দেশি ব্র্যান্ডের বিশ্বযাত্রা

প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল তিন যুগ আগে। বাংলাদেশের ঘোড়াশাল থেকে। সেই প্রাণ এখন ব্র্যান্ড হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ১৪১টি দেশে। আমজাদ খান চৌধুরীর হাতে প্রতিষ্ঠিত প্রাণকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর ছেলে আহসান খান চৌধুরী। তিনিই এখন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।

১৯৯৬ সাল। আহসান খান চৌধুরী তখন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন বিভাগের দায়িত্বে। আকাশপথে আফ্রিকার দেশ জিবুতির ওপর দিয়ে উগান্ডা যাচ্ছিলেন তিনি। দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ আহসান খানের ইচ্ছা হচ্ছিল তখনই সেখানে নেমে পড়ার। ফেরার পথে তিনি ঠিকই জিবুতিতে নামলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে গেলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংগঠনে। কয়েকজন খাদ্য ব্যবসায়ীর নম্বর নিয়ে ফোন করা শুরু করলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাড়া পাওয়া গেল না। একজন কথা বলতে রাজি হলেন, তাঁর নাম আল গামিল। যিনি আল গামিল গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। আহসান খান চৌধুরী দেখা করে তাঁকে বাংলাদেশি পণ্য কিনতে রাজি করান।

আহসান খান চৌধুরী
আহসান খান চৌধুরী

বাংলাদেশ থেকে জিবুতির দূরত্ব ৫ হাজার ১৯৮ কিলোমিটার। ভারত পেরিয়ে আরব সাগর পাড়ি দিলে পরে জিবুতির দেখা মেলে। ওই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তেমন কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না। ইউরোপ, আমেরিকার বাজার আর অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধার (জিএসপি) আওতায় পণ্য রপ্তানিতে অভ্যস্ত এ দেশের রপ্তানিকারকেরা আফ্রিকায় যাওয়ার চিন্তাও করেননি তখন। সেখানেই আহসান খান আলাদা। দুই দশক পেরিয়ে গেছে, জিবুতিতে এখন প্রাণের প্রচুর পণ্য যায়। আফ্রিকা এখন তাদের অন্যতম বাজার। আল গামিলকে দুবার বাংলাদেশে নিয়ে আসেন আহসান খান চৌধুরী।

সুদূর আফ্রিকা নয়, বাড়ির পাশের ভারতের অন্তত ১৫টি রাজ্যের দোকানে দোকানে আছে প্রাণের পণ্য। নেপালেও একই চিত্র। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ কিংবা ওশেনিয়া—প্রাণের পণ্য আছেই।
এই প্রাণ বাংলাদেশি ব্র্যান্ড, এই প্রাণ এ দেশের কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য থেকে তৈরি। এই প্রাণ বিশ্বের ১৪১টি দেশে বাংলাদেশের পতাকা বহন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের যে বাড়বাড়ন্ত, তাতে প্রাণের অবদান বছরে ৩৩ কোটি মার্কিন ডলার (২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমান)। গত অর্থবছরে প্রাণের রপ্তানি আয় ৪২ শতাংশ বেড়েছে।

প্রাণের যাত্রাসাল ১৯৮৫। প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী। শুরুতে তিনি কৃষিপণ্য উৎপাদন করে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করতেন। দেখা গেল, মৌসুমে সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম একবারেই কমে যায়। লাভ থাকে না। তখন আমজাদ খানের মাথায় কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের চিন্তা এল। ঘোড়াশালে তিনি কারখানা করলেন। ১৯৯২ সালে কোম্পানিতে যোগ দিয়ে প্রাণকে বিশ্বমুখী করলেন তাঁর তৃতীয় সন্তান আহসান খান চৌধুরী। তাঁর চেষ্টায় ভারত, আরব আমিরাত, আফ্রিকা, মালয়েশিয়া ও স্পেনে খুলেছে প্রাণের দপ্তর।

দেশের অনেক পোশাক কারখানা প্রাণের চেয়ে বেশি রপ্তানি আয় করে। তবে পোশাক কারখানার সঙ্গে প্রাণের পার্থক্য হলো, প্রাণ নিজের ব্র্যান্ড নামে পণ্য রপ্তানি করে। পোশাক কারখানাগুলো বিদেশি ব্র্যান্ডের জন্য পণ্য তৈরি করে দেয়।

রাজধানীর প্রগতি সরণিতে প্রাণ-আরএফএল সেন্টারে গিয়েছিলাম আহসান খানের কাছ থেকে প্রাণের বিশ্বযাত্রার গল্প শুনতে। সাক্ষাতের সময় ছিল বেলা আড়াইটা। পৌনে দুইটায় পৌঁছে গেলাম। ভবনের তৃতীয় তলায় প্রাণের ক্যানটিনে ঢুকে চোখ আটকে গেল একটি টেবিলে। ৯–১০ জন কর্মী দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে একজন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী। টেবিলে তাঁর সরাসরি সামনে বসে খাচ্ছিলেন টেলিভিশন সারাইয়ের একজন মিস্ত্রি। প্রাণের কার্যালয়ে নিরাপত্তাকর্মী থেকে প্রধান নির্বাহী—সবাই একসঙ্গে বসে ভর্তুকিমূল্যে খাবার খান। ঊর্ধ্বতনদের জন্য আলাদা কোনো টেবিল নেই। সবার শার্টের রং আকাশি, যাতে পোশাকি কোনো ভেদাভেদ না থাকে।

প্রাণের পুরো কার্যালয়ে মিতব্যয়িতার ছাপ। আহসান খান চৌধুরীর কক্ষটিও মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরের মতো সাদামাটা। তাঁর সামনে লেখার একটি সাধারণ খাতা, চামড়ায় মোড়ানো দামি ডায়েরি নয়। কলমটি নিজেদের উৎপাদিত বলপেন। ব্যবসাজীবন, ব্যক্তিজীবন, জীবনদর্শন—আলোচনায় সবই এল। প্রশ্ন ছিল—কর্মীদের সঙ্গে বসে আহার করার বিষয়ে। বললেন, তাঁর পরিবারও সীমিত আয়ের একটি পরিবারই ছিল। পিতার সীমিত আয়ে চার ভাইবোনকে মানুষ করতে মাকে কষ্ট করেই সংসার চালাতে হয়েছে। সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে দেয়াল না থাকুক—এ আকাঙ্ক্ষা তাঁর তখন থেকে।

আহসান খান চৌধুরীর জন্ম ঢাকায়, ১৯৭০ সালে। সেন্ট যোসেফ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্টবার্গ কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে দেশে ফেরেন। ওই বছরই যোগ দেন প্রাণে। শুরুতেই বাবা তাঁকে অর্থ ও বিপণন সামলানোর দায়িত্ব দেন। ২০১৫ সালে আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুর পর তিনি এখন পুরো প্রাণ সামলান।

আম বাছাইয়ে ব্যস্ত কর্মীরা। প্রাণ-এর কারখানায়। ছবি: সংগৃহীত
আম বাছাইয়ে ব্যস্ত কর্মীরা। প্রাণ-এর কারখানায়। ছবি: সংগৃহীত

বিপণনের দায়িত্ব পেয়ে আহসান খান চৌধুরী দেশজুড়ে বিস্তৃত বিপণন নেটওয়ার্ক তৈরিতে মনোযোগ দেন। তারপর নজর দেন বিদেশের বাজারে। ১৯৯৪ সালে প্রথম জার্মানিতে একটি মেলায় অংশ নেয় প্রাণ। নেতৃত্বে আহসান খান চৌধুরী। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভূমিকা ছিল। তারা বিভিন্ন দেশে একক মেলার আয়োজন করত। প্রাণ অংশ নিত। সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রাণের পণ্য ছড়িয়ে দেওয়ার গল্প আরও আকর্ষণীয়। ওই সব দেশে তখন ভারতীয় ও পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের জয়জয়কার। পণ্যও যায় ওই দুই দেশ থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে আহসান খান চৌধুরী বাঙালি বাজারে ঘোরাফেরা শুরু করেন, আর দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলেন। সৌদি আরবে প্রাণ–পণ্য যাওয়া শুরু হয় বাঙালি একজন সবজি বিক্রেতার হাত ধরে, যাকে আহসান খান চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে রাজি করান। তাঁর ডাকনাম ফারুক। এভাবে কাতারের আবুল তালেব, কুয়েতের আশরাফ, আবুধাবির মোজাম্মেল—মূলত বাঙালি দোকানমালিকেরাই পরবর্তী সময়ে প্রাণের আমদানিকারক হয়েছেন। ভারতের বাজারে প্রাণের যাত্রা শুরু হয় আগরতলা দিয়ে। দুই দশক আগে আহসান খান আগরতলা গিয়ে আমদানিকারক ও পরিবেশক খুঁজে বের করেন। এরপর প্রাণ আশপাশের রাজ্যে যায়।

প্রাণের সফলতার কারণ কী? আহসান খান বললেন, ‘আমরা সব সময় পণ্যের দাম সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। এর পেছনে রয়েছে আমােদর পারিবারিক মূল্যবোধ। আমােদর নিজেদেরও একসময় সীমিত আয়ে চলতে হতো।

আহসান খান চৌধুরীর লক্ষ্য, আগামী কয়েক বছরে প্রাণকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। প্রাণ সম্প্রতি ব্রিটিশ রিটেইল কনসোর্টিয়ামের মানসনদ পেয়েছে, যা তাদের ইউরোপে রপ্তানি বাড়াতে সাহায্য করবে। ফ্রান্সের ক্যারিফোর, স্পেনের ইসিআই, যুক্তরাজ্যের উইলকিনসন, কানাডার ডেল্লারামার মতো সুপারস্টোরে এখন প্রাণের পণ্য পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।

একনজরে প্রাণ-আরএফএল
যাত্রা শুরু: ১৯৮১ সালে
কোম্পানির সংখ্যা: ২৫
কারখানা: দেশের ১৩টি জায়গায়
পণ্যের সংখ্যা: ২ হাজার ৬০০
ব্র্যান্ড: ২০০টির মতো
কর্মসংস্থান: সরাসরি ১ লাখের বেশি, পরোক্ষ প্রায় ১৫ লাখ
রপ্তানি আয়: ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা
প্রবৃদ্ধি: ৪২ শতাংশ
চুক্তিভিত্তিক কৃষক: ৮০ হাজার

একনজরে আহসান খান চৌধুরী
জন্ম: ১৯৭০ সালে
শিক্ষা: ঢাকায় সেন্ট যোসেফ ও নটর ডেম কলেজ। যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্টবার্গ কলেজ
প্রাণে যোগদান: ১৯৯২ সালে
প্রথম দায়িত্ব: বিপণন ও অর্থ বিভাগ সামলানো
চেয়ারম্যানের দায়িত্ব: ২০১৬ সালে
পরিবারের সদস্য: স্ত্রী ও দুই মেয়ে

রাজীব আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক