বোহিমিয়ান রকগুরু

>

জেমস
জেমস

নগর বাউল জেমস বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। ভিন্নধর্মী ব্যক্তিত্ব সুর ও গায়কিতে তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছেন কয়েক দশক ধরে। আবার তাঁর গান সর্বজনীনও। সে জন্যই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নন্দিত হয়েছে তাঁর সুরের মূর্ছনা।

দিন–তারিখ মনে নেই; তবে মনে আছে জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা উদ্যাপনে কনসার্ট হবে জগন্নাথে। আসবে ব্যান্ড দল এলআরবি আর ফিলিংস। সকাল থেকেই ঘোরাঘুরি করছি জগন্নাথের ক্যাম্পাসে। বিকেলে জেমস শুরু করলেন ‘অনন্যা’ গান দিয়ে। এক বিষাদমাখা কণ্ঠে গাইছিলেন, ‘ভেবে ভেবে তোমার কথা উদাস হয়ে যাই, একা নির্জনে স্বপনের সংসারে খুঁজি তোমায়’। শ্রোতা-দর্শক যেন মুহূর্তে তন্ময় হয়ে গেল। আমিও বাদ নেই। আমরা সবাই তখন নিজেদের কল্পনা ও বাস্তবের অনন্যার কথা ভাবছি আর জেমসের সুরে সুর মেলাচ্ছি, ‘কতদিন কতরাত্রি গিয়েছে পেরিয়ে! কভু আনমনে ছুঁয়ে গেছ তুমি।...লাজুক দৃষ্টি নিয়েও অনন্যা, অনন্যা, তুমি আমার ভালোবাসা’।

জেমস। নিজস্ব ব্যক্তিত্বে, বৈশিষ্ট্যে। ২ নভেম্বর ২০১৮, গুলশানে। ছবি: কবির হোসেন
জেমস। নিজস্ব ব্যক্তিত্বে, বৈশিষ্ট্যে। ২ নভেম্বর ২০১৮, গুলশানে। ছবি: কবির হোসেন

এর পরে কেটে গেছে বহু বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্সের পাট চুকিয়ে পিএইচডি শেষ করে নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু জেমসের সঙ্গেই আছি। ২০১৬ কিংবা ২০১৭ সালে গিয়েছি সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। কারণ, রাতে জেমস আসবেন। জেমস এলেন। সেই একই রকম জাদুকরি প্রভাব। দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ। জেমস গাইছেন, ‘পাগলা হাওয়ার তোড়ে, মাটির পিদিম নিভু নিভু করে, ওরে ওরে হাওয়া থামনা রে...’। তন্ময় হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মাঝখানের দিন, বছর আর বয়স—সব যেন গুরুত্বহীন।

জগন্নাথ থেকে সিদ্ধেশ্বরী; মাঝখানে কেটে গেছে এক যুগের বেশি। শিল্পী জেমস আর তাঁর শ্রোতার পারিপার্শ্বিকতা বদলে গেছে। নব্বইয়ের ঢাকা শহর আর ২০১৬–এর ঢাকা শহরে আকাশ-পাতাল ফারাক। গান শোনার মাধ্যমও বদলে গেছে। ক্যাসেট থেকে সিডি, সিডি থেকে এমপি থ্রি। চারদিকে উন্নয়ন। খেলার মাঠ, ডোবা ভরাট করে উঠছে একের পর এক অট্টালিকা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শপিং মল। হল ছাড়িয়ে সিনেমা চলে গেছে সিনেপ্লেক্সে। পাড়ার আড্ডাগুলো চলে গেছে সেলফি আর ফাস্ট ফুডের দোকানে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ডিজিটাল বাংলাদেশের নতুন যুগে ঢাকার একেকজন তরুণ যেন বিশ্বনাগরিক। বলিউড, হলিউড, আরজিৎ সিং, মেরুন ফাইভ, লিম্প বিজকিট, নেটফ্লিক্স—বিশ্বের সব সাংস্কৃতিক পণ্য তাদের মুঠোফোন, এমপি থ্রি প্লেয়ার অথবা ল্যাপটপে, ক্লিকের নাগালে। কিন্তু গানের গুরু বদলাননি। তিনি একজনই—জেমস।

বিদেশে যেখানেই গিয়েছি—নিউইয়র্ক, সিডনি, ব্রাসেলস, লন্ডন, সিঙ্গাপুর—বাংলাদেশি তরুণদের গুরু জেমস। বলিউডের গানগুলো দিয়ে তিনি অনেকটা বিশ্বজয়ীও। অসংখ্য বিদেশি ভক্ত তাঁর—ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডায়। কানাডার এক মেয়ে তাঁর সঙ্গে বাজিয়েছেনও এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে।

কিন্তু জেমসের শুরুটা ছিল অনেকটা সন্তর্পণে। তাই পটভূমিটা জরুরি। জেমস যে সময়ে সংগীতে আসেন, তখন ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনটা ছিল অনেক প্রাণবন্ত। টিভিতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক বহুব্রীহি আর কোথাও কেউ নেই চুম্বকের মতো আটকে রেখেছিল দর্শকদের। তাঁর উপন্যাসের শুভ্র, হিমু ও মিসির আলিতে ছিল তরুণদের আসক্তি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লার কবিতা ছিল তরুণদের প্রাণস্পন্দনে। আর সংগীতে নতুন নতুন ব্যান্ড দলের মূর্ছনায় ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহর যেন হয়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক হাব। আমার বেড়ে ওঠা নব্বইয়ের ঢাকাতেই।

এই শহরের কতশত অট্টালিকার ফাঁকে, এক গ্লাস জোছনা আর এক গ্লাস অন্ধকার হাতে, মধ্যরাতের ডাকপিয়ন হয়ে প্রেমিকাকে আপন করে নেবেন।এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটা রাজনীতি ছিল। তাতে ব্যান্ড সংগীতকে মূল ধারার গণমাধ্যম থেকে সরিয়ে রাখার একটা প্রয়াস ছিল। সমাজের গুণী ব্যক্তিদের প্রায়ই বলতে শোনা যেত, ব্যান্ড সংগীত হচ্ছে অপসংস্কৃতি। তাঁদের চোখে এগুলো ছিল দুষ্ট ছেলেমেয়েদের সংগীত। নিরাপদ সড়কের জন্য কিছুদিন আগের কিশোর আন্দোলন যেমন চোখে আঙুল দিয়ে বলে গেল, এই তথাকথিত গুণীজনের সমাজ ও রাষ্ট্রধারণা সেকেলে। ব্যান্ড সংগীতের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাও বলে দিয়েছিল, তৎকালীন গুণীজনেরা সেকেলে। কিশোর ও তরুণদের ভালো লাগার, ভালোবাসার, কষ্টের, দৈনিক সংগ্রামের, সুখের ও দুঃখের বন্ধু ছিল এই ব্যান্ড সংগীত। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, আবাসিক হলে হলে বাজত বিভিন্ন ব্যান্ডের গান। যেন এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বাচ্চু, শাফিন, সঞ্জয়, মাকসুদ যেন একেকজন নতুন সাংস্কৃতিক আইকন। সত্তরের দশকে গুরু আজম খানের শুরু করা ব্যান্ড সংগীতের আন্দোলন নব্বইয়ের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও বাজার অর্থনীতির যুগে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিচ্ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে।

সে সময় অবশ্য খুব কম মানুষই ধারণা করেছিল, নাটোর থেকে উঠে আসা ফারুক মাহফুজ আনাম জেমসই হয়ে উঠবেন এই সংগীতের নয়া গুরু। শুধু দেশ নয়, পাশের দেশ ভারতের দর্শক-শ্রোতাদের কাছেও জেমস এখন গুরু। আজকের যেকোনো কনসার্টে জেমস মঞ্চে উঠলে স্লোগান ওঠে, ‘গুরু, গুরু, গুরু’। কেন এবং কীভাবে জেমস গুরু? গুরু উপাধি একটি কনস্ট্রাকটেড আইডেন্টিটি। আলোচনা করছি।

