একুশের ক্ষণে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীদের শোভাযাত্রা, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীদের শোভাযাত্রা, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

এই যে আবার একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে লেখার ফরমাশ এল, তা থেকে মনে পড়ল যে কলকাতার অনেক লেখককে আমি প্রমাদ গুনতে দেখেছি। তাঁদের কথা এ রকম: পুজো তো এসে গেল। কে কটা গল্প-উপন্যাস নামাতে পারবে এই নিয়ে দুশ্চিন্তা। যেমন করেই হোক, দুটো বা তিনটে উপন্যাস লিখতেই হবে। কেউ কেউ হয়তো গর্বভরে বলেন, এবার আমি চারটি উপন্যাস লিখেছি। এখানেও দেখছি, বিশেষ উপলক্ষে আমাদের লেখক-সম্পাদকদের টনক নড়ে ওঠে। আমার মতো কারও কারও টনক না নড়ে উঠলে পত্রিকার সম্পাদকদের বিশেষ ক্রোড়পত্র নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। একেক সময় মনে হয়, এ দেশে লেখক যাঁরা আছেন, তাঁরা কি নিলামে বিকোবার মানুষ? নাকি সে৶ফ লেখা বের করে দেওয়ার যন্ত্র মাত্র? সে রকম হলে তো তা হবে রীতিমতো তাঁদের স্থলচ্যুতির শামিল। তাই না?

একুশে ফেব্রুয়ারির এই মাহেন্দ্রক্ষণে ফের কিছু কথা নাছোড় আমন্ত্রণে বাধ্য হয়ে লিখতে গিয়ে মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগে ওঠে—বহু বিষয়ে, বহু জরুরি প্রসঙ্গে আমাদের তৎপর হওয়া উচিত—তাই বলে লেখকদের কি সেই তৎপরতার যুদ্ধে বছরের পর বছর নামতেই হবে? আমার নিজস্ব বিশ্বাস, পৃথিবীর যেকোনো বড় লেখকেরই একটা নিজস্ব খনি থাকে। ব্যবহৃত হতে হতে কিন্তু সেই খনিতে যে সঞ্চয় বা সম্পদ থাকে তা শেষ হয়ে যায়। তখন ধুলোবালি কি তস্য তস্য ভগ্নাংশকেই সম্পদ বলে চালাতে হয়। কথাসাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে তো জোর দিয়েই বলতে পারি, যাঁরা বড় লেখক তাঁরা যতই লিখুন না কেন, টিকে থাকে অল্পই। তখন লেখক নিজেকে যদি না সংবরণ করেন, তাহলে তো পুনরাবৃত্তি ঘটবেই এবং এটি ঘটতে বাধ্য। এই অনিবার্য সাবধানবাণী বা স্বীকারোক্তিটুকু মনে রেখেই পাঠকদের এই লেখার বাকি অংশটুকু পড়তে সবিনয়ে অনুরোধ করি।

আমাদের দেশে যেগুলো বিশেষ দিন—একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ, নববর্ষ—এসব সামনে এলেই লেখকেরা কি উচ্চফলনশীল সাহিত্যকর্মী হয়ে দেখা দেবেন বলে মনে হয়? তা কোনো ক্ষেত্রেই হয় বলে আমার ধারণা নেই। প্রকাশক-সম্পাদকদের উৎসাহ ওঠা-নামা করে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে লেখকদের সৃজনক্ষমতার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে বলে মনে হয় না। আমার নিজের কাছে এটিই স্বাভাবিক বলে মনে হয় যে বছরে বড়জোর দু-তিনটি নতুন বই বেরোবে, আর পত্রিকায় কিছু রচনা ছাপাও হবে—একজন সুস্থ স্বাভাবিক কর্মক্ষম লেখকের ক্ষেত্রে তাই প্রযোজ্য। কিন্তু বিশেষ উপলক্ষ এলে লেখকদের সৃজনক্ষমতার মৌলিক শক্তির খুব ইতরবিশেষ হবে বলে ধারণা করা যায় না। অতিখরায় আমাদের যেমন ভয় থাকে, অতিবর্ষণেও তেমনি একই রকম উদ্বেগ তৈরি হয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন—ভালো গবেষণা কি মৌলিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধ—অতিখরা আমার মনে শঙ্কা তৈরি করে, তেমনি এমন মৌসুমি ক্রোড়পত্র চর্চার অতিফলনকেও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। বেশ কিছুদিন আগে একসময় সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও নিরোগ হওয়ার জন্য ‘টনিক’ খেতে অভ্যস্ত ছিল। আস্তে আস্তে সে অভ্যাস উঠে গেছে, এখন তার জায়গা নিয়েছে ‘মাল্টি ভিটামিন’। আমার ভয় হয়, একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের লেখকদের যেন তেমনি ‘টনিক’ বা ‘মাল্টি ভিটামিন’ না খেতে হয়।

