একুশের ছবি তোলা

ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রায় ৭০ বছর আগে, ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চ তারিখটি রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে পালিত হয়ে আসছিল। ওই সময়কালের মধ্যে আন্দোলনকারীরা পরিষদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং সচিবালয় ঘেরাও করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল। ওই আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ এবং পাইকারি গ্রেপ্তার আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বাধ্য হয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করতে। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব ঢাকা সফরে এসে সাফ জানিয়ে দেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং এর বিরোধিতাকারীরা রাষ্ট্রের দুশমন। ছাত্রসমাজ জিন্নাহ সাহেবের ওই বক্তব্যের সামনাসামনি প্রতিবাদ জানালেও কোনো কাজ হয়নি। ভাষা আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছিল। ভাষা আন্দোলনের ওই পর্বের কয়েকটি মাত্র ছবি তুলেছিলেন তকীউল্লাহ।

প্রতিবাদ দিবসে ঢাকার নবাবপুর রোডে পেশাজীবীদের শোভাযাত্রা, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
প্রতিবাদ দিবসে ঢাকার নবাবপুর রোডে পেশাজীবীদের শোভাযাত্রা, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

১৯৪৮-৪৯ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিনগুলোতে। যখন আবার খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ইন্তেকাল করেছেন। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে পুনরায় ঘোষণা দেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। মরা গাঙে বান ডেকে উঠল। শুরু হলো বাংলা ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব, যা ’৫২ থেকে ’৫৫ সাল পর্যন্ত চলেছিল। ’৫৬ সালে পাকিস্তান সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। তবে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক স্বৈরাচার ক্ষমতা দখল করলে ’৫৬ সালে সংবিধান এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি বাতিল হয়ে যায়।

শহীদদের স্মরণে গা​েয়বানা জানাজার পর জনতার শোভাযাত্রা, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
শহীদদের স্মরণে গা​েয়বানা জানাজার পর জনতার শোভাযাত্রা, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

১৯৫১-৫৫ সাল পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ফলে ’৫২ থেকে ’৫৫ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ওই সময় আমার নিত্যসঙ্গী ছিল জার্মানির তৈরি ‘ভয়েগল্যান্ডার’ ফোল্ডিং ক্যামেরাটি। এই ক্যামেরাতে ছিল ৩ দশমিক ৫ কালার স্কোপার লেন্স। এই ক্যামেরায় একবারে আটটি মাত্র ছবি তোলা যেত। যেহেতু ক্যামেরাটি স্বয়ংক্রিয় ছিল না, সে জন্য প্রতিটি ছবি তোলার আগে লেন্স এবং দূরত্ব হাতে ধরে ঠিক করে নিতে হতো। তবে ওই সময় অপর একজন নামকরা ফটোগ্রাফার ছিলেন আমানুল হক। তাঁর কাছে ছিল একটি স্বয়ংক্রিয় ‘জাইস আইকন’ জার্মান ক্যামেরা। তিনি আলোচ্য সময়ের অনেক ঐতিহাসিক ছবি তুলেছিলেন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিনের মাথার খুলি উড়ে যাওয়ার বীভৎস ছবিটি তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা পাকিস্তানি নির্মমতার প্রথম ঐতিহাসিক দলিল। ভাষা আন্দোলনের ওই একটি মাত্র ছবির জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের রাষ্ট্রভাষা-সম্পর্কিত ঘোষণার পরপরই ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো কলা ভবন এবং মেডিকেল কলেজের হোস্টেল ব্যারাকগুলোতে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, আহ্বায়ক নির্বাচিত হন আবদুল মতিন। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে কলা ভবন আমতলায় প্রথম ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় ৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায়, গাজীউল হকের সভাপতিত্বে। এই সভাতেই ১০ বা ১১ তারিখে পতাকা দিবস পালন, শহরময় বিক্ষোভ মিছিল এবং একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের (ভেঙে-পড়া জগন্নাথ হল মিলনায়তনের) বাজেট অধিবেশনে বাংলা ভাষার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আমি ৪ ফেব্রুয়ারি এবং পতাকা দিবসের প্রতিবাদ সভা ও ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণের বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। বস্তুত, ১৯৫২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় পুরো মাস ঢাকা নগরী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুখরিত ছিল। ১ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলনের ওপর কোনো পুলিশি হামলা হয়নি। ’৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে আমরা পুরোনো কলা ভবনের মধুর স্টলে বসে শুনলাম ঘোড়ার গাড়িতে করে মাইক্রোফোনে একুশে ফেব্রুয়ারি বা রাষ্ট্রভাষা দিবসে সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রভৃতি নিষিদ্ধ করে নুরুল আমিন সরকারের ১৪৪ ধারা জারি করার ঘোষণা। সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লাম। কলা ভবন প্রাঙ্গণ আমাদের স্লোগানে জেগে উঠল—‘এক শ চুয়াল্লিশ ধারা মানি না, মানব না’। আমতলায় আবার সভা বসল, সিদ্ধান্ত হলো পরের দিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় ছাত্রসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না। সভা শেষে আবার বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে অংশ নেয়। ওই দিন সন্ধ্যার পর নবাবপুর রোডে আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা বসে আবুল হাসিমের সভাপতিত্বে। সভায় ছাত্র প্রতিনিধিরা একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে আর রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, বেলা ১১টায় কলা ভবন প্রাঙ্গণের আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক সভা। বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সিংহদ্বার তালাবদ্ধ। কলা ভবন সম্পূর্ণরূপে সশস্ত্র পুলিশ পরিবেষ্টিত। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা পুরোনো রেললাইনসংলগ্ন কলা ভবনের দেয়াল টপকে সকাল থেকে কলা ভবন প্রাঙ্গণে সমবেত হচ্ছিল। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভা শুরু হলে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আবেদন জানান।

ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারতের জন্য আগত জনতার ঢল, ৫ মার্চ ১৯৫২
ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারতের জন্য আগত জনতার ঢল, ৫ মার্চ ১৯৫২

ছাত্রসমাজের পক্ষে আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, শোভাযাত্রা এবং প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি পেশের প্রস্তাব করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। সঙ্গে সঙ্গে ১০ জন করে ছাত্রদের অসংখ্য এবং ছাত্রীদের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয় সিংহদ্বার অতিক্রম করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ এবং মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। চলতে থাকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ ও গণগ্রেপ্তার। ছাত্রীদের দলটিও এই বর্বরতার শিকার হয়েছিল।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার ‘ভয়েগল্যান্ডার’ ফোল্ডিং ক্যামেরাটি। তাতে ছিল এক রোল ফিল্ম, যাতে আটটি ছবি তোলা যায়। এ ছাড়া আমার পকেটে ছিল আরও এক রোল ফিল্ম। কলা ভবন প্রাঙ্গণে সভা শুরু হলে আমি তার ছবি তুলি কিন্তু ওই সভা এতটাই জনাকীর্ণ ছিল যে এ প্রাঙ্গণ থেকে আর ছবি তোলা যাচ্ছিল না। আমি কলা ভবনের ছাদে ওঠার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি ছিল না, ছিল একটি মাত্র ফোকর। আমার কয়েকজন বন্ধু ওই ফোকর দিয়ে ঠেলে আমাকে ছাদে উঠিয়ে দিল। রৌদ্রোজ্জ্বল ফাল্গুন মাসের দুপুরে আমি কলা ভবনের ছাদ থেকে আমতলায় ছাত্রসভা এবং সভা শেষে ছাত্রছাত্রীদের শোভাযাত্রাসহযোগে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য সিংহদ্বার অভিমুখে বেশ কিছু চিত্র গ্রহণ করলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট হাউসের অপর দিকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ বা গ্রেপ্তারের দৃশ্য আমি কলা ভবনের দোতলার ছাদ থেকে দেখতে বা ছবি তুলতে পারছিলাম না। ফলে আমি নিচে নেমে এলাম। আমার ফিল্মও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। ছাদের ওপরে আমি বহু কষ্টে এক রোল ফিল্ম খুলে আর এক রোল ভরেছিলাম। ভাগ্য ভালো যে প্রচণ্ড রোদে ছবিগুলো নষ্ট হয়ে যায়নি।

ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পুরোনো কলা ভবন ও মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। রণক্ষেত্র তখন মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ (যেখানে ছিল অনেক শেড), মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণ (যেখানে ছিল সারি সারি মুলি বাঁশের ব্যারাক) পর্যন্ত প্রসারিত। ছাত্র-জনতার লক্ষ্য জগন্নাথ হল মিলনায়তনের অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিকে যাওয়া। ঢাকার জেলা প্রশাসক কোরেশী, ঢাকার জেলা পুলিশ সুপার ইদ্রিস এবং ঢাকা সিটি পুলিশ সুপার মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের কোনায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিলেন। বাজেট অধিবেশনে যোগদানের জন্য যেসব পরিষদ সদস্য পরিষদ ভবনে যেতে চাইছিলেন, তাঁদের অনুরোধ করে মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে এনে পুলিশি হামলায় আহত শত শত ছাত্র-জনতাকে দেখানো হচ্ছিল। এই সময় একুশে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেট দিয়ে ঢুকে কিছু সশস্ত্র পুলিশ সমবেত ছাত্র-জনতার দিকে অনেকক্ষণ ধরে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ হয়ে রফিকউদ্দিন প্রাণ হারান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র আবুল বরকত তলপেট ও ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হন এবং সে রাতেই অপারেশন থিয়েটারে মারা যান। এ ছাড়া সালাম, জব্বারসহ অনেকে গুলিবিদ্ধ হন। গুলি চলার সময় আমি মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে থাকলেও ছবি তুলতে পারিনি। কারণ, তখন আমার ক্যামেরার ফিল্ম শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবে যখন হোস্টেল প্রাঙ্গণে সশস্ত্র পুলিশকে গুলিবর্ষণ করতে দেখলাম, তখন আমি দ্রুত হোস্টেল প্রাঙ্গণ ছেড়ে মেডিকেল কলেজ ভবনের মাঝখানের প্রবেশপথে অবস্থান নিলাম। সেখানে আমার দেখা হয় আলোকচিত্র শিল্পী আমানুল হকের সঙ্গে। তাঁর ব্যাগে ক্যামেরা, ফিল্ম, ফ্লাশগান, ক্লাশ বাল্ব—সবকিছুই ছিল। যখন আমার তাঁর সঙ্গে দেখা হলো, তখনই মেডিকেলের ওয়ার্ডবয়রা অ্যাম্বুলেন্সে করে মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ একজনকে স্ট্রেচারে করে নামাল। আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম, গুলিতে একটি মানুষের মাথার খুলি উড়ে গেছে, সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে ও ঘিলু গড়িয়ে পড়ছে। অতি দ্রুত তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা পেছন পেছন গিয়েও আর তাকে দেখতে পেলাম না। এমন সময় সরকারি তথ্য দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিশিষ্ট সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস আমাদের কাছে এসে ইশারায় তাঁর সঙ্গে যেতে বললেন। তিনি আমাদের ইমার্জেন্সির পেছনে একটি অন্ধকার ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে মাথায় গুলিবিদ্ধ ওই লাশটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। আমানুল হক ঝটপট তাঁর ক্যামেরায় ফ্ল্যাশগান ও বাল্ব লাগিয়ে স্ট্রেচারের ওপরে রাখা লাশটির মাথার একটি ছবি তুলে নিলেন। ওই লাশ ছিল একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিনের।

রফিকুল ইসলাম: ভাষাসংগ্রামী; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ঢাকা।