জেমসের ব্যান্ড (ফিলিংস ও নগরবাউল) থেকে প্রকাশিত অ্যালবামগুলো হচ্ছে স্টেশন রোড, জেল থেকে বলছি, নগর বাউল, লেইস ফিতা লেইস ও দুষ্ট ছেলের দল। আর একক অ্যালবামের মধ্যে আছে অনন্যা, পালাবে কোথায়, দুঃখিনী দুঃখ করো না, ঠিক আছে বন্ধু, আমি তোমাদেরই লোক, জনতা এক্সপ্রেস ইত্যাদি। জেমসের এসব গানের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে; যা অন্যদের গানে নেই। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই জেমসকে নিয়ে গেছে সব রকম শ্রোতার কাছে। ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত; নারী-পুরুষ, শহর-গ্রাম—সবার কাছে জেমস হয়ে উঠেছেন গুরু।

এর কারণ জেমসের গানের সর্বজনীনতা। কনডেম সেলে আটক ফাঁসির প্রহর গুনতে থাকা আসামি, ভাড়ায় খাটা পেশাদার খুনি, গ্রামের হাটে মলম বিক্রি করা মান্নান মিয়া, গার্মেন্টসে কাজ করা নারী শ্রমিকেরা (সেলাই দিদিমণিরা), সব হারা একজন জুয়াড়ি, লিডার (নেতা), নাটোর স্টেশন রোডের দরিদ্র পতিতা জরিনা বিবি, মাতাল শারাবী, রিকশাওয়ালা, গ্রামের মেয়ে হুমায়রা, রাজার দরবারের নর্তকী মীরা বাই, বিরোধী দলের অবরোধের সময়ে প্রেম—কিছুই বাদ নেই জেমসের গানের বিষয় থেকে।

গানের বিষয় নির্বাচনে জীবন সম্পর্কে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিচিত্রময়তাই প্রশ্রয় পেয়েছে। তাঁর সুরেও আছে বৈচিত্র্য; যা ছুঁয়ে যায় নগর, গ্রাম, কলকাতা, বলিউডসহ সব রকমের শ্রোতাদের।

জেমস হতাশায় ডুবে থাকা মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছেন। হতাশ হয়ে কেউ দিনের পর দিন মনমরা হয়ে থেকেছে। কেউ মাদকের দিকে হাত বাড়িয়েছে, কেউ আত্মহত্যা করেছেন; কিংবা করেছে ভয়াবহ অপরাধ। এই হতাশ মানুষগুলোর দিকে জেমস হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রগাঢ় মমতায় গেয়েছেন, ‘নীরবে অভিমানী নিভৃতে করেছ তিলে তিলে নিজেকে শেষ? কেন বলো পৃথিবীতে কেউ কারও নয়, হয়ে গেছে ভালোবাসা নিঃশেষ। বন্ধু ভেঙে ফেলো এই কারাগার খুলে দাও…খুলে দাও এ হৃদয়ে প্রেমেরই দ্বার’। অথবা ‘দুঃখের পৃষ্ঠা উল্টে দেখো স্বপ্নের বাগিচা, ঘরে বসে থেকে লাভ কি বলো? এসো হাতে হাত রাখি এসো গান করি। দুঃখিনী দুঃখ করো না... দুঃখিনী...দুঃখিনী’। নিজেকে একজন দুঃখী মানুষ হিসেবে তুলে ধরে আশার আলো দেখিয়ে বলছেন, ‘দুঃখ আমার সাথে আছে, তবু দেখো দুঃখী আমি নইতো।...কিসের এত দুঃখ তোমার। সারাক্ষণ বসে বসে ভাবছ? পৃথিবীতে বলো বাঁচবে কদিন। সময়টা তো বড় অল্প।’

