স্যার এত জোরে তো মারার কথা ছিল না

মো. শাহিনুর রহমান স্যারের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখক
মো. শাহিনুর রহমান স্যারের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখক

শিক্ষক, তিন অক্ষরের একটি শব্দ, কিন্তু এই শব্দের মাহাত্ম্য এত অধিক, তা শুধু সুবিশাল সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। অন্তত আমি শিক্ষকদের মহাসাগরের নীল জলরাশির মতোই দেখি। শিক্ষক যে শুধু প্রাতিষ্ঠানিকই হবেন তা নয়, যাঁর থেকে একজন মানুষ জীবনের যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো কিছু শেখে, হোক না সেটি ক্ষুদ্র, তবুও তিনি শিক্ষক। সে হিসেবে সবার জীবনেই শিক্ষক আছে। পরিবার ছাড়াও জীবনে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমাদের পড়াশোনা করতে হয়, প্রতিটি জায়গাতেই আমাদের মহানুভব শিক্ষকেরা আমাদের নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। সেই মহান শিক্ষকদের মাঝেও কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁদের কথা, কাজ, উপদেশ, শাসন মনের ভেতর আলাদাভাবে আঁচড় কাটে। ঠিক আমারও তেমন একজন প্রিয় শিক্ষক আছেন, যাঁকে আমি অনুভব করতে পারি, যাঁর আদেশ, উপদেশ আমার কানে বাজে।

স্যার মো. শাহিনুর রহমান, ডাক নাম মিন্টু স্যার। স্যার, আমাদের উচ্চমাধ্যমিকে ইংরেজি বিষয় নিতেন। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই স্যারের ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি স্বভাবতই শিক্ষকদের খুব ভয় পেতাম, বিশেষ করে স্যারদের সামনে গিয়ে কথা বলা বা বোর্ডে গিয়ে কিছু লেখা ছিল আমার জন্য এক বিভীষিকাময় কাজ। একটা মজার ঘটনা বলি,আমি যখন ক্লাস টু-তে পড়ি, একদিন এক স্যার পড়া বলতে বললে, আমি দাঁড়িয়েই হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। পরে অবশ্য লিখে দিয়েছিলাম, তবে মুখে বলতে পারিনি। গল্পটা বলার কারণ আছে, এই আমি যে দাঁড়িয়ে পড়া দিতে পারতাম না, সেই আমি পরবর্তী সময় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, উপস্থাপনা ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত হতে পেরেছি শুধু স্যারের জন্য। তিনি সহকারী শিক্ষক ছিলেন, তবুও নিজে উদ্যোগ নিয়ে, স্বল্প রোজগারের মধ্য থেকে টাকা দিয়ে আমাদের স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। তাও বাংলা না, ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতা, যা কিনা ওই সময়ে আমাদের মতো গ্রামের স্কুলের কারও কল্পনাতেও ছিল না। উনি আমাদের দিয়ে নাটক করাতেন, ইংরেজি ছোট ছোট শিক্ষামূলক নাটক। এখানেও স্যারের সঙ্গে আমার মজার এক ঘটনা আছে। একবার এক নাটকের মাঝে একটা ছাত্রকে মার খেতে হবে, সেই ছাত্র হিসেবে আমিই বাছাই হলাম। নাটকের মাঝে যখন স্যার আমাকে ঠাস করে মার দিলন, আমি কেঁদে স্যারকে জোরে বলে ফেললাম, ‘স্যার, এত জোরে তো মারার কথা ছিল না!’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

স্যার আমাদের বাস্তব জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করতেন। একদিন ‘টি স্টল’ একটা প্যারাগ্রাফ পড়াবেন। উনি আমাদের সবাইকে স্কুলের পাশের চায়ের দোকানে নিলেন। চা খাওয়ালেন এবং সেই প্যারাগ্রাফ এমনভাবে পড়ালেন, আজও ভুলিনি। শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, উনি বাইরের জগৎসহ জীবনমুখী জ্ঞান দিতেন, যার গুরুত্ব এখন বুঝতে পারি। কত গরিব ছাত্রছাত্রীকে যে তিনি বই কিনে দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বিনিময়ে শুধু একটি কথাই বলতেন, ‘তোর থেকে যেন নিয়মিত পড়া পাই।’ আমরা নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি আমাদের নিয়ে সমিতি করেছিলেন। প্রতি সপ্তাহে ১০-২০ টাকা করে জমাতাম। কারণ এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে যে টাকার দরকার হয়, তা আমাদের অনেকেই একবারে জোগাড় করতে পারত না। যখন আমাদের ফরম পূরণের সময় এল, আমরা দেখলাম আমাদের ফরম পূরণের টাকা ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা রয়ে যাচ্ছে। একজনেরও ফরম পূরণ করতে ছাগল বিক্রি বা কারও থেকে ঋণ নিতে হয়নি, যা ছিল আগের নিয়মিত ঘটনা। স্যারকে দেখেছি রাতের আঁধারে ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে খোঁজ নিতে। এখনো নেন। স্যারের আরও অনেক গুণ আছে যা এই নির্দিষ্ট শব্দে বলা সম্ভব নয়। শুধু এটুকুই বলব, অনেক ভালোবাসি গুরু। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আলোকিত করুন এই ধরা। আপনার শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক হাজারো জ্ঞানপিপাসু।
শিক্ষক দিবসে পৃথিবীর সব শিক্ষকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: মুস্তাফিজুর রহমান