রুপালি ইলিশ, সোনালি আগামী

মো. সামছুল আলম
মো. সামছুল আলম

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম। তাঁর নেতৃত্বে সম্প্রতি উন্মোচিত হয়েছে ইলিশের জীবনরহস্য। তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

প্রথম আলো: পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের পর এ ধরনের মৌলিক গবেষণায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আগ্রহ বেড়েছে। আপনারা ইলিশের জীবনরহস্য উম্মোচন করেছেন। কী ভাবনা থেকে এ কাজে নেমেছেন আপনারা?
মো. সামছুল আলম: ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। আমাদের জন্য এ মাছের আর্থসামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। কাজেই এই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এই মাছের জীবন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অপ্রতুল।
কারণ ইলিশ একটি পরিযায়ী (migratory) মাছ। এরা সারা বছর সাগরে বাস করে। প্রজননের জন্য নদীতে অভিপ্রয়াণ (migration) করে। আবার ডিম ছাড়ার পর সাগরে ফিরে যায়। আর বিভিন্ন প্রজননক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম থেকে পরিস্ফুটিত লার্ভাগুলো নদীতেই বড় হতে থাকে। জাটকা পর্যায়ে আসার পর এগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে সাগরে ফিরে যায়।
জিনোম হচ্ছে কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবনধারা। জীবের অঙ্গসংস্থান, জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোসহ সব জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোমে সংরক্ষিত নির্দেশনা দিয়ে। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে কোনো জীবের জিনোমে সব নিউক্লিওটাইড কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে, তা নিরূপণ করা।
জীবনরহস্য উন্মোচনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো প্রজাতির জিনোম সিকোয়েন্স এবং সংশ্লিষ্ট জিনোমিক তথ্য সৃষ্টি করে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্নিহিত জেনেটিক মেকানিজম আবিষ্কার করা। একটি জীবের জিনোমে সর্বমোট জিনের সংখ্যা, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাজ পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যায়।

প্রথম আলো: ইলিশের জিনোম আবিষ্কারের কাজ কবে শুরু করলেন?
আলম: ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের বিষয়টি আমরা চিন্তা করি। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল তথ্যভান্ডার অনুসন্ধান করি। তাতে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই আমরা ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং করার সিদ্ধান্ত নিই।

প্রথম আলো: কীভাবে কাজ শুরু করলেন?
আলম: আমরা ২০১৬ সালের মে মাসে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগর থেকে জীবন্ত পূর্ণবয়স্ক ইলিশ মাছ সংগ্রহ করি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশ জেনেটিকস ও বায়োটেকনোলজি এবং পোলট্রির বায়োটেকনোলজি ও জিনোমিকস ল্যাবরেটরিতে উচ্চ গুণগত মানের জিনোমিক ডিএনএ তৈরি করি। পরে যুক্তরাষ্ট্রের জিনোম সিকোয়েন্সিং সেন্টারে পৃথকভাবে মেঘনা ও বঙ্গোপসাগর থেকে সংগ্রহ করা ইলিশের প্রাথমিক সিকোয়েন্স ডেটা সংগ্রহ করি। এরপর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে স্থাপিত বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্কের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভার কম্পিউটারে বিভিন্ন বায়োইনফরম্যাটিকস প্রোগ্রাম ব্যবহার করে সংগৃহীত প্রাথমিক সিকোয়েন্স ডেটা থেকে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম এসেম্বল করি।
যেহেতু ইলিশ মাছের কোনো রেফারেন্স জিনোম এর আগে করা হয়নি, তাই আমরা ডি-নোভো জিনোম এসেম্বল করি। নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের (১৫০ বেস) ডিএনএ খণ্ড হিসেবে প্রাথমিক সিকোয়েন্স ডেটা উৎপন্ন হয়, যেগুলোকে বায়োইনফরম্যাটিকস প্রোগ্রাম ব্যবহার করে এসেম্বল করতে হয়। এটা বেশ জটিল প্রক্রিয়া।

