বিন্দুতে সিন্ধুকল্লোল

সুকান্ত ভট্টাচার্য
সুকান্ত ভট্টাচার্য

সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬–৪৭) নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে তড়াক করে ওঠে দুটি কথা। একটি তাঁর একুশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন, আর অন্যটি তাঁর বড় মাপের কবিত্ব। নিঃসন্দেহে এ দুটি বিষয়ই সুকান্তকে সহজে চিনিয়ে দেয় এবং অন্যদের থেকে তাঁকে আলাদা করে দেয়। কিন্তু এই মূল্যায়নে সুকান্তের অনেকটাই বাইরে থেকে যায়; বাইরে থেকে যায় তাঁর কর্মিসত্তা, বিশ্বজনীন জীবনচেতনা আর জীবনকে যাপন করার ও দেখার এক ভিন্ন ইশারার কথা। এই লেখায় সুকান্তের কবিতার উদ্দেশে বলছি, ‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি।’ তাঁর গদ্যময় ‘কড়া হাতুড়ি’ তুল্য ‘মহাজীবন’ এবং এর প্রবণতা ও তাৎপর্যই মূলত এ লেখার উদ্দেশ্য।
অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেও কর্মের জন্য পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন, এমন কবির সংখ্যা বিশ্বসাহিত্যে একেবারে কম নয়। ক্রিস্টোফার মার্লো, বায়রন, শেলি, কিটস, রুপার্ট ব্রুক, র‍্যাঁবো, মায়াকভস্কি, ট্রাকল, লোরকা, এসেনিন, সিলভিয়া প্লাথ প্রমুখ কবি কমবেশি অপ্রত্যাশিত অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁদের কেউ বিশুদ্ধ কবি, কেউ কবি ও সৈনিক, কেউ কবি ও মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক কর্মী, আবার কেউ-বা কবি ও স্বদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন। তবে, উল্লিখিত অকালপ্রয়াত কবিদের মধ্যে একুশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন এমন কবি নেই।
সবচেয়ে কম বয়সে মারা গিয়েছেন এবং কবি ছিলেন—এ কারণেই কি সুকান্ত গুরুত্বপূর্ণ? তা নয়। এ দুটি বিষয়ের বাইরেই বরং সুকান্তের বিশেষত্ব। সুকান্ত জীবন ও জগৎকে যেভাবে দেখেছেন এবং যাপন করেছেন, ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের খুব কম অকালপ্রয়াত কবিই সেভাবে দেখেছেন বা করেছেন। তবে কি সুকান্তের নামও সারা পৃথিবীতে বিস্ময়ের সঙ্গে কীর্তিত ও উচ্চারিত হয়, যেমনটি হয় মার্লো, শেলি, কিটস বা অপরাপর কবির কথা! মনে হয় না। কারণটি তবে কি এই যে সুকান্তের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এক উপনিবেশিত ভূখণ্ড ও ভাষার মধ্যে? হতে পারে। এ প্রশ্নটি ঝুলিয়ে রেখে আমরা বরং দেখে নিতে চাই সুকান্তের ডোবাতুল্য জীবনের মধ্যে মহাসমুদ্রের কিছু কল্লোল আর জীবন-জগৎকে দেখার আর যাপনের সেই বিশেষত্বকে, যা তাঁকে এই সভ্যতার ভেতরে অনন্য করে তুলেছে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য সেই পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন, যে পরিবারে তাঁর ‘দিদিমা ভিখিরির ছেলেকেও কোলে তুলে নাক-মুখ পরিষ্কার করে দিতেন।’ (সুকান্তের শুরু, সুকান্ত পরিচয়, অশোক ভট্টাচার্য) এই পরিবারের ছেলে তাঁর বাল্যকালেই নিজের বাড়ির চওড়া বারান্দায় ছোট ছেলেদের পড়াবার জন্য বিনা পয়সার কোচিং ক্লাস খুলবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শুধু তা-ই নয়, সুকান্ত সে সময় তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কলকাতার বেলেঘাটায় স্টুডেন্ট্‌স্‌ লাইব্রেরি নামে একটি পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করেন। ১০-১১ বছর বয়সী ছেলেরা যখন খেলাধুলা নিয়ে থাকে, তখন তিনি লেখালেখি করে ভরিয়ে তুলতেন তাঁর খাতা। স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি সম্পাদনা করেন সপ্তমিকা নামে হাতে লেখা পত্রিকা।
সুকান্তের জীবনচেতনায় সবচেয়ে গুরুতর পরিবর্তন আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়। যুদ্ধের বিভীষিকা সুকান্তকে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশয়িত করে তুলেছিল। কলকাতায় সম্ভাব্য ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভেবে তাঁর ভাইয়েরা চলে যান মুর্শিদাবাদে। তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণাচলরা চলে যান যশোর। সবাই তাঁকে তাঁদের সঙ্গে শহর ছাড়তে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সুকান্ত কলকাতা না ছেড়ে যোগ দেন স্বেচ্ছাসেবক দলে; অন্যদের মতো স্লোগান তোলেন ‘জাপান এলে রুখতে হবে।’

 ১৯৪১ সালের দিকে সুকান্ত প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ১৯৪২ সালের দিকে। তাঁর সক্রিয়তার কথা বলতে গিয়ে সে সময়ের ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য সুকান্ত স্মৃতি, সুকান্ত বিচিত্রায় বলেছেন, কলকাতার আকাশে যখন ঘন ঘন জাপানি বোমারু বিমানের আনাগোনা, সে সময়ে নিষ্প্রদীপ, জনশূন্য, শব্দহীন বহু রাতের অন্ধকারে তিনি ও সুকান্ত পথে বেরিয়েছেন ‘কলকাতার প্রেতরূপ দেখবার জন্য।’ সুকান্ত কলকাতার বেলেঘাটার কমিউনিস্ট কর্মীদের আস্তানা ‘জনরক্ষা সমিতি’ কার্যালয়কে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার ও সাংগঠনিক কাজে এত বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন যে ক্রমে এমনকি বাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এই নিষ্ঠার কারণে ১৯৪৩ সালে সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করা অত সহজ ছিল না। সুকান্ত ছিলেন সে সময়কার কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে তরুণ সদস্য।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের হাতে লেখা কবিতা
সুকান্ত ভট্টাচার্যের হাতে লেখা কবিতা

সুকান্ত ‘ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’-এরও ছিলেন তরুণতম সদস্য। এই সংগঠনে থেকে তিনি শুধু ফ্যাসিবিরোধী কবিতাই লেখেননি, ‘অভিনয় করে গ্রামে গ্রামে ও শহরে ঘুরে বেড়াবার জন্য একাধিক প্রচারমূলক নাটিকা লিখে দিয়েছিলেন গণনাট্য সংঘকে। প্রাত্যহিক কাজ হিসেবে পার্টির পত্রিকা জনযুদ্ধ বিক্রি করেছেন নিয়মিত। আর, অশোক ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, কিছু দিন যখন নারকেলডাঙার জুটমিল শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছিলেন, তখন ফ্যাসিস্টবিরোধী পোস্টারও লিখেছেন বহু।’ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ আর একনিষ্ঠদের অন্যতম ছিলেন সুকান্ত। ‘কী কঠিন পরিশ্রম করতেন প্রত্যহ—কোন্ সকালে বেরিয়ে সূর্য পশ্চিমে কিছুটা হেলে পড়লে ক্লান্ত দেহ টেনে বাড়ী ফিরতেন তিনি। অথচ এর জন্যে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রাপ্য একটা চালের টিকিট সঙ্গে নিয়ে ফেরেননি কোন দিন। প্রয়োজন ছিল না এমন নয়। বরং পরিবারের দরকারে ঐ মহামূল্য বস্তুটি সংগ্রহ করতে প্রায় প্রাণপাত হতো তাঁরই ছোট ভায়েদের।’
১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ শিশুমনে যে দূষিত প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা থেকে শিশুদের কোমল সত্তাকে বাঁচানোর জন্য এবং সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার উপযোগী প্রজন্ম তৈরি করার জন্য তিনি নিজেকে ‘কিশোর বাহিনী’র সঙ্গে যুক্ত করেন। তাঁর অসাধারণ নিষ্ঠায় অল্প সময়ের মধ্যেই সংগঠনটির সদস্যসংখ্যা ৩০০ থেকে ৩০ হাজারে উন্নীত হয়। শুধু তা-ই নয়, কিশোর মনের পুষ্টির জন্য তিনি স্বাধীনতা পত্রিকার কিশোর সভার বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্বটিও নেন। ১৯৪৪ সালে বন্ধু অরুণাচলকে লেখা চিঠিতে সুকান্ত বলেছেন, ‘কয়েকটা কারণে আমার তোর ওখানে যাওয়া হল না। যেমন, (১) কিশোর বাহিনীর দুধের নতুন আন্দোলন শুরু হল। (১৪ই জুনের জনযুদ্ধ দ্রষ্টব্য।) (২) ১৫ই জুন A. I. S. F. Conf. (৩) কিশোর বাহিনীর কার্ড এখনো ছাপা হয়নি। ছাপাব। (৪) ১৩ই জুন I. P. T. A-এর অভিনয় শ্রীরঙ্গমে। (৫) ১১ই জুন কিশোর বাহিনীর জরুরী মিটিং। (৬) কিশোর বাহিনীর ৪ নং চিঠি এ সপ্তাহে লিখতে হবে। (৭) ১৬ই জুন আমাদের বাড়িতে বৌভাত। (৮) এখন আমার শরীর খারাপ।’ (সুকান্ত সমগ্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সম্পা. বদরুদ্দীন উমর)
এই ছিল সুকান্তের দিনলিপি, জীবনকে যাপন করার ধরন। চিঠির মধ্যে ব্যক্ত করা বিচিত্র কাজের সবই তো ‘পৃথিবীকে বাসযোগ্য’ করে তোলার প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত। ব্যক্তিগত ভোগ-উপভোগের পথে তিনি যাননি। তিনি পৃথিবীকে ফুলে-ফসলে ভরিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই যে কর্মযজ্ঞ, এটিই তো জীবন্ত কবিতা, মহাকাব্য। আলাদাভাবে কবিতার কি প্রয়োজন ছিল! আর তাঁর কবিতাই বা কোন জীবনাচেতনাকে ধারণ করেছে? সে তো তাঁর যাপিত জীবনেরই শব্দরূপ। যেমন: ‘এসেছে নতুন শিশু/তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে/চলে যেতে হবে আমাদের।/চলে যাব—/তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।/অবশেষে সব কাজ সেরে,/আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে/করে যাব আশীর্বাদ,/তারপর হব ইতিহাস।’ সুকান্তের কবিতার বিষয়, উদ্দেশ্য-আদর্শ সম্পর্কে আর কোনো আলোচনার সূত্রপাত না করে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে গণমুখী সাহিত্য তথা মার্ক্সবাদী সাহিত্যধারায় তিনি দেশলাই কাঠি, চারাগাছ, সিঁড়ি, লাল মোরগ, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি অব্যর্থ কিছু স্থায়ী প্রতীক সৃষ্টি করেছেন, যা খুব কম মার্ক্সবাদী কবিই পেরেছেন। আর বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কবিতা তো রীতিমতো ‘নন্দনতাত্ত্বিক বিপ্লব’।

পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবন মোটা দাগে আহার, নিদ্রা, যৌনতা, ব্যক্তিগত ভোগ-উপভোগের মধ্যেই আবর্তিত হয়। জন্মের পর থেকে এসব কর্মকাণ্ডের শেষে একদিন মৃত্যুতে সমর্পিত হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মরণের ব্যতিক্রম ছাড়া বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়াই এই জীবনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কিছু মানুষ সব সময়ই থাকেন যাঁরা জীবনকে শুধু নির্দিষ্ট জৈব প্রবৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তাঁদের কেউ কেউ এলাকার পর এলাকাজুড়ে গাছ লাগান কিন্তু মালিকানা দাবি করেন না। মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি বাড়ি মানুষকে পড়ার জন্য বই দিয়ে বেড়ান, কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক আশা করেন না। কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই নিরন্নের জন্য অন্ন ভিক্ষা করে বেড়ান, কুষ্ঠরোগীর সেবা করেন। কী অদ্ভুত এই মানুষেরা!

কিছু মানুষ অবিশ্বাস্য স্বল্পায়ু হয়েও পৃথিবীর মানুষ ও সভ্যতার স্মৃতিতে জাগ্রত থাকেন; ইতিহাস হয়েও তাঁরা জ্বলতে থাকেন বর্তমানে ও আগামীতে। সুকান্ত ভট্টাচার্য এই শেষোক্ত ঘরানার মানুষ। তিনি মনে করতেন, ‘আবার পৃথিবীতে বসন্ত আসবে, গাছে ফুল ফুটবে। শুধু তখন থাকব না আমি, থাকবে না আমার ক্ষীণতম পরিচয়। তবু তো জীবন দিয়ে এক নতুনকে সার্থক করে গেলাম!...এই আমার আজকের সান্ত্বনা।’

কুদরত-ই-হুদা: প্রাবন্ধিক