শান্তিরাজের আগমনের দিন

চেক প্রজাতন্ত্রের ওবেক জেলার লে​েকাটাইস গ্রামের যিশু কোলে মা মেরির ভাস্কর্য l ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
চেক প্রজাতন্ত্রের ওবেক জেলার লে​েকাটাইস গ্রামের যিশু কোলে মা মেরির ভাস্কর্য l ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

শুভ বড়দিন। ভয়-নির্ভয় ও অভয়ের বাস্তবতার মধ্যে ত্রাণকর্তা যিশুখ্রিষ্টের জন্মোৎসব পালন করছেন গোটা পৃথিবীর খ্রিষ্টবিশ্বাসী সমাজের সঙ্গে বাংলাদেশের খ্রিষ্টবিশ্বাসী ভাইবোনেরা। যিশু এই পৃথিবীতে এসেছেন শান্তিরাজ হয়ে শান্তি দিতে। প্রবক্তার মুখে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছিল যে যাঁর জন্ম হবে, তাঁর নাম হবে অনন্য মন্ত্রণাদাতা, শান্তিরাজ (ইসাইয়া ৯: ৫)। বিশেষভাবে এ বছর দেশ ও দশের সার্বিক সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রী, মিলন ও ভ্রাতৃত্ব কামনা করে শান্তিরাজ যিশুর জন্মোৎসব শুভ বড়দিন পালন করা হচ্ছে। এই উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হচ্ছে বড়দিনের আড়ম্বরপূর্ণ ধর্মীয় উপাসনালয়ে।
এই পৃথিবীতে যিশুর আগমন মানবজাতির মুক্তি সাধন, কেননা পাপের ফলে মানুষ তো ঈশ্বরের দেওয়া সুখ নষ্ট করে ফেলেছিল। কিন্তু ঈশ্বর তো তাঁর সৃষ্ট মানুষকে ভুলে যেতে পারেন না। যিশুর এই পৃথিবীতে মানুষ হয়ে আসার একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো মানুষের সঙ্গে মিলন ও একাত্মতা, মানুষের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি তথা সব যুগের সব মানুষের সার্বিক মুক্তি।
পবিত্র বাইবেলে প্রবক্তারা বলেছেন, যিশু দ্বারা আনীত এই রাজ্যে ধর্মনিষ্ঠ মানুষ বাস করবে এবং শান্তি সেখানে থাকবে চিরকাল।
সময় যখন পূর্ণ হলো, তখন পূর্ণ হলো এই প্রতিশ্রুতি। সাধু পলের পত্রে পাই: সময় যখন পূর্ণ হলো, তখন ঈশ্বর এই পৃথিবীতে পাঠালেন তাঁর আপন পুত্রকে; তিনি জন্ম নিলেন নারীগর্ভে...(গালাতীয় ৪: ৪)। যিশুর জন্মের সময় স্বর্গদূত বাহিনী গেয়ে উঠেছিল: জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়! ইহলোকে নামুক শান্তি তাঁর অনুগৃহীত মানবের অন্তরে। (লুক ২: ১৪)।

পাঞ্জোরা গির্জা, কালিগঞ্জ, ঢাকা l ছবি: প্রথম আলো
পাঞ্জোরা গির্জা, কালিগঞ্জ, ঢাকা l ছবি: প্রথম আলো

যিশুর জন্মের পর প্রকাশ্য জীবনে আমরা দেখি, যেখানে অন্ধ হয়ে মানুষ অশান্তিতে অসহায় অবস্থায় আছে, সেখানেই সুস্থতার দ্বারা সেই ব্যক্তিকে শান্তি দান করছেন। যেখানে বহু বছর ধরে রোগে-শোকে ভুগছে, সেখানে সুস্থতা দান করছেন। অনাহারীদের আহার দিয়ে শক্তি সঞ্চার করছেন। পাপী বলে ঘৃণিত ব্যক্তির অন্তরে শান্তি থাকতে পারে না। যিশু এই মানুষগুলোকে আত্মার প্রেমে কাছে টেনে নিয়েছেন। স্বর্গে যাওয়ার আগে শিষ্যদের তিনি বলেছিলেন: তোমাদের জন্য শান্তি রেখে যাচ্ছি, তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি আমারই শান্তি। অবশ্য এ সংসার যেভাবে শান্তি দেয়, সেভাবে আমি তোমাদের তা দিয়ে যাচ্ছি না। তোমরা যদি শান্তিতে বসবাস করো, তবে নিশ্চিত জেনো, তোমাদের সঙ্গে আমি আছি। (যোহন ১৪: ২৭)।
বড়দিনে আমরা স্মরণ করি যিশুর জন্ম, উৎসব করি যিশুর এই জন্মবার্ষিকীতে। তবে এই উৎসবের আহ্বান শান্তি ও সম্প্রীতির মানুষ হওয়া, শান্তির সমাজ গড়ে তোলা।
যদি আমরা নিত্যদিনের পৃথিবীর দিকে তাকাই, তখন দেখি অন্যন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শান্তি-সম্প্রীতি, নিরাপত্তা, সামাজিক ন্যায়, ভ্রাতৃত্ব—এমন সব মূল্যবোধ ভীষণ প্রয়োজন। এই টক-মিষ্টি-ঝাল নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষ এগিয়ে চলছে, এবারের বড়দিনে একটি বাণী সবার কাছে: সন্ত্রাস নয়, শান্তি-সম্প্রীতি।
যুগ যুগ ধরেই এই বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সংলাপ-সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করে আসছে। তার আলোকে এই স্লোগানও প্রাসঙ্গিক ও অর্থপূর্ণ: ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সবাই মিলে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব নিয়ে বড়দিন উৎসব পালন করুক, এটিই কাম্য। আসুন আমরা এই বড়দিনে শান্তির চর্চা করি, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হই। তাহলেই বড়দিন শুধু খ্রিষ্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর সার্বজনীন আমেজ ও শান্তির বাণী ছড়িয়ে যাবে সবার অন্তরে। শান্তিরাজ যিশুর শান্তি ঝরে পড়ুক আমাদের সবার ওপর সবার অন্তরে।
লেখক: ধর্মযাজক ও আহ্বায়ক, আন্তধর্মীয় সংলাপ কমিশন, রাজশাহী কাথলিক ধর্মপ্রদেশ।