যদি ভুলে যাওয়া যেত!

ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ চালায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরঁায়। ছবি: আবদুস সালাম
ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ চালায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরঁায়। ছবি: আবদুস সালাম

যদি কেউ জানতে চান কোন একটি ঘটনা ২০১৬-এর স্মারকচিহ্ন হয়ে থাকবে? তাহলে সম্ভবত জবাবে কোনো দ্বিমত হবে না। তবে সেই জবাবটি অত্যন্ত বেদনার। এ বছরের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে যাওয়া দেশের নৃশংসতম জঙ্গি হামলা আমাদের চমকে দিয়েছে, বদলে গেছে বাংলাদেশ।

গত কয়েকটি বছরে যেখানে মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল রাজনৈতিক বিভাজন এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উভয় পক্ষের অনমনীয়তা থেকে সৃষ্ট সহিংসতা, সেখানে এখন প্রধান দুশ্চিন্তা ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। হামলার লক্ষ্য বেছে নেওয়া, হামলার কৌশল ও হামলাকারীদের বৈশিষ্ট্য—এই তিন ক্ষেত্রেই বছরজুড়ে নতুন নতুন বিস্ময়ের জন্ম হয়েছে। এক বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই নতুন বিস্ময়। ধর্মীয় জঙ্গিবাদীদের প্রথম লক্ষ্য ছিল বিদেশি নাগরিক, ভিন্নধর্মাবলম্বী—প্রধানত ধর্মপ্রচারক-পুরোহিত, পাদরি কিংবা শিয়া ইমাম। তাঁদের সবাই ছিলেন নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন অবস্থানে। এরপরের লক্ষ্য হলো বিদেশিদের সমাগম ঘটে এমন জায়গা—হলি আর্টিজান। কিন্তু বিদেশিদের সুরক্ষাই যখন নিরাপত্তা বাহিনীর অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে উঠল, তখনই হামলার লক্ষ্য হলো ঈদের নামাজ, তাও আবার দেশের বৃহত্তম জামাত—শোলাকিয়া। হামলার কৌশলেও দেখা গেল বৈচিত্র্য। দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে গলা কাটা থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। আর ধর্মীয় জঙ্গিবাদে এখন সর্বসাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে নারী-শিশুদের ব্যবহার। নারী জঙ্গি যেমন আত্মঘাতী হচ্ছেন, তেমনি শিশুরা, এমনকি আপন সন্তানও ব্যবহৃত হচ্ছে ঢাল হিসেবে। দেশে-বিদেশে প্রচলিত ধারণা ছিল ধর্মীয় উগ্রবাদের চারণভূমি হচ্ছে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও অশিক্ষা। তাই সন্দেহের কেন্দ্রে ছিল মাদ্রাসা ও সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী। কিন্তু সেসব প্রথাগত ধারণা ভেঙে দিয়েছে এ বছরের ঘটনাগুলো। প্রাচুর্য আর আধুনিক শিক্ষায় গড়ে ওঠা একদল তরুণ-তরুণীর দিগ্‌ভ্রান্তি কত চরম রূপ নিতে পারে, তারই নতুন নতুন নজির স্থাপিত হয়ে চলেছে। তবে, তরুণ ও নারীদের ধর্মীয় জঙ্গিবাদের পথে পা বাড়ানোর উদ্বেগজনক চিত্রই বাংলাদেশ নয়। এর বিপরীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো তরুণ ফারাজ আইয়াজ হোসেনের সাহস ও আত্মদান পেয়েছে বিশ্বস্বীকৃতি।

ধর্মীয় জঙ্গিবাদের এই আকস্মিক ধাক্কা নিরাপত্তা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। এমনিতেই দেশের রাজনীতি ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির আর লেশমাত্র অবকাশ নেই। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ক্রমেই আরও বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের কাছে আইনের চেয়েও ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত ও দলীয় ইচ্ছার প্রতিপালনই এখন অগ্রাধিকারের বিষয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনসত্তা প্রতিষ্ঠা বাধার মুখে পড়ায় দ্বৈতশাসনের এক অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে। আইনের শাসন রূপায়ণের বিষয়ে বিতর্কের সহসা অবসান ঘটার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। রাজনীতিতে ভিন্নমত ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও সংকোচনের হুমকিতে পড়েছে। গুম, অপহরণ, অন্তর্ধান, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ এবং তার অস্বীকৃতি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। একদিকে উগ্রবাদীদের হুমকি, অন্যদিকে সরকারের নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপের বাড়াবাড়ি ও জবাবদিহির অভাব। এক অন্তহীন চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা।

গত ২০ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশের শাসন পরিস্থিতি ২০১৬’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশের সময় মৃদুভাষী প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য দিয়ে সুশাসনের অবস্থা তুলে ধরার সুবিধা হলো, তাতে নিরাপদে থাকা যায়। আপাতত এর চেয়ে বস্তুনিষ্ঠ সালতামামি আর কিছুই হতে পারে না।

দেশের হালহকিকত এবং ভূত-ভবিষ্যৎ বিষয়ে সরকারের ভাষ্যই তাই এখন শেষ কথা। তা সে হোক উন্নয়ন প্রকল্প কিংবা নাগরিক অধিকারের বিষয়। যেটুকু সমালোচনা বা বিরোধিতা তার অগ্রভাগে আছে সুশীল সমাজ বা নাগরিক গোষ্ঠী। সুন্দরবন বাঁচাও, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন কিংবা গুম-খুনের প্রতিবাদ—সবক্ষেত্রেই এই হলো বাস্তবতা। কিন্তু নাগরিক গোষ্ঠী নাগরিকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ে সক্ষম কি না, সেই প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৬ সালও ব্যতিক্রম নয়। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকারীরা সুন্দরবন অভিমুখে জনযাত্রা কিংবা ঢাকায় জাতীয় সমাবেশ আয়োজনের সময় পুলিশ ও সরকার-সমর্থকদের হামলা ও ভয়ভীতিতে এখনো পিছুটান দেননি। অবশ্য তাঁরা মাঠে সরব থাকলেও তাঁদের প্রত্যাশা পূরণের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার আভাস মিলছে না।

নাগরিক গোষ্ঠী বলতে সাধারণভাবে যাদের বোঝানো হয়, সেই সব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওর জন্য ২০১৬ কেটেছে অনেকটাই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়। তাদের দেশি-বিদেশি অর্থায়নের বিষয়ে নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপের পদক্ষেপ যেমন এসেছে, তেমনই তাদের মতপ্রকাশের পরিধিই ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। সংসদের মতো ‘জাতীয় প্রতিষ্ঠানের’ অবমাননা হয়—এমন অভিমত প্রকাশ করলে সেই এনজিওর নিবন্ধন বাতিলের বিধান করা হয়েছে। অনেকেই একে ‘কালো আইন’ বলে অভিহিত করেছেন। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী বর্তমান সংসদকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালায়’ পরিণত করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর ওই আইনটি তৈরি হলো।

রাজনীতিতে ভিন্নমত এখন প্রায় নির্বাসনে। সংসদে তো নয়ই, রাজপথেও তেমন কোনো বিরোধিতা গেল এক বছরে ছিল না। আর হ্যাঁ, দোষটা অবশ্যই বিএনপির। সরকার, মানে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সবাই বলে বিএনপি তিন বছর আগে যে ভুল করেছে, তার মাশুল দিচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তারা রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। সংসদীয় রাজনীতির বাইরেও যে তারা খুব একটা ভূমিকা রাখছে, তা নয়। রাজনৈতিক হঠকারিতার মূল্য দিতে গিয়ে গত তিন বছরে তাদের মাঠপর্যায়ের কয়েক ডজন নেতা-কর্মী গুমের শিকার অথবা নিহত হয়েছেন। আর মামলা-গ্রেপ্তারের সংখ্যাও কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সাহস করে যেসব নেতা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন করে সফল হয়েছেন, তাঁদেরও অনেকের ঠাঁই হয়েছে কারাগারে এবং তাঁরা তাঁদের পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন। সুতরাং নিরাপদে থাকার জন্য সরকারের বিরোধিতায় মাঠে নামার সাহস হারিয়ে তাঁরা এখন অনেকটাই নিস্তেজ। তবে, সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো তাঁরাই, অন্য কোনো বিকল্পের সন্ধান মেলেনি।

বছর শেষে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের একটি অংশ মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কিছুটা ফুঁসে উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা মিলিয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল ও সরকারের ওপর পোশাকশিল্পের মালিকদের ক্রমেই বাড়তে থাকা প্রভাবের নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। একদিকে পুলিশের ধরপাকড়, অন্যদিকে সরকারের সমর্থনের জোরে তাঁরা অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের কোণঠাসা করতে সক্ষম হন। তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে থাকার কারণে মজুরি বৃদ্ধির দাবি কত দিন উপেক্ষা করা সম্ভব হবে, সেটা বলা দুষ্কর। শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে পরিবহন খাতের দাপট যথারীতি বজায় থেকেছে। পরিবহন খাতে সড়ক ও নৌপথের শ্রমিকেরা বিভিন্ন সময়ে যাত্রীদের জিম্মি করে তাঁদের দাবি আদায় করে নিয়েছেন। পরিবহন খাতের শ্রমিক আন্দোলনে অবশ্য সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভূমিকা বহুল আলোচিত।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ভর্তি ও টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের পর গত বছর পুরোটা সময়েই শিক্ষাঙ্গনের কোথাও এ ধরনের আন্দোলন দেখা যায়নি। তবে তার মানে এই নয় যে শিক্ষাঙ্গন পুরোপুরি শান্ত ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ডজনখানেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাধিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব ঘটনার একটিতেও সরকারবিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠন জড়িত ছিল না। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের পদচারণ প্রায় বিস্মৃত হতে চলেছে। ছাত্রলীগের উপদলীয় কোন্দলের কেন্দ্রে আছে টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার। বছর শেষে ২৫ ডিসেম্বর তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দলাদলিতে একজনের মৃত্যুর পর কোন্দল মেটাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ভর্ৎ​সনা করেছেন। ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের কোনো সবুজ সংকেত না মেলায় অন্যান্য ছাত্রসংগঠনেরও চাঙা হওয়ার কোনো কারণ ঘটবে না বলেই মনে হয়।

গত কয়েক বছরের মতোই ২০১৬ সালেও সরকারের অগ্রাধিকার ছিল দুটি: উন্নয়ন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার। সেই তুলনায় দেশ পরিচালনায় সুশাসন, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ধারায় সাধারণ মানুষের মন জয় করার কৌশল শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে তা যে শুধু অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত বিজয় পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই যে একটা অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সেই কথাটাও আমাদের মনে রাখা দরকার।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক