হতে হবে ক্ষমতাহীন, যে/যারা একটি দাপুটে সাংস্কৃতিক শক্তির সঙ্গে লড়াই করবে। আর এটা প্রায়ই ঘটে, যখন এসব গরিব জনগোষ্ঠী জীবিকার টানে নিজেদের আবাস ছেড়ে নতুন জায়গায় যায়। পুরোনো সাংস্কৃতিক চর্চার ছেঁড়াখোঁড়া স্মৃতির সঙ্গে মিশ্রণ ঘটে নতুন দাপুটে সংস্কৃতির। ফলে এটা কেবলই দুটি সংস্কৃতির মিশেল নয়, দুটি সংস্কৃতির মধ্যে ক্ষমতার লড়াইও। এই লড়াইয়ের প্রান্তসীমার মধ্যেই ঘটে যায় অত্যাশ্চর্য নতুন ঘটনা। বব মারলের গান এমনই একটা ঘটনা।
বব মারলে কেন অত্যাশ্চর্য ঘটনা? কারণ, তাঁর দূতিয়ালিতে কালোদের গান সাদাদের সমাজে দাপটের সঙ্গে আসন গাড়তে পেরেছে। তিনি একদিকে যেমন পশ্চিমা রক আর পপের মধ্যে অফ বিট জ্যামাইকান রেগে, স্পা ইত্যাদি লোকছন্দের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে কালা আদমিদের ওপর ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক শোষণ-নিপীড়ন ও মুক্তির কথা বলতেও ছাড়েননি। সে আবার প্রভুদের কোলে বসেই। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এমনই এক মায়াবী প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন বব মারলে, তাঁর জীবদ্দশায়। তাঁর জীবনধারা, দর্শন, গান ও বিশ্ববীক্ষা সবকিছু মিলিয়ে।

লন্ডনে ক্রিস্টাল প্যালেস পার্কে নিজের ব্যান্ডদল দ্য ওয়েইলার্সের কনসার্টে বব মারলে
লন্ডনে ক্রিস্টাল প্যালেস পার্কে নিজের ব্যান্ডদল দ্য ওয়েইলার্সের কনসার্টে বব মারলে

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই গানের দিকে ঝুঁকে পড়েন বব। পূর্ণদৈর্ঘ্য সংগীত পরিবার তাঁদের, পরবর্তীকালে কোনো একটি সাক্ষাৎকারে মজা করে বলেছেন। সবাই গান করে, মামা-খালা-নানা, এমনকি বাড়ির কুকুরটা পর্যন্ত! পরে গ্রাম থেকে রাজধানী কিংস্টন শহরে চলে যান মায়ের সঙ্গে, সেখানকার স্কুলের সহপাঠীদের নিয়ে গানের দল তৈরি করেন। বিখ্যাত দ্য ওয়েইলার্স ব্যান্ড। বব মারলে, পিটার টশ, বানি ওয়েইলার এবং আরও কয়েকজন। গানের ব্যাপারে এই ত্রিরত্ন খুবই সিরিয়াস ছিলেন, বলাই বাহুল্য। একটা দৃষ্টান্ত না দিলেই নয়। তাঁরা স্কুলে পড়া বয়সেই রিহার্সাল করতেন মাঝ রাতে, কবরস্থানে। মঞ্চভীতি কাটানোর জন্য!

১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই ওয়েইলার্সের অ্যালবাম বেরোতে থাকে। একটি সে সময়ে জ্যামাইকার শীর্ষ তালিকায় এক নম্বরেও ছিল। কিন্তু বব মারলের দুনিয়াজোড়া পরিচিতি আসে ১৯৭৩ সালে ক্যাচ আ ফায়ার এবং বার্নিং শিরোনামের জোড়া অ্যালবাম প্রকাশের পরই। অ্যালবাম প্রকাশের প্রাক্কালে তাঁরা ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বেশ কিছু কনসার্ট করার সুযোগ পেয়ে যান, যার পরিপ্রেক্ষিতে দুটো অ্যালবামই বিলবোর্ড চার্টে স্থান পায়। রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের ‘দুনিয়া-সেরা ৫০০ অ্যালবাম’ তাঁদের জায়গা ওপরের দিকেই থাকে। বার্নিং অ্যালবামের বেশ কয়েকটি গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে।

>তিনি দেশলাই কাঠি, চারাগাছ, সিঁড়ি, লাল মোরগ, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি অব্যর্থ কিছু স্থায়ী প্রতীক সৃষ্টি করেছেন, যা খুব কম মার্ক্সবাদী কবিই পেরেছেন
জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টন শহরে বব মারলের ভাস্কর্য
জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টন শহরে বব মারলের ভাস্কর্য

বব লম্বা সময়ের জন্য যে বছর ইংল্যান্ডে চলে যান, সে বছরই বের হয় তাঁর বিখ্যাত অ্যালবাম এক্সোডাস। এক্সোডাস অর্থ হচ্ছে গণহিজরত। এই গানের লিরিকে বব যদিও রাস্তাফারিয়া ধর্মের রেফারেন্সে বাইবেল-বর্ণিত মানব চলাচলকে (সত্যের দিকে, ন্যায়ের দিকে) তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চলাচলটিও এই গানে গভীর দ্যোতনা তৈরি করে। তত দিনে বব মারলে রাস্তাফারিয়ান মতাদর্শে স্থায়ীভাবে দীক্ষিত হয়ে গিয়েছেন।
বব মারলের আত্মপরিচয়ের লড়াইটুকুকে বুঝতে হলে রাস্তাফারিয়া ধর্ম সম্পর্কে অবগত থাকা দরকার। বর্তমান পরিসরে এ নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। রাস্তাফারিয়া হলো আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের একটি সহজিয়া মতাদর্শ। লোকধর্ম। এই ধর্ম কালো মানুষদের খোদার পেয়ারা বান্দা হিসেবে প্রতিপন্ন করে। ইথিওপিয়ার তৎকালীন সম্রাট প্রথম সেলাসিকে রাস্তাফারিয়ানরা যিশুর পুনরুজ্জীবিত অবতার মনে করেন। রাস্তাফারিয়ানরা কালো মানুষদের মর্যাদা, মানুষের সমান অধিকার প্রভৃতি বিষয়ের পক্ষে অবস্থান নেয়। জটাচুল, গাঁজা বা ক্যানাবিস সেবন এবং রেগে মিউজিকের চর্চার মধ্য দিয়ে একজন রাস্তাফারিয়ান তাঁর ধর্ম পালন করে। বলা বাহুল্য, বব মারলে খুব নিয়মতান্ত্রিকভাবেই এই চর্চা করে গেছেন। এমনকি তাঁর গানের কথায়ও তিনি রাস্তাফারিয়া পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। যেমন রাস্তাফারিয়ান ভাষায় ‘আন্ডারস্ট্যান্ড’ না বলে ‘ওভারস্ট্যান্ড’ বলা হয়, যেহেতু বুঝবার মাধ্যমে কেউ আলোকিত হয়ে শ্রেয়তর অবস্থানে যায়। একইভাবে, ‘ডেডিকেশন’ না বলে ‘লিভিকেশন’ বলেন রাস্তাফারিয়ানরা, কারণ ডেডিকেশন (আত্মদান) ও মৃত্যু সমার্থক। ‘অপ্রেশন’ না বলে ‘ডাউনপ্রেশন’ বলেন, কারণ নির্যাতনের মাধ্যমে কাউকে ক্ষমতাহীন নিচু অবস্থানেই ঠেলে দেওয়া হয়। বব মারলের গানে এসব শব্দের বিস্তর প্রয়োগ খেয়াল করা যায়।
এখানেও মারলে সেই একই দ্বৈরথের মধ্যে। একদিকে তিনি রাস্তাফারিয়ান, কালো মানুষের আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিক সংগ্রামে শামিল, অন্যদিকে তিনি বাজারি সংস্কৃতির পপ আইকন। তত দিনে তিনি ব্রিটিশ জনমত জরিপে সর্বকালের সেরা গীতরচয়িতাদের তালিকায় তিন নম্বরে (বব ডিলান, জন লেননের পর পরই), রক এন রোল গানের হল অব ফেম তালিকায় তৃতীয় বিশ্ব থেকে জায়গা পাওয়া একমাত্র লোক তিনি। ব্রিটিশ মিউজিকের হল অব ফেমেও তিনি আছেন। হলিউডের হল অব ফেমেও তাঁকে পাওয়া যায়। গ্র্যামিতে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। বিবিসি তাঁর ‘ওয়ান লাভ’ গানটিকে শতাব্দীর সেরা গান নির্বাচিত করেছে, আবার টাইম সাময়িকীর বিচারে এক্সোডাস অ্যালবামটি বিশ শতকের সেরা অ্যালবাম। এমনকি ২০০৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন মৃত তারকাদের উপার্জনের যে শীর্ষ তালিকাটি করে, বব মারলে সেখানেও দ্বাদশ জায়গাটি ধরে রেখেছেন। মৃত্যুর ২৭ বছর পরও।
