বিবরবাসিনী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জানালার ওপারে নিউ বর্ন বেবি পাখিদের কিচিরমিচির। নিঃসীম প্রায় পলকহীন চোখ মেলে আছি। প্রাণের মধ্যে থরকাঁপুনি।

ভেসে যাওয়া করুণ সুরের মতো কন্যার কথাগুলো বাতাসে উড়তে থাকে।

তুমি আমার জন্মের শত্রু।

তোমার রক্তমাংসে হিংসা।

তীব্র শোকে আমার ঠোঁটের মধ্যে থরকাঁপুনি শুরু হয়। আমার প্রাণের সমস্তটা দিয়ে ওকে আমি ভালোবাসি। ওর জ্বর এলে আমার নিউমোনিয়া শুরু হয়।

আমার কন্যা নিজেকে কুৎসিত জানে। অথচ ওর মুখের মধ্যে যে অদ্ভুত মায়াবী আদল, তা জন্মের পর থেকে ওর প্রতি আমাকে আবিষ্ট করে রাখে।

ওর দুই চোখের বিষ আমার রূপ।

আমি নিজেও তিতিবিরক্ত এই রূপের প্রতি।

এই রূপ আমার জন্মেরও শত্রু।

দেখতে কুৎসিত পাড়ার এক গুন্ডা আমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিল আমার রূপে উন্মত্ত হয়ে। আত্মার সেতু ভেঙে পড়তে চায়।

অবিশ্রান্ত ঝিঁঝি পোকা আমার করোটির মাঝে হল্লা করে।

যখন আমার সুন্দর রূপ আমার জন্য বিষ হয়ে ওঠেনি, তখন নার্সিসাসের মতো আয়নার সামনে বুঁদ হয়ে থাকতাম।

আত্মার বেলাভূমিতে অদ্ভুত ঝরনার উচ্ছলন/ উচ্ছ্বাস শুরু হতো।

গুন্ডাটা আমাকে তুলে নিয়ে যত আমার রূপ-রূপ করছিল, তার চেয়ে তীব্র বেগে সে আমার মাংস খুবলে খাচ্ছিল।

কন্যা যখন পেটে, ক্রসফায়ারে সে মারা যায়। তার আগে আমি অবশ্য ডিভোর্সের জন্য আসমান-মাটি এক করছিলাম। আমাকে দাবাতে সে আমার বাবার ডান পায়ে একটা গুলি করে কঠিন থ্রেট দিয়েছিল আমাকে। এটা একটা ছোট নমুনা দেখালাম। কন্যার ত্রিসীমানায় যাতে এই অন্ধকার না আসে, তাই আমি ঘর বিক্রি করে অচেনা এক দূর শহরে আসন গেড়েছি। ইশকুলে পড়াই।

ভেবেছিলাম, সব পেছনে ফেলে এসেছি।

কিন্তু ও বাবার আদল পেল। ওর জন্মের পর আমার রক্তে হিম স্রোত বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে কষে বেঁধে গভীর নিরীক্ষণে ওর মুখের মায়াবী রূপটা আমি দেখতে পাই।

কিন্তু আর কারও চোখে সেই রূপ ধরা পড়ে না।

গভীর নৈঃশব্দ্যে আমি মুখ ডুবিয়ে রাখি। রাতের পর রাত আমার কাটে আমার চাদর খামচে, তুলোয় আঙুল আঁকড়ে, ছায়াছাদে নির্নিমেষ চোখ মেলে।

রাত বাড়তে থাকলে দেয়ালে কত যে ছায়া পড়ে! নিশ্চল চেয়ে থাকি সেই দিকে।

রোজ রাতেই একটা রাতকুকুর তীব্র শীতের মধ্যেও কী যে করুণ সুরে কাঁদে।

দেখি, কন্যা আমার কুকুরটার গায়ে গরম কাপড় দিতে গেটের ছিটকিনিতে হাত দিয়েছে। বলি, ভালো করছিস। ওর কান্না এত করুণ, সহ্য করা যায় না।

কন্যা এক ঝটকায় আবার ফিরে আসতে থাকে। আমি একা নই, তোমারও কুকুরটার জন্য কষ্ট হচ্ছে না? তোমাকে সবটাতে জিততেই হবে।

যত দিন যায়, আমার অসহ্য রাতজাগা বাড়তেই থাকে। বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে কেউ। সেই ধ্বনি আমার মধ্যে কোনো রোমাঞ্চকর অনুভব দেয় না। সেই সুর আমার স্নায়ুর কোষে কোষে ঘোড়ার মতো ছড়াতে থাকে।

কত দিন আমি আর কন্যা একসঙ্গে কোথাও যাই না!

