পালোয়ান শিরিন সুলতানা

শিরিন সুলতানা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
শিরিন সুলতানা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

ভারতীয় সিনেমা দঙ্গল–এর কথা মনে আছে নিশ্চয়। সেখানে আমির খান তাঁর বড় মেয়ে ববিতাকে কুস্তিগির বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি বাবার মুখ উজ্জ্বল করে কমনওয়েলথ পুরস্কার অর্জন করে। যাঁকে নিয়ে এই সিনেমা তৈরি বাস্তবের সেই ববিতা কুমারী ফোগাট হলো বাংলাদেশের পালোয়ান শিরিন সুলতানার আদর্শ। বাংলাদেশে এ রকম খেলায় সাধারণত মেয়েরা আসে না। নানা রকম প্রতিকূলতা পেরিয়ে মেয়েটি এ পর্যন্ত এসেছেন। ১৯৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই কুস্তিগির মেয়েটি দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মেজ। বাবা বেঁচে নেই, মা–ই তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস।

‘মেয়েরা রাস্তাঘাটে সব জায়গায় নানা রকম ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়। আত্মরক্ষার স্বার্থেই কুস্তি শেখা।’ বলেন শিরিন।
২০০৮–০৯–এর কথা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রতিযোগিতা থেকে মাত্র এক মাসের একটি প্রশিক্ষণ পান। সে সময়ই তাঁর কোচ হাজি মোহাম্মদ আশরাফ আলী বলেন, ভালো করলে চালিয়ে যাবে, না করলে খেলা বন্ধ করে দেবে। সেটি মূলমন্ত্র হিসেবে নেন শিরিন।

২০০৯–১৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে টানা জিতে গেছেন স্বর্ণপদক। এই সময়কেই জীবনের টার্নিং পয়েন্ট মনে করেন তিনি।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার মেয়ে শিরিন সুলতানা কুস্তির পাশাপাশি মুরগির খামারের ব্যবসাও করেন। ফুলবাড়িয়াতেই আছে তাঁর খামার।
কুস্তি শিরিনকে এনে দিয়েছে দেশ–বিদেশের নানা সম্মাননা ও স্বীকৃতি। ইন্দো-বাংলাদেশ রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক পান ২০১২ সালে। ২০১৩ সালে এশিয়ান রেসলিং প্রতিযোগিতায় পান ব্রোঞ্জ পদক। এশিয়ান গেমস, এশিয়ান ইনডোর এবং মার্শাল আর্ট গেমস পুরস্কার, ইসলামিক সলিডারিটি গেমস, প্রেসিডেন্ট আনসার মেডেল, ক্রীড়া লেখক সম্মাননাসহ আরও অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন শিরিন সুলতানা।

>শিরিন সুলতানা 
২০১২: ইন্দো-বাংলা রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক।
২০১৩: এশিয়ান রেসলিং প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক। ২০১৫: জাতীয় মহিলা কাবাডিতে স্বর্ণপদক। ২০১০ ও ২০১১ সালে জাতীয় উশু চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যপদক। ২০১৪ সালে স্বর্ণপদক। জাতীয় রোইং চ্যাম্পিয়নশিপেও স্বর্ণপদক জয় পরপর চারবার (২০১০-১৩) ২১তম কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে অংশগ্রহণ এবং ৪র্থ স্থান অর্জন

শুধু কুস্তিতে তাঁর ক্রীড়ানৈপুণ্য আটকে রাখতে চাননি। জাতীয় রোইং চ্যাম্পিয়নশিপেও স্বর্ণপদক পেয়েছেন টানা চারবার (২০১০-১৩)। ২০১৫ সালে জাতীয় মহিলা কাবাডিতে স্বর্ণপদক জেতেন। জাতীয় উশু চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যপদক পান ২০১০ ও ২০১১ সালে। ২০১৪ সালে জিতে নেন স্বর্ণপদক।
খেলা ও ব্যবসার পাশাপাশি তিনি পড়ালেখাও চালিয়ে গেছেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এখন স্নাতকোত্তর পর্বে পড়াশোনা করছেন।
খেলা, ব্যবসা, পড়াশোনা—এত কিছু কীভাবে সামলান? এই প্রশ্নের উত্তরে শিরিন বলনেন, ‘সবই পরিবারের সহযোগিতা ও নিজের চেষ্টায়। আমি যখন খেলতে আসি বা প্রশিক্ষণে আসি, তখন মা সবকিছু সামলান। এরপরও কিছু সমস্যা তো হয়ই। সেগুলো বাড়তে না দিয়ে দ্রুত সমাধান করে ফেলার চেষ্টা করি। আর রেসলিংয়ে আমার সমস্যা যা হওয়ার কথা ছিল, তা অনেকটা কমে গেছে আমাদের আগে যাঁরা খেলেছেন, তাঁদের জন্য। ভবিষ্যতে যাঁরা খেলতে আসবেন, তাঁদের জন্য পথটা মসৃণ হবে।’
কুস্তির জন্য তাঁকে প্রচুর পরিমাণে খাবার খেতে হয়। প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হয়। অনেকে মনে করেন, মেয়েদের শরীরে শক্তি কম, তা একেবারেই মানেন না শিরিন। তিনি বলেন, ‘আমি কমনওয়েলথ গেমস খেলেছি। সামনের বছর অলিম্পিক গেমস খেলতে চাই। একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে এটা আমার স্বপ্ন।’
শিরিনের স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়ে আরও হাজারো মেয়ের স্বপ্নপূরণ হবে।

 তৌহিদা শিরোপা প্রথম আলোর সহসম্পাদক