প্রথম আলো: এই গবেষণা থেকে আমরা কী পাব। এর বৈশ্বিক গুরুত্ব কতটুকু?
আলম: জীবনরহস্য উন্মোচনের বিষয়টি একটি মৌলিক গবেষণা। কাজেই এখান থেকে কিছু পেতে হলে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। এই ফলাফলকে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হলেও এটি একটি আন্তর্জাতিক মাছ। মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ইলিশ পাওয়া যায়। আমাদের এসেম্বল করা ইলিশ জিনোম আন্তর্জাতিক জিনোম ডেটাবেইসে জমা করেছি। এ থেকে বিশ্বের যেকোনো গবেষক প্রয়োজনে ব্যবহার করে ইলিশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারবেন। ইলিশের মতো স্যামনসহ আরও অনেক মাছ রয়েছে, যাদের বায়োলজির সঙ্গে ইলিশের মিল আছে। কাজেই আমাদের গবেষণার বৈশ্বিক গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রথম আলো: এই গবেষণার ফলাফলকে দেশে ইলিশের স্বার্থে কাজে লাগাতে আর কী করতে হবে। সোজা কথায়, মানুষ কখন থেকে এই গবেষণার সুফল পাবে।
আলম: বাংলাদেশে ইলিশের জন্য মেঘনা, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক ও পদ্মা নদীতে মোট ছয়টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ৪৩৩ কিলোমিটার। অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মজুত সংরক্ষণ করা। সে জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের সঠিক মজুত নির্ণয় করা এবং মজুতভিত্তিক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা; যা এখনো করা সম্ভব হয়নি। এখন আমাদের আবিষ্কৃত ডিএনএ মার্কার প্রয়োগ করে স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশের ইলিশের মজুত-সংখ্যা ও বিস্তৃতি নির্ণয় করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের দেশের ইলিশ ভারত ও মিয়ানমারের দিকে চলে যাচ্ছে কি না, তা জানা যাবে। একই সঙ্গে ইলিশের একটি রেফারেন্স জিনোম প্রস্তুত করে জিন শনাক্ত ও জিনের অবস্থান নিরূপণ করা যাবে। এ জন্য বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে বিভিন্ন নদী, মোহনা ও বঙ্গোপসাগর থেকে মাছের নমুনা সংগ্রহ করে আমাদের আবিষ্কৃত ডিএনএ মার্কার প্রয়োগ করে জেনেটিক বিশ্লেষণ করতে হবে। এসব কাজ শেষ করতে পাঁচ-ছয় বছর লাগবে।

প্রথম আলো: জীবনরহস্য উন্মোচনের ফলে আমরা কি ইলিশের কোনো নতুন বৈশিষ্ট্য জানতে পেরেছি?
আলম: আমাদের এসেম্বল করা ইলিশের জিনোমে প্রায় ৭৬ কোটি ৮৪ লাখ নিউক্লিউটাইড রয়েছে, যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক–চতুর্থাংশ। আমরা ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ২১ হাজার ৩২৫টি মাইক্রোস্যাটেলাইট ও ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০০টি সিঙ্গেল নিউক্লিউটাইড পলিমরফিজম আবিষ্কার করেছি, যা আগে জানা ছিল না।

দক্ষিণ এশিয়ার  দেশগুলোতে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের  মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান  হলো ইলিশ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হলো ইলিশ