বব মারলের জীবনীতে তাঁর রাস্তাফারিয়া ধর্মের প্রতি অনুরাগের কথা অনেকটা পাদটীকার মতো উল্লিখিত হয়, বিশেষত পশ্চিমা লেখকদের জবানিতে। ভাবখানা এমন যে, ইনি একজন পপ গায়ক, জীবনের কোনো একটি পর্যায়ে খেয়ালবশত এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। আদতে ব্যাপারটি তা নয়। শুরু থেকেই তিনি রাস্তাফারিয়ান ছিলেন, বিশেষত যখন থেকে তিনি তাঁর খ্রিষ্টান মা থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন। তাঁর তারকাখ্যাতির বহু আগে। তাঁর জটাচুল, গানে বিভিন্ন অনুষঙ্গ, রাস্তাফারিয়া প্রফেট সেলাসির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি মিলিয়ে রাস্তাফারিয়া বব মারলের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। নিয়ামক তো বটেই।
কিন্তু আমাদের অভিধানে বব মারলে কেবলই গান। কালো আদমিদের নিয়ে তিনি কিছু চিৎকার-চেঁচামেচি করেছেন বটে, সে সময়টা কানে তুলা লাগিয়ে পরে ‘নো ওম্যান নো ক্রাই’ পর্বে খুলে দিলেই চলে! তাঁর মতাদর্শ কীভাবে তাঁর গানের ছন্দের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে, সেই খোঁজ হয়তো অনেকেরই রাখা হয় না। অবশ্য না রেখেও যে বব মারলেকে উপভোগ করা যায়, এটাও সংগীতশিল্পী হিসেবে বব মারলের উৎকর্ষের প্রমাণ। কিন্তু সেসবের খোঁজখবর রেখে আমরা যখন বব মারলেকে শুনি ও পাঠ করি, তখন তাঁর গান, তাঁর মতাদর্শ, তাঁর গায়ের রং, তাঁর আইকনিক তারকাখ্যাতি—সবকিছুর সাপেক্ষে বব মারলের সাংস্কৃতিক রাজনীতিটুকু আমরা বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, যে দ্বিধাটুকু তিনি জন্মগতভাবে পেয়েছিলেন, তাকে ‘ওয়ান লাভ’-এর ন্যারেটিভে একটি অভিন্ন দুনিয়ার স্বপ্ন দিয়ে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। এখানেই বব মারলে অন্য পপস্টারদের মতো হয়ে উঠতে পারেননি। অন্য রাস্তাফারিয়ানদের মতোও না। এই আত্মঘাতী দ্বিধাই তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। রবার্ট নেস্তা মারলে থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন বব মারলে। পিতৃসূত্রে যে উত্তরাধিকার বহন করে চলেছিলেন, তার স্বীকৃতি জীবদ্দশায় তিনি শ্বেতাঙ্গ মারলে পরিবার থেকে পাননি। কিন্তু চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য তাঁর সাদা কাজিনরা এবং তাঁদের বংশধরেরা ‘মারলে’ হওয়ার সুবিধা ষোলো আনাই ভোগ করেছেন, সে কেবল এই একখান পরিত্যক্ত পরিচয়হীন কালো মারলের বরাতে।

১৯৮১ সালে ক্যানসার-আক্রান্ত বব যখন মারা যান, তত দিনে তিনি প্রায় ৫০০ গান লিখে সুর করে ফেলেছেন। পৃথিবীর সব দেশেই তিনি ও তাঁর গান পরিচিত বস্তু। পশ্চিমা সংগীতধারায় র‍্যাপ আর রেগে মিউজিকের আধিপত্য পোক্ত হয়ে গিয়েছে। এমনকি বব মারলেকে হাজির করে জ্যামাইকান সরকার একটা ভয়াবহ রাজনৈতিক দাঙ্গার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। তত দিনে তিনি মোহাম্মদ আলী, চে গুয়েভারা কিংবা জেমস ব্রাউনের মতো তৃতীয় বিশ্বের আইকন হয়ে উঠেছেন। মাত্র ৩৬ বছরের একটা ছোট্ট কিন্তু তীব্র জীবনে।

সুমন রহমান: কবি, কথাসাহিত্যিক ও জনসংস্কৃতি বিশ্লেষক