নতুন গাড়ির বাজার আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে

>

শোয়েব আহমেদ
শোয়েব আহমেদ

একসময় পুরোনো গাড়ির প্রতি ঝোঁক থাকলেও অনেক ক্রেতাই এখন নতুন গাড়ি কিনছেন। যদিও সংখ্যায় পুরোনো গাড়ির চেয়ে এখনো নতুন গাড়ির আমদানি ও বিক্রি দুটোই অনেক কম। দেশে নতুন গাড়ির বাজার, দাম কমানোর উপায়, দেশের গাড়ি সংযোজনের সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে গত মঙ্গলবার কথা বলেছেন র‍্যাংগস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শোয়েব আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

প্রথম আলো: পুরোনো গাড়ির ব্যবসায়ীরা প্রায় সময়ই দাবি করেন, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ও আবহাওয়ায় রিকন্ডিশন্ড বা পুরোনো গাড়িই বেশি টেকসই। তাহলে মানুষ কেন বেশি দামে নতুন গাড়ি কিনবে?

শোয়েব আহমেদ: দেশের রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি ও আবহাওয়া দিয়ে নতুন ও পুরোনো গাড়ির ভালো-মন্দ বিচার করা যাবে না। প্রতিটি গাড়ির একটি জীবনকাল থাকে। আপনি গাড়ি যত চালাবেন, তত সেটির মূল্য কমতে থাকবে। ধরুন, আপনি পাঁচ বছরের পুরোনো একটি গাড়ি কিনলেন। তার মানে, গাড়িটির জীবনকালের (লাইফ সাইকেল) থেকে বড় একটা সময় চলে গেছে। নতুন গাড়ির জীবনকাল যেহেতু এখন থেকে, অর্থাৎ জিরো মাইলেজ দিয়ে শুরু হচ্ছে, সে জন্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, গাড়িটি কমপক্ষে ১০ বছর চালাতে পারবেন। আর যে গাড়ি ইতিমধ্যেই পাঁচ বছরের পুরোনো, সেটি কোনোভাবেই এত বছর ঠিকঠাক সেবা দিতে পারবে না। অন্যদিকে আমরা সেসব গাড়িই আমদানি করি, যেগুলো মূলত রপ্তানির জন্যই তৈরি হয়। আমরা ব্যবসায়ীরা দেশের রাস্তাঘাট, আবহাওয়া ও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী গাড়ি উৎপাদনকারী কোম্পানিকে ক্রয়াদেশ দিই। সে অনুযায়ী কোম্পানিগুলো আমাদের গাড়ি সরবরাহ করে। আর আমাদের দেশে যেসব রিকন্ডিশন্ড বা পুরোনো গাড়ি আসে, সেগুলো কিন্তু নিজের দেশে ব্যবহারের জন্যই তৈরি করে কোম্পানিগুলো। ফলে তফাতটা সহজেই বুঝতে পারছেন। এ ছাড়া আমরা এখন আগের চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যেই নতুন গাড়ি বিক্রি করছি। এক বা দুই বছরের পুরোনো গাড়ি আর নতুন গাড়ির দাম প্রায় একই। নতুন গাড়ি কিনলে ক্রেতাদের বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়া হয়। গাড়ির ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও পুরোনো গাড়ি কিনলে এই সুবিধা পান না ক্রেতারা।

প্রথম আলো: ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছরই নতুন গাড়ি আমদানি ধীরে ধীরে বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ১ হাজার ৭৯৪টি নতুন গাড়ি আমদানি হয়ে এসেছে। নতুন গাড়ির বাজার কি বাড়ছে?

শোয়েব আহমেদ: গাড়ির ক্রেতাদের মধ্যে একটা বড় অংশই নতুন প্রজন্মের। তারা অনেক বেশি শিক্ষিত। বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের আগে তারা সঠিকভাবে বিচার-বিবেচনা করে। তারা জানে, নতুন গাড়ি চালানোর যে ফিলিংস (অনুভূতি), সেটি কিন্তু পুরোনো গাড়িতে পাওয়া যায় না। তবে এখনো নতুন প্যাসেঞ্জার (যাত্রী) কারের চেয়ে বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি বেশি হয়। প্যাসেঞ্জার কারের ক্ষেত্রে এককালীন বিনিয়োগ একটু বেশি। তবে বাণিজ্যিক গাড়ি অধিকাংশই কিস্তিতে বিক্রি হয়। আর অর্থনীতির যত উন্নতি হয়, বাণিজ্যিক গাড়ির চাহিদা তত বাড়ে। ফলে আমি মনে করি, সব মিলিয়েই নতুন গাড়ির বাজার আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।

প্রথম আলো: নতুন গাড়ির উচ্চমূল্যের কারণে অনেক ক্রেতাই ইচ্ছা থাকলেও কিনতে পারেন না। মূল্য কমানোর কোনো উপায় কি আছে?

শোয়েব আহমেদ: দেশের ভেতর গাড়ি উৎপাদন কিংবা যন্ত্রাংশ আমদানি করে তা সংযোজন করতে পারলে নতুন গাড়ির দাম সহজে কমানো যায়। তবে গাড়ি উৎপাদনে যাওয়ার মতো অবস্থায় আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি। এ জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও চাহিদা কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। তবে গাড়ি সংযোজন করার মতো সক্ষমতা আমাদের আছে। সরকারের সহযোগিতায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় গাড়ি সংযোজন করা হচ্ছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে উদ্যোক্তারা গাড়ি সংযোজন কারখানা করতে এগিয়ে আসবেন। অবশ্য এ জন্য বড় বিনিয়োগের পাশাপাশি চাহিদাও থাকা জরুরি। অন্যদিকে সরকার যদি গাড়ি আমদানিতে কর কমায়, তবে দাম কমানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকার ও ক্রেতা উভয়েই উপকৃত হবেন।

প্রথম আলো: গাড়ির ব্যবসায় সচরাচর কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন আপনারা?

শোয়েব আহমেদ: গাড়ি কিনতে একসঙ্গে অনেক টাকা বিনিয়োগ করতে হয় ক্রেতাদের। এ জন্য ইকুইটি ও ঋণের অনুপাতের পাশাপাশি ব্যাংকঋণের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। তাহলে আরও বেশিসংখ্যক ক্রেতা গাড়ি কিনতে পারতেন। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি বুঝে পেতে আমাদের প্রচুর সময় ব্যয় হয়। এ জন্য খরচ বেড়ে যায়। আবার গাড়ির শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই জটিলতা হয়। গাড়ির ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন জ্বালানি তেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেলের মান খারাপ হলে গাড়ির জীবনকাল কমে যাবে। তা ছাড়া তেলের মান যত ভালো হবে, দূষণ তত কম হবে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় তেলের মান একেক রকম। এ ছাড়া গাড়ি ব্যবসার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা দরকার। তবে বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী রাস্তা কম। এটি যত বাড়বে, ব্যবসা তত গতিশীল হবে।

প্রথম আলো: ঢাকা শহরের যানজট দিনকে দিন মারাত্মক আকার নিচ্ছে। আর এ জন্য সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির অত্যধিক সংখ্যাকেই দোষারোপ করেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা। তাহলে গাড়ি ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী?

শোয়েব আহমেদ: ঢাকা শহরে চার-পাঁচ লেনের রাস্তা আছে। যানজটের কারণে গাড়ির ব্যবসা হবে না, এটা ঠিক নয়। একটি মেগাসিটি যত গাড়ি নিতে পারে, ঢাকা শহরে তত গাড়ি নেই। রাস্তাঘাটসহ অন্য অবকাঠামোর উন্নয়ন কম হওয়ার কারণেই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেশি মনে হয়। শহরের অধিকাংশ জায়গাতেই পার্কিং নেই। একটা জায়গায় যাওয়ার জন্য দুটির বেশি পথ নেই। তা ছাড়া আমাদের মানুষ ট্রাফিক সিস্টেম মানে না। গাড়ির ওপর দোষ দিয়ে যানজট কমানো যাবে না। এমনটি হলে তো গাড়ির উৎপাদনই কমিয়ে দিত সারা বিশ্বের কোম্পানিগুলো। আমি মনে করি, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারলেই যানজট কমানো সম্ভব। গণপরিবহনের সংখ্যা ও মান বাড়ানো খুব দরকার। তা ছাড়া মেট্রোরেল চালু হলে যানজট কমে আসবে।