বড় দান, বড় আহ্বান!

যিশুর জন্মসংবাদ শুনে প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী তাঁকে দর্শন করতে যাচ্ছেন
যিশুর জন্মসংবাদ শুনে প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী তাঁকে দর্শন করতে যাচ্ছেন

৩৯১ খ্রিষ্টাব্দের কোনো একদিন। রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের এক সন্ন্যাসী। নাম টেলেমাখুস। প্রাত্যহিক ধ্যান-প্রার্থনায় মগ্ন তিনি। হঠাৎ অলৌকিক এক দর্শন পেলেন। দর্শনে যিশুখ্রিষ্ট তাঁকে বলে গেলেন, ‘টেলেমাখুস, তুমি শিগগির রোমের দিকে রওনা হও। সেখানে তোমার জন্য একটা কাজ রয়েছে।’ প্রার্থনা শেষে টেলেমাখুস হেঁটে চললেন রোমের দিকে। রোমের রাজপথ আজ লোকে লোকারণ্য। পথ চলতে চলতে টেলেমাখুস জানতে পারলেন, নগরের কলসিয়ামে আজ গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ আছে। ওই যুদ্ধের শেষ পরিণতি যে কী বীভৎস, টেলেমাখুস তা অনেকবার শুনেছেন। তিনি জানতেন, সম্রাটের ইঙ্গিতে কী নৃশংসভাবেই না বিজয়ী যোদ্ধা তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করে; আর তা দেখে কলসিয়ামের দর্শকেরা পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে। টেলেমাখুসের বুঝতে দেরি হলো না, রোমে কোন কাজটি আজ তাঁকে করতে হবে।

হাজার হাজার রোমবাসী কলসিয়ামে উপস্থিত হয়ে অপেক্ষায় রয়েছে সেই যুদ্ধ দেখার জন্য। ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার লোক আজ সেখানে উপস্থিত। এ পর্যন্ত কেউ সেই বিকৃত রুচির পৈশাচিক খেলার বিরুদ্ধে সক্রিয় কোনো প্রতিবাদ জানাতে সাহস করেনি। ‘হ্যাঁ, আমিই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাব। জীবন দিয়ে হলেও আমি তা করব’—মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করতে করতে ভিড়ের মধ্যে স্থান করে নিলেন টেলেমাখুস। সময়মতোই শুরু হলো যুদ্ধ। কিছুক্ষণ পরে দুই যোদ্ধার একজন মাটিতে পড়ে গেল। এবার প্রথামাফিক সম্রাটের নির্দেশ পেয়ে বিজয়ী যোদ্ধা পরাজিতকে হত্যা করার জন্য উদ্যত। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্য থেকে বের হয়ে এলেন টেলেমাখুস। জোরে ডেকে বললেন, ‘তোমার তরবারি রাখো।’ কিন্তু গ্যালারি থেকে কিছু দর্শক টেলেমাখুসকে দেখিয়ে তাদের বিজয়ী বীরের প্রতি চিৎকার করে বলল, ‘আগে ওকে শেষ করো! সম্পূর্ণ দুই ভাগ করে ফেলো ওর শরীরটা!’ মুহূর্তের ভেতর টেলেমাখুসের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, তাঁর তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল জায়গাটা। ক্ষণিকের মধ্যে দেখা গেল অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। পিনপতন এক নীরবতায় ছেয়ে গেল কলসিয়াম। গভীর এক আত্মধিক্কার ও লজ্জায় একেক করে আসন ছেড়ে বের হয়ে গেল সব দর্শক। ইতিহাস বলে, ওই ঘটনার পর সম্রাট অনরিয়ুস আইন করে বন্ধ করে দেন রোমের সেই পৈশাচিক যুদ্ধ খেলা। এক বর্বরতার বিরুদ্ধে টেলেমাখুস সেদিন সরব ও সক্রিয় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, আর মানুষের সমাজে এনেছিলেন বড় এক ইতিবাচক পরিবর্তন। সমাজের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন তিনি দিয়েছিলেন। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় দান।
হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে বড়দিন তাই আমাদের জন্য ঈশ্বরের বড় দান। কিন্তু এই দানের একটা আহ্বান হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চ্যালেঞ্জ। খ্রিষ্ট মানুষকে দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের সব ধরনের অমানুষিকতার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন; যেমন তিনি যুগে যুগে অন্যায় ও অধর্মের বিরুদ্ধে করেছেন টেলেমাখুসের মতো অনেকের মধ্য দিয়ে। যিশুখ্রিষ্ট আচারসর্বস্ব ধর্মকর্ম ও সব ধরনের ভণ্ডামি ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর কাছে মানুষের জীবনই ছিল প্রথম ও শেষ বিষয়।
খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস এই, ঈশ্বর মানুষকে তার আদি ও আসল অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পবিত্র আত্মার শক্তিতে মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন। মানুষ সেই পবিত্র আত্মার প্রভাবে তার পাপ স্বভাবের ওপরে জয়লাভ করে নতুন মানুষ হতে পারে। খ্রিষ্ট তাঁর কথা ও কাজে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পদমর্যাদাভেদে সব মানুষকে সমান চোখে দেখেছেন। পথের ভিখারি থেকে রাজপ্রাসাদের মানুষ পর্যন্ত তাঁর আশীর্বাদে গতানুগতিক জীবন থেকে নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছে। সব মানুষের মধ্যে তিনি দেখেছেন স্রষ্টার প্রতিমূর্তি ও সাদৃশ্য। যেখানেই মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, সেখানেই সেই প্রতিমূর্তি হয় চূর্ণবিচূর্ণ। তা সে যে কারণেই হোক, ধর্মের নামে হোক, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও গোত্রীয় বা যেকোনো কারণেই হোক, অন্যের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মহৎ চেতনা মানুষের এক বড় অনন্য গুণ।
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজ তাদের ন্যায্য মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মতাদর্শের পার্থক্য, আর্থসামাজিক, জাতি ও বর্ণগত বিভিন্নতার কারণে মানুষে মানুষে কতই না দ্বন্দ্ব-বিভেদ! সাধারণ মানুষের জীবন আজ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পর্যবসিত। শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কতই না সম্মেলন ও কাগুজে চুক্তি হচ্ছে। তবু স্থায়ী শান্তির আশা যে বড় দুরাশা। ক্ষমতা ও বিত্তবান যাঁরা, তাঁদের হাতে বেশির ভাগ মানুষের জীবন জিম্মি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রতিদিন আমরা পাই, তাতে আমরা আশাহত হই, আঁতকে ওঠে সাধারণ মানুষের প্রাণ। অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে হত্যা, নির্যাতন, সন্ত্রাস ইত্যাদি শত শত অন্যায় ও অধর্মে আমাদের সমাজদেহ জর্জরিত। পৃথিবীতে রয়েছে কতই না ধর্মমত ও ধর্মশিক্ষা। তার পরও মানুষের যেন শান্তি নেই। আমাদের ঘৃণার জন্যযথেষ্ঠ বিশ্বাস আছে, কিন্তু ভালোবাসার জন্যতা অপ্রতুল।
সব ধর্মেই নিঃস্বার্থ প্রেম, ন্যায় ও শান্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের পরিবর্তন যদি না হয়, তাহলে ধর্মের বুলিতে কোনো লাভ নেই। ধর্মের সূক্ষ্ম ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসন ও শোষণের স্বার্থে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা এই যে দুর্বলের ওপর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগ করেই সবল মানুষের বড় শান্তি ও তৃপ্তি। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মোহে যুগে যুগে মানুষ যে কত অমানবিক ও অন্যায় আচরণ করতে পারে, তার উদাহরণে ভরা মানবেতিহাস। মহাকবি মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ কবিতায় শয়তানের কথায় ওই সত্য ব্যক্ত হয়েছে যে স্বর্গের নোকর হওয়ার চেয়ে নরকের রাজা হওয়াই শ্রেয়।
প্রতিবছর বড়দিন ফিরে আসে। আমাদের মধ্যে যদি ঐশ অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারি, তাহলে আমাদের এই পৃথিবী আবশ্যই পরিবর্তিত ও নতুন হতে পারে।
রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী: ধর্মতাত্ত্বিক।