বিশেষ উপলক্ষ আমাদের উৎসাহিত করে বটে, আমরা ফিরে ফিরে সেটি চাইতেও পারি, কিন্তু এটিও ভাবা দরকার, তা উৎসাহ সৃষ্টির বদলে একসময় না আমাদের বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলে! একই কথা বারবার বলতে বলতে আমরা যেন প্রগতির পথে উত্তরণের বিষয়টি এবং সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সংকট থেকে বেরোনোর পথ খোঁজার কথা ভুলে না যাই। প্রকৃত লেখকেরা যেন চর্বিতচর্বণ রচনায় হাত দিতে গিয়ে নিজ আসন থেকে সরে না যান। যে উৎসাহ একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামী প্রাণসম্পদের দিকে আমাদের প্রাণিত করে, মৌলবাদের মতো অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়তে সাহস দেয়—আমরা তাকেই আমন্ত্রণ জানাব। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটেছিল বলেই এখন চুপ করে বসে রইব, এমন নেশাগ্রস্ত আলস্য ও সারহীন সন্তুষ্টিতে যেন না ভুগি আমরা। এটি ঘটলে তা আমাদের সৃজনশীলতার কেন্দ্র ও ধর্মনিরপেক্ষ-ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের ভিত্তিভূমিকে বিপর্যস্ত করে তুলবে।

পত্রিকায় একই কথা, বারে বারে একই কথা নতুন মোড়কে চালিয়ে দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনার বা বাংলা ভাষার কী এমন উপকার হচ্ছে, তা মাথায়ও ঢোকে না। এই তো সেদিন প্রথম আলোতেই পড়লাম, রাজধানী ঢাকা শহরের নব্বই ভাগ প্রতিষ্ঠানের নামফলকগুলো লেখা হয়ে থাকে ইংরেজিতে! একটা শহরের সামান্য কয়টি নামফলকেও যেখানে বাংলা ভাষা স্থান পায় না, সেখানে বছরান্তে পত্রিকার পাতায় ‘মাতৃভাষার গুরুত্ব’, ‘একুশের তাৎপর্য’, ‘ভাষার জন্য ভালোবাসা’ কিংবা ‘ভাষাদূষণের প্রতিকার’ ইত্যাকার বহুলচর্চিত বিষয় নিয়ে—যেসবের হাড়মাংস আমরা কবেই চিবিয়ে সাবাড় করে দিয়েছি—কলমে তুবড়ি ছুটিয়ে কি এমন ফল মিলবে? এর বদলে তো সর্বস্তরে—মাঠে-হাটে-ঘাটে-বাজারে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-সরকারি দপ্তরে যাতে বাংলা ভাষার মর্যাদা সর্বদা—১২ মাস তথা ৩৬৫ দিনই উচ্চ স্থানে থাকে, সেদিকে নজর রাখাটা বেশি জরুরি। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? কেউ এমন উদাহরণ, প্রতিষ্ঠানের তরফে না হোক ব্যক্তিগতভাবে হলেও তৈরি করছেন বা করতে চাইছেন তেমন তো দেখছি না।

ঔপনিবেশিক আমল থেকে চালু ছিল ইংরেজি। বায়ান্নর পরও সেই আধিপত্যবাদী ভাষা ইংরেজিই জারি থাকল। কাজেই শহীদের অমরত্বের গৌরবে অর্জিত ভাষাকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে পারল না। সবকিছু ইংরেজিতেই বহাল থাকল। অথচ ষাটের দশকেই বাংলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়ে গেছে। বায়ান্নর পরই বাংলা একাডেমি কাজ শুরু করেছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সেটিকে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তা কেউ ভেবে দেখল না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়নি। একাত্তরের পর আশা করেছিলাম, এত রক্তক্ষয়ী একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি, বাংলা ভাষায় আমরা এবার শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে পারব। ঔপনিবেশিক কাঠামোর শিকড় থেকে মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ভাষা যা স্বাধীন রাষ্ট্রের শিক্ষা, সচিবালয়, বিচারালয় সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেটা কি করা গেল? আমি নিজে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি পড়িয়েছি ইংরেজিতে। এই নিয়ে মনঃকষ্টে থাকতাম এবং সেই যন্ত্রণা বহন করেই আমাকে অবসরে যেতে হয়েছে। আজও পরিস্থিতি বদলায়নি এক কণাও। ছাত্রজীবনে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়েই পার করলাম গোটা জীবন।

এখন আবার বিশ্বায়নের যুগ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ইংরেজি ঠিকমতো বলতে পারে কি না শিক্ষার্থীরা, সে পরীক্ষা নেওয়ার নিদান দেওয়া হচ্ছে। অথচ শুদ্ধভাবে কেউ বাংলা বলতে পারছে কি না, তার কোনো হিসাব রাখার আগ্রহ বা ইচ্ছা কারও নেই! ফলে তরুণ যারা বেড়ে উঠছে, তারা না বলতে পারে বাংলা শুদ্ধভাবে, না ঠিকমতো বলতে পারে ইংরেজি। তারা কথার মধ্যে ‘বাট’-এর পরে বলছে ‘কিন্তু’, ‘ইনফ্যাক্ট’-এর পরে বলছে ‘আসলে’। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না যদি না সম্পূর্ণ পণ্য, ক্ষমতা ও ব্যবসামুখী শিক্ষাব্যবস্থা আমরা বজায় রেখে দিই। শাসকদের মনমেজাজে উপনিবেশ না থাকলে এমনটা চলতে পারে না কোনো স্বাধীন দেশে।

যেকোনো প্রচারমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে দেখি, যত রকমভাবে সম্ভব আমাদের চেনা বাংলাটাকে বিকৃত, উদ্ভট, অসম্ভব দায়িত্বহীন করে তোলা সম্ভব, তা করা হচ্ছে; কেউ তো কিচ্ছুটি বলতে আসবে না। বাংলা ভাষা নিয়ে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা পর্বতপ্রমাণ, উচ্চকণ্ঠের ঢক্কানিনাদ, আকাশস্পর্শী ও ফাঁকা এবং সম্পূর্ণত লক্ষ্যশূন্য ও লোভী ভণ্ডামি আমাদের সমগ্র বুদ্ধি ও বিচারবোধকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বাংলা ভাষা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই, কিন্তু আমাদের অবস্থা এমন: আমরা শুধু স্বপ্ন দেখেই খালাস। আর স্বপ্ন দেখা মানে সর্বক্ষণ ঘুমিয়েই থাকা নয়, বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে নামাটা স্বপ্ন দেখার চেয়ে বেশি জরুরি। যেমনটি বলেন আমাদের এক বিশিষ্ট বন্ধু, স্বপ্ন দেখতে দেখতে মানুষ সেই স্বপ্নের সমান বড় হয়ে ওঠে—কথাটি যথার্থই, কিন্তু আমার মনে হয়, রাষ্ট্রকে উদার ও কল্যাণকর করার জন্য শুধু স্বপ্ন দেখাই যথেষ্ট নয়।

এই কথাটি বললাম কারণ আমি মানভাষার পক্ষে। কথ্য ভাষা দিয়ে উপন্যাসে একটি চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা গেল, প্রাণবন্ত করা গেল—এমনটি হয় মানলাম। কিন্তু যখন আমি কান্ট কি হেগেলের ওপর প্রবন্ধ লিখব, তখন তো কথ্য ভাষা ব্যবহার করতে পারব না। হরিশংকর জলদাস যখন জেলেজীবন নিয়ে উপন্যাস লিখছেন, তখন চট্টগ্রাম অঞ্চলের কথ্যভাষাকে তিনি অসামান্যভাবে কাজে লাগাতে পারেন ঠিকই, কিন্তু তিনিই যখন জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সমকাল নিয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন, তখন তাঁকে মানভাষার কাছেই ফিরে যেতে হয়। যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার ক্ষমতা ও কাজের বৈচিত্র্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। ভাষাও ঠিক সে রকম একটি যন্ত্র। যা ভাষার দ্বারা প্রকাশ করা যায় না, তা বাস্তব নয়। অর্থাৎ ভাষার সীমা ও বাস্তবতার সীমা এক। কাজেই ভাষার সাধ্য আমাদের অভিজ্ঞতার অন্তিমরেখা। ভাষা তাই ব্যক্তি সম্পত্তি হতে পারে না। ভাষা সামাজিক ও সামষ্টিক। ভাষার সামাজিকতা না থাকলে তা কোনো কাজেই আসবে না। এ কারণেই এর সাধারণ একটা রূপের প্রয়োজন পড়ে।

 আমি এখন এমন একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য অপেক্ষা করি, যা আমাদের মেধার সৃষ্টিক্ষমতায় নতুন করে প্রাণশক্তি সৃষ্টি করবে এবং শিল্পসাহিত্য-চিত্রকলার স্ফুটনোন্মুখ কুঁড়িগুলোকে পূর্ণ বিকশিত করে তুলবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রক্ষমতায় গদিয়ান থাকার স্বার্থে পেশিবহুল জুলুমবাজি ও ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে যারা প্রশ্রয় দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণাও জোগাবে।

হাসান আজিজুল হক: কথাসাহিত্যিক।