জেমস বিরহকেও এঁকেছেন অনেক বেশি দরদ দিয়ে। মায়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে সন্তানের বিরহের চিত্র এঁকে সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে গেছেন শ্রোতার হৃদয়। এই বিরহ প্রেমিক-প্রেমিকার প্রচলিত বিরহের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। এই বিরহ কোনো বয়স বা শ্রেণিতে আবদ্ধ নেই। মৃত মাকে খোঁজার হৃদয় নিংড়ানো হাহাকারে কার না চোখ আর্দ্র হয়েছে, ‘সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখো পাবে দূর নক্ষত্র–মাঝে। রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস, কোথায় আছে কেমন আছে মা?’ অথবা হারানো বাবাকে খুঁজে ফেরা সেই সন্তান, ‘বাবা কত দিন, কত দিন দেখি না তোমায়, কেউ বলে না তোমার মতো, কোথায় খোকা ওরে বুকে আয়...’।

যেহেতু বাজার সংস্কৃতিতে অথবা সংস্কৃতির বাজারে সংগীতের ও শিল্পীর একটা বাজারমূল্য থাকে, তাই কথা বলতেই হয় জেমসের ব্যক্তিত্ব নিয়ে। তাঁর এই ব্যক্তিত্বেরও একটা বাজারমূল্য আছে। সৃজনশীলতার বাজারে ‘বিদ্রোহীর’ একটা আলাদা দাম আছে বিশ্বব্যাপী। ঝাঁকড়া চুল, পাঞ্জাবির সঙ্গে জিনস আর বুট—এই দেশি ও পশ্চিমা মিশ্রণে তিনি একজন নগরবাউল। যে বাউল ইলেকট্রিক গিটার বাজান। যে বাউল মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গড়ে ওঠা সমাজ ও নগরব্যবস্থায় ফিকে হয়ে আসা মানবিক অনুভূতিগুলোকে ছুঁয়ে যান। বলেন, এই শহরের কতশত অট্টালিকার ফাঁকে, এক গ্লাস জোছনা আর এক গ্লাস অন্ধকার হাতে, মধ্যরাতের ডাকপিয়ন হয়ে প্রেমিকাকে আপন করে নেবেন। এই বাউল প্রেমিকাকে ডাকেন সভ্যতার খোলস ছেড়ে গুহামানবীর মতো জঙ্গুলে ভালোবাসার আহ্বানে। এই বাউল যেন এক রাসপুতিন, যিনি মেয়েদের সাবধান করে বলছেন, তাঁর চোখে না তাকাতে। কারণ, তাকালে তারা ‘লুটপাট হয়ে যাবে, চৌচির হয়ে যাবে’।

ব্যক্তিজীবনেও জেমস ব্যতিক্রমী। ভালোবেসে বিয়ে করে জেলে গেছেন। অসাধারণ পোর্ট্রেট ছবি তোলেন। আর বারবার মনে করিয়ে দেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’ এক বোহিমিয়ান রাসপুতিন জেমস, সাধারণে অসাধারণ। তাই এখনো তরুণ ও মাঝবয়সী ভক্তদের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তিনি যখন কনসার্টের মঞ্চে উঠে বলেন, ‘লাভ ইউ...।’ আর ভক্তরা গলা মেলায় গুরু, গুরু বলে।

একজন জেমস

নাম: ফারুক মাহফুজ আনাম

জন্ম: ২ অক্টোবর ১৯৬৪, নওগাঁ

ব্যান্ড: নগর বাউল (আগে ফিলিংস)

মা: জাহানারা খাতুন (গৃহিণী)

স্ত্রী: বেনজির সাজ্জাদ

সন্তান: জান্নাত, জাহান ও দানেশ

শখ: ছবি তোলা

একক অ্যালবাম

অনন্যা, পালাবে কোথায়, দুঃখিনী দুঃখ করোনা,

ঠিক আছে বন্ধু, আমি তোমাদেরই লোক, জনতা এক্সপ্রেস, তুফান, কাল যমুনা

হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক

ভিগি ভিগি (গ্যাংস্টার), চল চলে (ও লামহে), আলবিদা (রিপ্রাইস), রিশতে (লাইফ ইন এ মেট্রো)

বেবাসি (ওয়ার্নিং থ্রিডি)

পুরস্কার

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (দুবার)

সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস

মোবাশ্বার হাসান, পোস্ট–ডক্টরাল ফেলো, প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতিতত্ত্ব বিভাগ, অসলো বিশ্ববিদ্যালয়, নরওয়ে