বিপ্রতীপ

শিক্ষার্থীদের মাঝে ওমর ফারুক। ছবি: লেখক
শিক্ষার্থীদের মাঝে ওমর ফারুক। ছবি: লেখক

তখন সবে আমি ক্লাস ফাইভে উঠেছি। পাহাড়ে আমাদের লালমাটির বাড়ি থেকে দক্ষিণ সোনাইছড়ি প্রাইমারি স্কুল ছিল তিন কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। গহিন জঙ্গল ছিদ্র করে যাওয়া রাস্তা ধরে যেতে হতো প্রায় দুই কিলো। তারপর সবুজ বিলের মাঝ ধরে বেয়ে চলা আঁকাবাঁকা আইল ধরে যেতে হতো আরও এক কিলোমিটার। পথে একটা বাঁশের সাঁকোও পড়ত। আমাদের ছিল টানাপোড়েনের সংসার। মা কোনো রকম ডালভাত দুটো খাইয়ে আমাকে স্কুলে পাঠাতেন। তখন আমাদের পুরো মৌলভি পাড়া পাহাড়ের হাতেগোনা কয়েকজন স্কুলে যেতাম।

গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিল বারবাকিয়া বাজার। সিডি তখনো আসেনি। ভিসিআরের রমরমা অবস্থা ছিল। মা সকালে আমাকে পাঠাতেন স্কুলে, আর আমি বন্ধুদের সঙ্গে চলে যেতাম ভিসিআর দেখতে বাজারে। টাকা পয়সা তেমন সমস্যা ছিল না। পাহাড়ে গিয়ে একদিন লাকড়ি এনে বিক্রি করলে বিশ-ত্রিশ টাকা পাওয়া যেত। তা দিয়ে মোটামুটি দিনে দুইটা করে দশটা বই (সিনেমা) দেখতে পারতাম।

মা জানতেন আমি নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। বড় ভাই পড়ালেখা ছেড়ে দিলেও মা আমাকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন যে, একদিন জজ-ব্যারিস্টার কিছু একটা হব। এভাবে প্রায় ছয় মাস স্কুলে না যাওয়ার পর মা একদিন জানতে পারেন, আমি স্কুলে যাচ্ছি না।

এক বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভি জামাল স্যার আমাদের বাড়িতে এসে মাকে আমার স্কুলে না যাওয়ার গুমর ফাঁস করে দেন। স্যারকে দেখে আমি পালিয়ে যাই। মা অনেক মারধর করে পরদিন থেকে বইখাতা নিয়ে স্কুলে পাঠালেও আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি। বিলে মাছ ধরতাম, চুরি করে মানুষের খেতের মিষ্টি আলু ওঠাতাম, খালে মরিচ খেলা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম কিংবা চিল হান্টার নিয়ে পাখি শিকারের জন্য ঘুরে বেড়াতাম। কানের ফাঁকে কাদা কিংবা ভেজা চুল দেখে স্কুলে যাইনি বুঝতে পারলে মা ফের মারতেন। জামাল স্যার আরও একবার দিনের বেলায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন এবং সেইবারও স্যারকে দেখে পালিয়ে যাই আমি।

স্যারের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলা খেলতে খেলতে টানা আট মাস চলে যায়। একদিন রাত আটটায় জানালা দিয়ে দেখি, জোনাকি পোকার মতো একটা আলো মিটিমিটি করে আমাদের বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে। প্রথমে কোনো প্রতিবেশীর আগমন মনে করলেও, বস্তুত হারিকেন জ্বালিয়ে সেদিন জামাল স্যার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। পালাতে চাইলেও রাত থাকায় সেদিন পালাতে পারিনি। চেয়ারের পাশে বসিয়ে স্যার অনেক কথা বলেছিলেন। সব কথা মনে না থাকলেও একটা কথা স্পষ্ট মনে আছে এখনো, ‘নিজের কপাল নিজে খাইস না।’

পরের দিন থেকে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করি। প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে ভর্তি হই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে এখন শিক্ষা নিয়ে কাজ করি। ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমার স্যার মারা যান। সুযোগ পেলে স্যারের কবর জিয়ারত করে আসি।

পেশাগত কারণে এখন শিক্ষকদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। তাঁদের জামাল স্যারের কথা বলি। জামাল স্যার হোম ভিজিট করে আমাকে যে ঝরে পড়া থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন, সেই কথা বলি। এখন প্রতি মাসে অন্তত একটি ঝরে পড়া শিশুকে হোম ভিজিট করে স্কুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। যতবারই হোম ভিজিটে যাই জামাল স্যারের কথা মনে পড়ে, নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। চোখ ভিজে আসে। সম্মানিত শিক্ষকদের হোম ভিজিট করে ড্রপ আউট শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। বিশ্বাস করি প্রত্যেক শিক্ষক মাসে একজন করে ড্রপ আউট কমাতে পারলে আমার আওতাধীন এলাকায় ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা একদিন শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

হারিকেনের মিটিমিটি আলো দিয়ে আমার অন্তরে জামাল স্যার যে আলো একদিন জ্বালিয়েছিলেন, সেই আলো জ্বালানোর কাজই আমি করি। আমার এসব দেখে স্যার স্বর্গে বসে এখন নিশ্চয়ই হাসছেন।

লেখক: সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম