খুদে কুশান আর বড়দিন

.
.

কুশানের সঙ্গে ক্রিসমাসের আগের পথে বেরিয়েছি। উন্মত্ত-অধীর মানুষ সব পথে পথে ছুটছে। এই একটা মৌসুম, যখন কালোরা আরও কালো, সাদারা আরও সাদা এবং বাদামিরা না কালো, না সাদা হয়ে রাস্তায় চরে বেড়ায় (কে মোরে ফিরাবে অনাদরে, কে মোরে ডাকিবে কাছে...)। রাস্তাগুলো সেজে উঠেছে টুনিবাতিতে আর মোড়গুলো ক্রিসমাস ট্রিতে। আমাদের ইস্টিশনের সামনে একটি মলিন ক্রিসমাস ট্রি রেখে গিয়েছিল কাউন্সিলের লোকে—সেটাতে কোনো আলোকসজ্জা করা হয়নি বলে দুঃখ করছিলাম আমরা মায়ে-পোয়ে। আমাদের অবাক করে দিয়ে, খুশি করে দিয়ে সেটাতে আলোর ঝালর টাঙিয়ে দিয়ে গেছে কাল, চকচকে ব’বল আর মগডালে বেথেলহেমের তারা। এমনিতে সেন্ট্রাল লন্ডনের পথঘাট সেজে ওঠে নভেম্বর থেকেই। আমরা রুটি খেতে না পেলে কেকও খাওয়ার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব রাখি না (পূর্ব লন্ডন) বলে, আমাদের ক্রিসমাস ট্রি অনেক দিন অসজ্জিত থাকে, রাস্তাগুলো ভুতুড়ে আর বিনষ্ট হয়ে থাকে হলুদ আলোয়।
প্রতিবছর কুশান এক বছর করে বড় হয়, প্রতিবছর সে আমাকে নিয়ম করে প্রশ্ন করে ডিসেম্বর মাসে, ‘মেমে, ক্রিসমাসে কি সবাই আনন্দ করে?’
-করে তো। অনেকেই করে। আবার অনেকেই করে না, তারা ক্রিসমাসের দিন দোকান খোলা রাখে। অবশ্য আমার রুমানীয় ছাত্রীরা বলে ক্রিসমাসে তারা ‘সারমালে’ (বাঁধাকপির দোলমা) রাঁধে— ইংলিশ ক্রিসমাসের হাবিজাবি রাঁধে না। ক্রিসমাসের আমোদে যোগ দেয় হিন্দু-মুসলিম-খ্রীস্টান নির্বিশেষে বাঙালি পরিবারগুলিও, আস্ত পাখির রোস্টে যায় তন্দুরের মশলা, রোস্টেড পটেটোতে যায় সামান্য হলুদ।
কুশানদের স্কুলে নেটিভিটি শো থাকে প্রতিবছর। দুই বছর আগে কুশান নার্সারিতে থাকতে সমবেত পরিমণ্ডলীর একটি সাজতো। গায়ে সাদাজামা, তাতে চিকমিকে জরির ছাপ আর দুই হাতে টিনসেলের চুড়ি। সব কটা বাচ্চা যখন চেঁচাত, ‘মেরি মেরি মেরি/ ইউ উইল হ্যাভ আ বেবি/ জেসাস জেসাস/ উইল বি হিজ নেইম...’ আমার হঠাৎ অসম্ভব কান্না পেত। কী আনন্দধ্বনি করেই না শিশু পৃথিবীতে আসে—সব কটি শিশুর জন্যই নিশ্চয়ই সোনালি তারা ধকধক করে। সব শিশুর আগমনবার্তাই জ্ঞানীদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ধরা দেয়। আসন্ন প্রসবাকে মানুষ গোয়াল দেখিয়ে দিলে কী হয়, কতই না সমাদরে, কত না উত্তাপে সমগ্র প্রাণিকুল তাকে ঘিরে আছে— কী না, মানুষ জন্মাচ্ছে। মানুষের সেই ‘আনন্দম আনন্দম আনন্দম’ শিশুকে যারা মেরে ফেলতে পারে, তার চেয়ে ঘৃণিত আর কে আছে?
যা হোক, সেই যিশুও নেই, সেই মর্মবাণীও নেই। একালের যিশু সুনীলাক্ষ এবং স্বর্ণকেশী, তাঁর আগমণের মূল সুর ‘মুনাফাহি কেবলম’, বছরের সেরা কেনাকাটার সময় এটা। সন্ধ্যাবেলা শপিং সেরে ক্লান্ত হয়ে খেতে বসলাম আমরা। আলো জ্বলা রাস্তা, সস্তা মুরগি ভাজা আর আলু ভাজার গন্ধে ভেপে আছে সন্ধ্যার বাতাস। একটা মেয়ের দাঁত নড়ে উঠেছে মুরগি খেতে গিয়ে, টিস্যু চেপে ধরে রক্ত দেখেই সে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিল। নিথর মুরগি অম্লানবদনে পড়ে আছে সামনে।
বাসে ফেরার পথে দেখতে পেলাম, এক ক্লান্ত বুড়ো বাসি খবরের কাগজে মেরি স্টোপসের খোলা ডাস্টবিনে ভ্রুণ ফেলে দেওয়ার কেলেঙ্কারির গল্প পড়ছে। জগৎজুড়ে আদরণীয় কুমারীর পুত্র জন্মাতে আর দিন বাকি নেই।
আমার চোখ বিক্ষিপ্ত এবং সুদূর হবার আগেই কুশান তার নিয়মিত প্রশ্ন আবার করে, “আমাদের বাড়িতেও কি ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হবে? সান্টাক্লজ কি এবারও মিল্ক অ্যান্ড কুকি খেতে আসবে?”
কুশানের ক্রিসমাস ট্রির দৈর্ঘ্য তার নিজের সমানই। সেটাতে সে নিজ হাতে ঝোলায় ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের রঙিন বল, জরি আর ছোট্ট ছোট্ট পুতুল। ক্রিসমাসট্রির মাথার তারাটাও কার্ডবোর্ডে সে নিজে এঁকে ফয়েল মুড়ে বানিয়েছে।
ক্রিসমাস আত্তীকরণের প্রক্রিয়া চলছে তার ভিতরে এখনো। ইস্কুলই তাকে প্রথম সচেতন করে দিয়েছিল বন্ধুবান্ধবের বিচিত্র সব পরিচিতির ব্যাপারে। ঈশ্বরই তাকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করেন। কারণ ক্রিসমাসের মৌসুমে টিভি ভরে ওঠে বিপদাপন্ন শিশুদের কান্নাভেজা মুখে আর মানুষের আর্তিতে। ঈশ্বর চাইলেই এদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারতেন; কিন্তু করেননি। সেটাকে তার শিশুমাথায় ‘লীলা’ হিসেবে ঢোকানো যায় না।
রাতে আমরা জড়াজড়ি করে শুয়ে সারা দিনকার সুতো গুটিয়ে আনছি—আমি কুশানকে শোনাচ্ছি হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘দেশলাই-বেচুনি মেয়ে’র গল্প। বরফের চাদরে ঢেকে গেছে পৃথিবী, তার ভেতর উষ্ণতার সন্ধানে একের পর এক দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে চলেছে ছোট্ট মেয়েটি। ‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে’, তাদের নাম ‘দরিদ্র’, মেয়েটি সেই জাতের। তার সুখস্বপ্ন আপেল-ঠাসা আস্ত হাঁসের রোস্টের সমান বড়। ছেলের চোখ ছলছল করছে বলে গল্প থামাতে হয়। আমরা শিস বাজিয়ে গাই ‘ডেক দ্য হল্স’, মনে মনে বলি ‘সর্বে ভবন্তু সুখিন’। সরু করে আড়বাঁশিতে কে ফুঁ দেয় আমার প্রাণে, কত কাল আগের সেই শীতকাল যখন খেজুরগাছে উঠে বেথেলহেমের তারা টাঙাত পরিমল গোমেজদা, পাতলা ঘুড়ি বানানোর কাগজে বাঁশের চাঁচি দিয়ে বানানো তারা, তার ভেতরে জ্বলছে আলো। ছোট্ট চ্যাপেল সাজানো হয়েছে। বাতাস ভরে আছে গুড়ের সেদ্ধপুলি আর প্লামকেকের গাঢ় সুবাসে। ছোট্টবেলার মিশনারি স্কুলের প্রাঙ্গণে শীতের উজ্জ্বল দেবদারুসারি, জোনাকিতে উজ্জ্বল, মানস সরোবর থেকে আলোর পথ বেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস এসে পৌঁছানোর খবর যখন প্রাণে এসে বাজত।
লেখক: গল্পকার