আমার ইচ্ছেও হয় না। কমনসেন্সের মাথা গিলে খেয়ে মানুষজন যেকোনো সময় আমাকে বলে বসে, এটা আপনার মেয়ে? বিশ্বাস করতে বলেন? বুঝেছি, ওর বাবার বোধ হয় এই চেহারা। আপনি এত সুন্দর, বিয়ে করলেন কিনা একটা...।

আমার সর্ব অস্তিত্ব ঝাঁ ঝাঁ করে। তবে কন্যা এসব ক্ষেত্রে হতভম্ব হয়ে থাকে। আমার দুই পা মাটির নিচে ঠেসে যেতে থাকে।

বাড়ি ফিরে কন্যা গোঙানির মতো চিৎকার করে।

শুনেছি সন্তান পেটে থাকলে মানুষ সুন্দর বেবিদের ছবি রাখে ঘরে। আমাদের ঘরে একটি ছবিও নেই। ছোটবেলায়ও দেখিনি। তুমি চাইতে না তোমার মতো সুন্দর তোমার সন্তান হোক। এই তুমি আমার মা?

জ্যোতিষ্কের মতো আমার দেহ ভাসতে থাকে।

ও গর্ভে আসার পর পুরোটা সময় আমি কী ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে গেছি, কন্যা কীভাবে তা বুঝবে? আঁধারের পরিব্যাপ্তি সীমানা ছাড়িয়ে যায়। ইশকুলে ক্লাস করাই নিজেকে ঠেলে ঠেলে। অন্যমনস্ক হয়ে।

একদা এসেছিল প্রেম। একতরফা তো অনেক হয়েছে, কিন্তু আমিও প্রেমে পড়েছিলাম জিতুর। অপজিটের বিল্ডিংয়ে রাত-দিন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ছেলেটা। একটি নির্জন নদীর অনেক ভেতরে যাওয়ার স্বপ্নের কথা বললে সে যে কবিতা শুনিয়েছিল, তার মাঝে ছিল নদীভেজা নারীর নৌকায় ক্ষয়িত রূপ। ঝাঁকড়া চুলের সেই ছেলেটা এখন কোথায় আছে? ভেবেই ছটফট করে বুক। কিন্তু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই সব।

আমার জীবনের প্রেম পরিণতি পেল না। দাম্পত্য সুখ কী, জানলাম না। কী করব এই রূপ নিয়ে? মনে হয়, করলা চটকে মুখে মেখে ঘুরতে থাকি।

গির্জার সান্ধ্য ঘণ্টা শুনে জানালা থেকে ঘরে আসি।

প্রতিটি ভোর আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলে শুরু হয় দিন—আমার নিষ্ঠুর দিনের শুরু হয়। কেন বেঁচে আছি, উত্তাল বাতাস আমার দিকে দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে দেয়।

আমার কন্যার জন্য।

যার নাম রাত্রি।

তুমি জন্মের পর আমাকে মেরে দেখোনি কেন?

এখন প্লাস্টিক সার্জারি করে তোমার মুখটা আমাকে দিয়ে দাও।

এমন অসম্ভব কথা কেন বলিস?

এক অদ্ভুত করুণ মূর্ছনার মধ্য দিয়ে গড়িয়ে যায় আমার দিনরাত্রি।

একদিন বারান্দায় বসে আছি। চারপাশ নির্জন। আসমান থেকে আসা বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে ঝরে পড়ছে পবিত্রতা। পেছন থেকে রাত্রি—আমার কন্যা আমাকে বিহ্বল করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে, মা, অপু আরেকটা সুন্দর মেয়ের কাছে যাওয়ার আগে তোমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছিল। আমাকে বলেছে, তুমি এই মায়ের সন্তান হতেই পারো না। খোঁজ নিয়ে দেখো, তোমাকে উনি দত্তক নিয়েছেন কি না। সত্যি বলো মা, এটা সত্যি?