প্রথম আলো: বিশ্বের কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ মাছের জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। সেখান থেকে এখন পর্যন্ত কী কী সফলতা এসেছে, যা ওই দেশের মানুষের কাজে লেগেছে?
আলম: জানামতে, পৃথিবীতে ৬০টির বেশি মাছের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ২২টি বর্গের ৫২টি প্রজাতির মাছের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এদের রিপিট সিকোয়েন্সের সঙ্গে স্বাদু পানি, আধা লবণাক্ত পানি ও লবণাক্ত পানিতে খাপ খাওয়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং তথ্যকে সাধারণত তিনটি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে—
১. বায়োলজিক্যাল তথ্যের মডেল হিসেবে। জেব্রাফিশ মানুষের রোগনির্ণয় ও প্রতিকারসংক্রান্ত গবেষণায় মডেল প্রাণী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জাপানিজ মেদাকা মাছ মেরুদণ্ডী প্রাণীর লিঙ্গ নির্ধারণী ফ্যাক্টর (জিন) গবেষণায় অনন্য প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত।
২. মৎস্য চাষে: উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত বৈশিষ্ট্য জেনে এবং তা কাজে লাগিয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। ইতিমধ্যে স্যামন মাছে জিনোম মার্কার সহায়ক সিলেকটিভ ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে উচ্চবর্ধনশীল ও রোগ–প্রতিরোধী স্যামন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। গ্রাসকার্প কীভাবে জলজ উদ্ভিদ খেয়ে তা থেকে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে, ওই মাছের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকে সম্প্রতি তা জানা সম্ভব হয়েছে। আবার তেলাপিয়ার লিঙ্গ নির্ধারণী পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। জিনোমিক তথ্য ব্যবহার করে তেলাপিয়ারও লিঙ্গ নির্ধারণী পদ্ধতি জানা সম্ভব হয়েছে। এসব তথ্য এসব মাছ চাষে কাজে লাগবে।
৩. মৎস্য ব্যবস্থাপনায়: মৎস্য ব্যবস্থাপনার প্রথম কাজ হচ্ছে উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে জানা। জিনোম যেহেতু কোনো জীবের যাবতীয় জীবতাত্ত্বিক তথ্যের উৎস, কাজেই জিনোম থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য কাজে লাগিয়ে মাছের জাত উন্নয়নসহ যেকোনো উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব।

প্রথম আলো: এই গবেষণায় আর কী অর্জন আছে?
আলম: সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, জীবনরহস্য উন্মোচনের মতো একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করার জন্য স্থানীয় সক্ষমতা অর্জন। এখন যেকোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জিনোম এসেম্বলির কাজ আমরা সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে স্বল্পব্যয়ে করতে পারব।

পুষ্টিগুণ
দক্ষিণ এশিয়ার ৩০ জনপ্রিয় মাছের মধ্যে সবচেয়ে পুষ্টিকর মাছ ইলিশ

পুষ্টিগুণ: (প্রতি ১০০ গ্রাম)
চর্বি: ১৮–২২ গ্রাম
ভিটামিন সি: ২২ মিলিগ্রাম
প্রোটিন: ১৪ দশমিক ৪ গ্রাম
আয়রন: ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম
ওমেগা-৩: ফ্যাটি অ্যাসিডের ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ
ভিটামিন এ ও ডি-র উত্কৃষ্ট উত্সও ইলিশ
১ হাজার ২০ কিলো জুল (শক্তির একক)

উৎপাদনক্রম
২০১৩: ৫১০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ধরা পড়ত
২০১৪: ৫৩৫ গ্রাম
২০১৫: ৬২৮ গ্রাম
২০১৬: ৬৪০ গ্রাম
২০১৭: ৬৫০ গ্রাম

সবচেয়ে মূল্যবান মাছ
উৎপাদন (২০১৭): ৫ লাখ টন
আর্থিক মূল্য: ৬০ হাজার কোটি টাকা
সাংস্কৃতিক, সামাজিক মূল্য: ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা
দেশের মোট মাছের ১০ শতাংশ ইলিশ জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ
বিশ্বের ৫০-৬০ শতাংশ উৎপাদন
৪–৫ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে যুক্ত
ইলিশ পাওয়া যায় : ২৫টি নদীতে

সূত্র: ওয়ার্ল্ড ফিশ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

ইফতেখার মাহমুদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক