মোটরসাইকেলের বাজারে সুদিন ফিরছে

.
.

ঢাকার যানজট ঠেলে দ্রুত কোথাও পৌঁছাতে কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভর করেন। আবার মফস্বল শহর বা গ্রামগঞ্জে সামাজিক মর্যাদা ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বাহনটির গুরুত্বও অনেক। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের চাহিদার কারণে প্রতিবছরই মোটরসাইকেলের বিক্রি আগের বছরের তুলনায় বেশি হয়।
কিন্তু ২০১৪-১৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাজারের স্বাভাবিক এ চিত্রটিতে আনে ছন্দপতন। মোটরসাইকেল ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নিবন্ধনহীন মোটরসাইকেল চলাচলে পুলিশের কড়াকড়ির কারণে বাহনটির বিক্রি সে সময় অনেকটাই কমে যায়। তবে গেল দুই বছরের মন্দা কাটিয়ে এ বছর মোটরসাইকেলের বিক্রি আবার বাড়তে শুরু করেছে। মোটরসাইকেল উৎপাদক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, পরিবেশকসহ খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএএমএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত বছরে আড়াই থেকে তিন লাখ ইউনিট মোটরসাইকেল বিক্রি হতো। সেটি ২০১৫ সালে কমে ১ লাখ ৮০ হাজারে নেমে আসে। এ বছর বিক্রি আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে সংগঠনটি।

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের বাজারের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা মোটরসাইকেল দিয়ে। আর বাকিটা পূরণ হয় দেশে উৎপাদিত অথবা সংযোজিত মোটরসাইকেলের মাধ্যমে। আমদানি করা মোটরসাইকেলের ৮০ শতাংশ বাজাজ, টিভিএস, হিরো, মাহিন্দ্রার মতো ভারতীয় ব্র্যান্ডের দখলে রয়েছে। আবার হোন্ডা, সুজুকি, ইয়ামাহার মতো জাপানি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাজার ধরতে ভারতেই কারখানা করে মোটরসাইকেল তৈরি করছে। এ দুটি কারণে বাংলাদেশের বাজারে ভারতে তৈরি মোটরসাইকেলের প্রাধান্য বেশি বলে জানা গেছে। দেশে রানার, যমুনা গ্রুপ, গ্রামীণ মোটরস নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে মোটরসাইকেল তৈরি করছে।

বাজারে বিক্রিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ভারতের বাজাজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান উত্তরা মোটরস বাজাজের মোটরসাইকেল বাংলাদেশে আমদানি ও বাজারজাত করে। শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাজারের ডিসকভার ও পালসার ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বেশ জনপ্রিয়।

জানতে চাইলে উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজাজের সবচেয়ে বড় গুণ হলো পাঁচ বছর চালানোর পরও যে দামে এটি বিক্রি করা যায়, সেটি অন্য কোনো ব্র্যান্ডে পাওয়া সম্ভব নয়। দেশের আনাচকানাচে সব জায়গায় বাজাজের বিক্রেতা, পরিবেশক ও সেবাকেন্দ্র আছে। আমাদের যন্ত্রাংশও বাজারে খুব সহজলভ্য। এসব কারণেই বাজাজ গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছে।’

উত্তরা মোটরস এবার বাজারে নিয়ে এসেছে ‘বাজাজ ভি’ মোটরসাইকেল। একাত্তরের উত্তাল ডিসেম্বরে সপ্তম নৌবহর যখন বঙ্গোপসাগরে ধেয়ে আসছিল, তখন ভারতীয় রণতরি ভিক্রান্ত জলসীমার পাহারায় ছিল। সেই ইতিহাসকে স্মরণ করেই রণতরি ভিক্রান্তের ধাতব দিয়ে বানানো হয়েছে বাজাজ ভি। ২০১২ সাল পর্যন্ত এটি মুম্বাইয়ের সামুদ্রিক জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল। পরে ২০১৪ সালে এই যুদ্ধজাহাজ ভেঙে ফেললে তখনই এর ধাতু দিয়ে বাজাজ ভি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় মোটরবাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাজাজ। রণতরিটির মাস্তুল ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

দেশে গত পাঁচ বছরে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভারতের আরকেটি ব্র্যান্ড টিভিএস। দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী সনি-র‌্যাংগস গ্রুপ ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশে টিভিএসের মোটরসাইকেল বাজারজাত করছে। টিভিএস অটো বাংলাদেশ নামে যৌথ অংশীদারি একটি যন্ত্রাংশ সংযোজন কারখানাও রয়েছে তাদের। টিভিএসের বিপণন ব্যবস্থাপক আশরাফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ১৫০ সিসি ইঞ্জিন ক্ষমতার অ্যাপাচি ও ১০০ সিসি ক্ষমতার টিভিএস মেট্রো মডেলের মোটরসাইকেল দুটির বিক্রি সবচেয়ে বেশি। কম তেলে বেশি পথ চলার সুবিধা ও দেখতে স্মার্ট হওয়ায় টিভিএস বাজারে দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে।

২০০৬ সাল থেকে নিজস্ব কারখানায় মোটরসাইকেল তৈরি করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান রানার অটোমোবাইলস। ৫০ সিসি থেকে ১৫০ সিসি পর্যন্ত ইঞ্জিনক্ষমতার মোটরসাইকেল তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে সবচেয়ে বেশি চলে রানারের ৮০ থেকে ১০০ সিসির মোটরসাইকেলগুলো। সাশ্রয়ী মূল্য ও ভালো মানের কারণে দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে রানারের মোটরসাইকেল বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার গোস্বামী।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জাপানের সুজুকি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাজারজাত করছে র‌্যাংগস গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান র‌্যানকন মোটরস। তরুণ প্রজন্মের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে ১৫৫ সিসির সুজুকি জিক্সার ব্র্যান্ডের বেশ কয়েকটি মডেলের মোটরসাইকেল বাজারে এনেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ১১০ সিসির হায়াতে মোটরসাইকেলও আছে সুজুকির।

র‌্যানকন মোটরসের বিপণন ব্যবস্থাপক শাফাত ইশতিয়াক বলেন, ‘সব শ্রেণির মানুষের চাহিদা মেটাতে সুজুকির মোটরসাইকেল বাজারে রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ২০২০ সালের মধ্যে মোটরসাইকেলের ১ নম্বর ব্র্যান্ড হওয়া।’

বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিবন্ধন খরচসহ দেশের বাজারে দাম এখনো বেশি হওয়ায় অনেকের ইচ্ছা থাকলেও মোটরসাইকেল কেনা সম্ভব হয় না। বিএমএএমএর সভাপতি মতিউর রহমান এ বিষয়ে বলেন, দাম কমিয়ে আনতে হলে দেশে উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। তবে কারখানা স্থাপন করতে হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোসহ সরকারের সহযোগিতা দরকার। একই সঙ্গে সহযোগী শিল্প ও দক্ষ জনবল তৈরিতেও গুরুত্ব দিতে হবে।