আমি যেন সর্বস্বান্ত, এইভাবে ভেঙে পড়তে চায় নিজের অস্তিত্বের আগল।

আমি আত্মার তলা থেকে রাত্রির কষ্ট আর অসহায়ত্বের শেকড় ছুঁতে পারি। বেচারা চারপাশের জগৎ দ্বারা বিক্ষত। ওর রূপহীনতা ওর জীবনে বিষ নামিয়ে এনেছে। পাশাপাশি আমার সুন্দর রূপ ওকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছে। এই যাতনার ব্যথা আর ক্রোধ আমাকে ছাড়া সে আর কার কাছে ঝাড়বে? নিজেকে নিয়ে ক্রমশ কঠিন মনোবিকারের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সে। আমার কন্যা।

আমি আকুলভাবে ওকে আঁকড়ে ধরে নিজের সমস্ত সত্য, ওর গুন্ডা বাবার ঘটনাসহ এক এক করে আমার সমস্ত অসহায়ত্ব ওর সামনে তুলে ধরি।

সেই রাতেই মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

ধু ধু হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে ফেলি চোখের জানালা-দরজা।

মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে।

ভেতরে মস্ত পাহাড়ের মতো ভয় ঢুকে যায় আমার।

শকুনের মতো তীক্ষ্ণ ঠোঁটে সেই ভয় আমার আত্মার আকাশ ঠোকরাতে থাকে।

রাত্রি যদি সত্যিই মৃত্যুতে সফল হতো? আমি দিকচিহ্নহীন ভাসতে থাকি।

আমার মনের ভেতর খেলা করে অজস্র কবর। এর কোনোটার মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে। জানালা-দরজা কিচ্ছু নেই।

ধীরে ধীরে থিতু হই, যে করেই হোক, আমি নিজের চেহারা ঝলসে দেব।

এ নিয়েও কত দিন হিসহিস করেছে, আমি কালো, আমি অন্ধকার বলে আমার নাম রাত্রি রেখেছ? মুখে মুখে বলো আমার চেহারাতে মায়া, আদতে তুমিও হাড়ে হাড়ে বিশ্বাস করো, আমি রাতের মতোই ঘুটঘুটে। মৃদু কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করি, রাত্রিতে কত মায়া তুই জানিস না?

আমাকে ফালতু বুঝ দিয়ো না। তোমার সব ভাঁওতাবাজি আমি বুঝি। নিশ্চয়ই আমার জন্মের পর আমার চেহারা দেখে খুশি হয়েছিলে। তোমার পাশে আর কারও মুখকে সুন্দর দেখাবে না, না?

যেন বা মহাগহ্বর থেকে ছিটকে ছিটকে পড়ি। প্রায়ই নিশ্বাস নিতে পারি না। ওর প্রায় প্রতিটি কথার বাণ আমার অস্তিত্বকে ফালা ফালা করে দেয়।

অথচ শৈশবে আমার মুখ দুই হাতে আঁজলা করে ধরে বলত, আমার পরির মতো মা। কত নিষ্পাপ কণ্ঠে বলত, আমি দেখতে তোমার মতো হলাম না কেন, মা?

তুমি দেখতে তোমার মতো বলে ওর আস্ত অস্তিত্বকে নিজের দেহের সঙ্গে পিষে ফেলতাম।

সেভেন-এইট থেকেই সে যে কালো—এ নিয়ে তুমুল সচেতনতা বাড়ে রাত্রির। এরপর থেকে ইশকুলে যাওয়া কমে যায়। ঘরের মধ্যে বুঁদ হয়ে বসে থাকে। কোনো বন্ধু হয় না তার। যেহেতু সর্বত্র নিজের চেহারা নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে হয় তাই ওর কোনো সামাজিকতা হয় না।

অকূলপাথারে খড়কুটোর মতো ভাসতে থাকি আমি। যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছি, ওর চাইতে খারাপ দেখতে মেয়েকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে ফিকফিক করে বলেছি, দেখেছ ওকে? কী সুন্দর হেসে গল্প করছে? তোমার মতো তো গোমড়ামুখে বসে নেই? কথা শেষও হয়নি আমার, অমনি সটান হয়ে রাত্রি বলেছে, ওর পাশে তো আর ওর মায়ের সুন্দর মুখ নেই যে কম্পেয়ার করে ওকে কেউ আঘাত দিয়ে কথা বলবে।

এতটা বাড়াবাড়ি হতো না। ওর জীবনে প্রেমটা না এলে। স্বাভাবিকভাবেই ঈর্ষা, ক্ষোভ প্রকাশ করত। প্রেমে পড়ার পর রাত্রি অন্য মানুষ হয়ে গেল। আমি মুগ্ধ চোখে দেখতাম, ওর সলজ্জ মুখের কম্পন।

একদিন বললাম, নিয়ে আসিস ছেলেটাকে।

আচমকা যেন বিদ্যুৎ লাগল রাত্রির শরীরে, লাফ দিয়ে বলে, পাগল! তোমার সামনে আনব?

আমার ভেতরে হিম স্রোত বয়ে যায়।

এখন রাত্রি কাছে না থাকলেও কেউ যখন বলে, কীভাবে এক বয়সেই আছেন? যত দিন যাচ্ছে, রূপ তো শুধু খুলছেই।

আমার ভেতরে তীব্র হুল ফোটে যেন।

রাত্রির ক্রোধ আরও খোলতাই হলো। ছেলেটা রাত্রিকে ফেলে আরেকটা সুন্দর মেয়ের প্রেমে পড়ে চলে যাওয়ার পর তার অন্ধকার জীবনের শুরু। তখন সবে ওর এসএসসির রেজাল্ট বেরিয়েছে। কোনো রকমে পাস দিয়ে সে আর কিছুতেই কলেজে ভর্তি হয়নি।

আমি আয়না দেখা ছেড়েছি অনেক দিন। ডুবডুবে তেলে মাথা ডুবিয়ে কষে চুল বেঁধে সাজসজ্জাহীন চলাফেরা করি। নিজেকে আমূল ডুবিয়ে রাখি গল্পের মধ্যে।

রাতের বেলায় বিছানায় নিথর শুয়ে থাকলে ধেই ধেই নেচে আমার বাড়ন্ত বয়সটা এগিয়ে আসে। শুনি ‘অ্যাঞ্জেল’, ‘রাজকন্যা’... কত রকম ধ্বনি। কত যুবকের আত্মা শিহরিত করা চাহনি!

মনে হয়, এই সব অন্য জীবনে ঘটেছে।

মেয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে ভিক্ষে চাই, আমাকে হেল্প কর, কী করব আমি? বোরকা পরি?

আহা! ঠোঁট ওল্টায় মেয়ে, সে নাহয় বাইরে পরবে, যেখানে যাবে, সেখানে তো বোরকা খুলবেই।

আমি এখন কী করব? কী করলে তোর সুখ?

দিন যায়। দিন যায়।

বাড়ি ফিরে কদিন লক্ষ্মীটি হয়ে রইল রাত্রি—চুপচাপ। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সে আগের রূপে ফিরে এল। বলল, তুমি আমার কাছে পড়ে আছ কেন? মানুষের কাছে মহত্ত্ব দেখানোর জন্য?

আমি চলে গেলে তুই কার কাছে থাকবি?

ভিক্ষে করব।

এইবার কঠিন হই, তাহলে যা। ভিক্ষে কর গিয়ে, থাকিস না আমার কাছে।

ছায়া ফুঁড়ে বজ্রপাত হয়।

এই তো তোমার আসল রূপ বেরিয়েছে। আমি গেলে তুমি একটা বিয়ে করতে পারবে। গুন্ডার পাল্লায় পড়েছিলে না? তোমার কত অবদমন!

কী বলল মেয়ে?

দূরসীমারেখা ধেয়ে ধেয়ে বুদ্‌বুদের মতো কিছু প্রগাঢ় অনুভব আমাকে চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরে। সত্যিই তো আমার জীবন, আমার যৌবন—সবই তো বৃথার মহা নর্দমায় ভেসে যাচ্ছে। বিয়ের পর থেকে আমি এক দিনও নিজেকে ভালোবাসিনি।

আমি স্পষ্ট একটি বিশাল নদী দেখি, তার ওপর অসংখ্য ঢেউ দেখি; তার ওপর একটি নৌকা ভাসতে দেখি, নৌকায় ভেজা কাপড়ে নিজেকে শায়িত দেখি। আমার মুখের ওপর ঝাঁকড়া চুলের এক যুবককে দেখি। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ বয়ে যায় আমার নির্জীব শরীর দিয়ে। রাত্রি নিজ ঘরে রাক্ষসের মতো চিল্লাচ্ছে। আমি কত দিন, কত অনন্তকাল পর ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে নিজের সুন্দর মুখের ওপর কম্পিত আঙুলে একটি টিপ বসিয়ে দিই।