আরিফ আনোয়ারের ঝড়

আরিফ আনোয়ার। ছবি: সংগৃহীত
আরিফ আনোয়ার। ছবি: সংগৃহীত

‘মাসুদ রানা’ ভীষণভাবে গ্রাস করেছিল ছেলেটিকে। ‘দশ লক্ষ ডলার দাবি করা হলো মুক্তিপণ। জায়গামতো পৌঁছে দেওয়া হলো সব টাকা। কিন্তু ফেরত এল না জাঁ দুবে। তারপর...’। মাসুদ রানা সিরিজের এই ‘তারপর’–এর আকর্ষণই বইয়ের পাতায় আটকে রাখত সেদিনের ও লেভেলপড়ুয়া আরিফ আনোয়ারকে।

এসব ১৯৯৩–৯৪ সালের ঘটনা। একই সঙ্গে রামায়ণ, মহাভারত, সত্যজিৎ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, হুমায়ূন—সবই পড়া চলল গোগ্রাসে। আরিফ হয়ে উঠলেন সেই ছেলে, খাবার টেবিলেও যিনি বইয়ে মুখ গুঁজে থাকেন। সন্তানের এহেন বইপ্রীতি দেখে মা–বাবা তাঁকে বলতে লাগলেন, ‘বই পড়িস না এত, বাইরে গিয়ে খেলাধুলা কর।’
ছেলের সঙ্গে মা–বাবার এই কথাবার্তা হতো ঢাকার শ্যামলীর ১ নম্বর রোডে। ওখানেই আরিফ আনোয়ারদের বাড়ি। আরিফ এখন কানাডাপ্রবাসী, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের শিক্ষক।
ইংরেজি মাধ্যমে পড়া সেই আরিফ আনোয়ার, যিনি ছিলেন বাংলা বইয়ের পোকা, তিনি কখনো ভাবেননি যে একদিন ইংরেজি ভাষায় উপন্যাস লিখবেন।
১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া এ তরুণের প্রথম উপন্যাস দ্য স্ট্রম বেরিয়েছে এ বছরই। কানাডার হারপার কলিন্স থেকে মার্চ মাসে, যুক্তরাষ্ট্রের সাইমন অ্যান্ড সান্ডার থেকে এর কিছুদিন বাদে। প্রকাশের পরই জার্মান, ইতালিয়ান ও তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান ইত্যাদি খ্যাতনামা কাগজে বইটি সম্পর্কে আলোচনা ছাপা হয়েছে।
দ্য স্টর্ম–এর একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ভোলা জেলায় ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা। সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করা ভোলার জেলেনি হনুফা। আর এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাস করা যুবক শওকত চৌধুরী। তাঁদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে ঘনীভূত হয়েছে উপন্যাসের মূল রহস্য।

>আরিফ আনোয়ার
প্রথম উপন্যাস দ্য স্টর্ম কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের শিক্ষক
ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতকোত্তর প্রাথমিক শিক্ষায় পিএইচডি
মনোবিদ্যায় স্নাতক, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র, ২০০০
ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতকোত্তর, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র, ২০০৩
প্রাথমিক শিক্ষার ওপর পিএইচডি, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, কানাডা, ২০১২

বাংলাদেশ থেকে এ লেভেল সম্পন্ন করে পড়ালেখার জন্য ১৯৯৬ সালে আরিফ পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে ২০০৩–এ ফিরে এসেছিলেন দেশে। যোগ দিয়েছিলেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে। ২০০৭–এ উচ্চশিক্ষার্থে আবার বিদেশযাত্রা, এবার কানাডায়। ওখানকার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে ২০১২ সালে পিএইচডি অর্জন। তারপর ওই দেশে তাঁর থিতু হওয়া এবং লেখক হয়ে ওঠার লড়াই।
দিন কয়েক আগে ফোনে আরিফ আনোয়ারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, সে সময় তিনি ছিলেন শ্বশুরবাড়িতে—চীনে। ২০১৫ সালে বিয়ে করেছেন চীনা তরুণী সান্দাকে। কিরণ নামে ৯ মাস বয়সী এক ছেলে আছে তাঁদের।

দ্য স্টর্ম বইয়ের প্রচ্ছদ
দ্য স্টর্ম বইয়ের প্রচ্ছদ

চীন থেকে আরিফ জানালেন নিজের লেখক হয়ে ওঠার কাহিনি: ‘২০১২ সালে খুব একঘেয়ে সময় পার করছিলাম। এ সময় এক রাতে অনেকটা হুট করেই মনে হলো কিছু লিখি, দেখি না কী হয়। লিখতে শুরু করলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম মহাকাব্যিক একটা উপন্যাস লিখব। কিন্তু তিন–চার শ পৃষ্ঠা লেখার পর বুঝতে পারলাম, আমার এ লেখাটি গন্তব্যহীন হয়ে পড়েছে। অগত্যা ক্ষান্ত দিলাম। তবে বাংলাদেশ নিয়ে উপন্যাস লেখার ইচ্ছা তত দিনে মনের ভেতর জেগে উঠেছে। তাই ওই বছরই দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় লিখলাম দ্য স্টর্ম।’
আরিফের লেখক হয়ে ওঠার লড়াইয়ের শেষাংশ এখনো বাকি। দশ মাস একটানা লেখার পর পাঁচ বছর ধরে তিনি পরিমার্জন করেছেন উপন্যাসটি। সবশেষে প্রকাশক–এজেন্টদের দপ্তরে ধরনা দেওয়া এবং বেশ কয়েক জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যান—বেশ দীর্ঘ এসব গল্প।
এখন আরিফ ১৯৩০ দশকের ভারত, আয়ারল্যান্ড ও তানজানিয়ার প্রেক্ষাপটে নতুন উপন্যাসের ছক কষছেন। সেদিন টেলিফোনে কথায় কথায় বলছিলেন, ‘ইংরেজি ভাষা বেশ শুষ্ক, কিন্তু আমি চাই ইংরেজি ভাষায় একটি বাংলা উপন্যাস লিখতে। বাংলা উপন্যাসের মধ্যে যে আবেগ আর রহস্য ফুটে ওঠে, দ্য স্টর্ম–এ সেটা ধরার চেষ্টা করেছি। নতুন উপন্যাসেও একই চেষ্টা করব।’
আমরা আশা করব, বাংলাদেশের এই তরুণ লেখকের হাতে রচিত হবে এ দেশের মানুষের আরও অনেক গল্প। বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে।

 আলতাফ শাহনেওয়াজ প্রথম আলোর সহসম্পাদক