মুহিত হাসানের অনুসন্ধিৎসু মন

মুহিত হাসান। ছবি: কবির হোসেন
মুহিত হাসান। ছবি: কবির হোসেন

মুহিত হাসানের কাজের জায়গা আর পাঁচজন তরুণের থেকে আলাদা। তাঁর বয়সী তরুণ–তরুণীদের মধ্যে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা সাধারণত কবিতা কিংবা গল্প–উপন্যাস লেখার প্রতি আগ্রহী হন। কিন্তু মুহিতের মূল আগ্রহের বিষয় পুরোনো সামাজিক ইতিহাস। এটা প্রথমেই উল্লেখ করতে হচ্ছে এই কারণে যে আমাদের তরুণসমাজ সাধারণভাবে ইতিহাসবিমুখ।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় মুহিতের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমির সাময়িকপত্র উত্তরাধিকার–এ। বিষয় ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বই মুদির দোকান। তাঁর মনে অতীতের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকানোর তাড়না জাগে খুব অল্প বয়সেই। এখন তিনি বলেন, বর্তমানের স্বরূপ ও ভবিষ্যতের দিশা লুকিয়ে থাকে অতীতের গর্ভে। তাই ইতিহাসের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ।
মুহিতের জন্ম রাজশাহী শহরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের একজন অধ্যাপকের সন্তান মুহিতের কৈশোরের বিকেলগুলো কেটেছে খেলার মাঠে নয়, ঘরের কোণে কিংবা বারান্দায়—বই আর পত্রপত্রিকা পড়ে। শুরুতে অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য কাহিনির প্রতি ছিল প্রচণ্ড আকর্ষণ। কিন্তু অচিরেই আগ্রহ ও ঔৎসুক্য জেগে ওঠে সামাজিক ইতিহাসের প্রতি। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ও বইপত্র তাঁকে টানত না, তিনি নিমগ্ন থাকতেন ‘বাইরের’ বইপত্র নিয়ে। এখন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। বলা বাহুল্য, বই সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি মা মনোয়ারা পারভীন ও বাবা আবুল হাসান চৌধুরীর সাদর সহযোগিতা পেয়েছেন। উপরন্তু সামাজিক ইতিহাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাঁর জন্য সহায়ক হয়েছে তাঁর বাবার লোকসংস্কৃতি বিষয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণা।

>মুহিত হাসান 
 অন্য ছেলেরা যখন মাঠে খেলত, তখন মুহিতের হাতে থাকত বই
 স্কুলে পড়ার সময় উত্তরাধিকার পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ
 সামাজিক ইতিহাসের প্রতি গভীর আগ্রহ
 ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৫ হাজার বই
 লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনী

সামাজিক ইতিহাসের সব প্রসঙ্গের প্রতিই মুহিতের আগ্রহ। বিশেষ আগ্রহ বোধ করেন গ্রন্থ রচনার ইতিহাস, গ্রন্থসংস্কৃতি, বিজ্ঞানের ইতিহাস ও জনজীবনে বিজ্ঞানের প্রভাবের বিবর্তনের প্রতি। উদ্ভিদজীবন থেকে শুরু করে পুরোনো দিল্লির গলিঘুঁজি অথবা সেখানে মির্জা গালিবের দিনযাপন নিয়ে তাঁর আগ্রহের শেষ নেই।
আর বই পড়া ও লেখার বাইরে তাঁর প্রধান বিনোদন গান শোনা—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে শুরু করে একালের পাশ্চাত্য গান।
উনিশ শতকের ভারতে কোম্পানি শাসন থেকে ব্রিটিশরাজের শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে যে পরিবর্তন সূচিত হয়, মুহিত হাসান সেই জায়গাটা বুঝতে চান। সামাজিক ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর পথপ্রদর্শক বিনয় ঘোষ। ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহে বিনয় ঘোষের পদাতিক-কৌশল মুহিত পছন্দ করেন। তিনি ভাবেন, হেঁটে হেঁটে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের কাজে তিনিও একদিন নামবেন। তিনি বাংলার সামাজিক ইতিহাস চর্চায় সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীপান্থ ও মুনতাসীর মামুনের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
মুহিত হাসানের প্রথম বই বিস্মৃত কথকতা: সেকালের বাংলার কতিপয় খণ্ডচিত্র (কথাপ্রকাশ, ২০১৭) হাতে নিলেই বোঝা যায়, কোথায় তাঁর অন্তর্গত ঝোঁক। তিনি এ বইয়ে এমন সব বিষয়ে লিখেছেন, যেগুলো সম্পর্কে আমাদের বিশেষ কোনো ধারণা নেই। এ বইয়ের কয়েকটি লেখার শিরোনাম—‘বাঙালির চা পান’, ‘বাঙালির সার্কাস সাধনা’, ‘বাংলায় এল রেল’ ইত্যাদি থেকেই তা বোঝা যায়।
‘স্বদেশি ফুটবল’, ‘সাহেব-মেমের চোখে বাংলার ঝড়’, ‘সেকালের বাংলা বইয়ের বিপণন ও বিক্রেতারা’, ‘সেকালের ঢাকার জলাবদ্ধতা’—এগুলো প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিক কিছু লেখার শিরোনাম। কোনো জাতির সামাজিক ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ ছবি নির্মাণে এই বিষয়গুলো যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা ছাড়া মুহিত হাসান লেখেন সহজবোধ্য ভাষায়, সব শ্রেণির পাঠকের জন্য। দেশে জনশিক্ষা প্রসার ও জনরুচি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ ধরনের লেখার গুরুত্ব বিরাট।
২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে মুহিত হাসানের দ্বিতীয় বই সৈয়দ মুজতবা আলী (কথাপ্রকাশ)। আয়তনে ছোট, কিন্তু এই অল্প জায়গায় তিনি বেশ কিছু তথ্য হাজির করেছেন, যা আগে সামনে ছিল না। মুহিতের অনুসন্ধান, তথ্য ঘাঁটা, পুরনো তথ্য যাচাই করে সুচারুভাবে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন এক নতুন মুজতবা আলী। কাজটি মুহিতকে করতে হয়েছে বইটির ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যেই। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে সামাজিক ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি বিস্মৃত কোনো বাঙালি মনীষীর জীবনকাহিনি রচনায়ও তিনি হাত দিতে পারেন।
শুধু সামাজিক ইতিহাস নয়, সৃজনশীল সাহিত্যের প্রতিও গভীর আগ্রহ বোধ করেন মুহিত হাসান; গভীর আগ্রহের সঙ্গে পড়েন কবিতা ও কথাসাহিত্য। এই প্রবণতা সমাজ–গবেষকদের বাড়তি সহায়তা জোগায়। মুহিতের এই ঝোঁক বহাল থাকলে ভবিষ্যতে আমরা তাঁর কাছ থেকে আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অজানা কোনো অধ্যায়ের খোঁজ পেয়ে যেতে পারি।

 প্রশান্ত মৃধা কথাসাহিত্যিক