জিহান করিমের দৃশ্যশিল্প

জিহান করিম। ছবি: সৌরভ দাশ
জিহান করিম। ছবি: সৌরভ দাশ

বাংলাদেশের দৃশ্যকলাজগতে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রবণতাগুলো ছাপ ফেলছে এবং তরুণ কলাযশঃপ্রার্থীদের অনেকেই এসবের চর্চা করছেন। আমরা যাকে বৈশ্বিক প্রবণতা বলছি, তার প্রায় সবটাই আসছে পশ্চিম থেকে। দৃশ্যকলার মূল প্রশাখা চিত্র, ভাস্কর্য ও ছাপরীতির ছবি—এমনটাই প্রচলিত ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী।

প্রায় এক শ বছর আগে ইউরোপে দাদাবাদী শিল্পীদের মাধ্যমে দৃশ্যকলায় রূপবদলের আকাঙ্ক্ষাটি প্রকাশ পেতে শুরু করে আর বিগত শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই পরিবর্তনের নানা নিরীক্ষা চলতে থাকে। চিত্রকলায় তুলির পরিবর্তে হাতের সঞ্চালনে রঙের প্রক্ষেপণ বা ভাস্কর্যে আলো, শব্দ ও গতির প্রয়োগ এর আদি লক্ষণ। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক পূর্তির মুখে স্থাপনা (ইনস্টলেশন), বডি আর্ট, স্থান-নির্দিষ্ট (সাইট-স্পেসিফিক) আর্ট, ভিডিও আর্ট, পারফরম্যান্স এসে ভিজ্যুয়াল আর্ট আর পারফর্মিং আর্টের পার্থক্যও প্রায় ঘুচিয়ে ফেলেছে। উপকরণের সীমারেখাও প্রায় বিলীন হতে বসেছে। চিত্র-ভাস্কর্য-ছাপাবস্তুর সঙ্গে ভিডিও-শব্দ-আলো-পারফরম্যান্স মিলে মাল্টিমিডিয়া, পার্টিসিপেটরি, ক্রসকালচারাল—এমন সব নামে শিল্পবস্তু নির্মিত হচ্ছে, কখনো একা, কখনো অনেকে মিলে। আর উপকরণ হিসেবে পচা-গলা থেকে জীবন্ত কিংবা কুড়িয়ে পাওয়া থেকে গ্যাস-বাতাসের মতো অবয়বহীন বস্তুর ব্যবহারও বাকি নেই। দৃশ্যকলার এ বন্ধনহীন প্রকাশ-স্বাধীনতা একে দিয়েছে নানা বৈচিত্র্যময় সৃজনের সুযোগ, স্থাণু রূপবন্ধের সীমা ভেঙে দিয়েছে গতিময়তা আর অংশীদারত্বের প্রসারণ ।
তবে এতে কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে, মূলত শিল্পকর্ম বিচারের ক্ষেত্রে। দাদা শিল্পী মার্সেল দুশোঁ শ বছর আগেই বলে রেখেছেন: মানবসৃষ্ট যা কিছু, সবই শিল্প। নিজে তার প্রমাণ রেখেছেন যন্ত্রে উৎপাদিত ইউরিনালকে শিল্পকর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে (১৯১৭)। এতে উৎসাহিত হয়ে অপরিপক্ব শিল্পী বা অশিল্পীও কিছু উপস্থাপন করে বলতে পারেন, এটি শিল্পকর্ম। ফলে কোনটা শিল্প আর কোনটা শিল্প নয় তা নির্ধারণে ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন শুধু শিল্পানুরাগী নন, নিবিষ্ট দর্শকও। এতে বিতর্ক জমেছে শিল্প-বিশেষজ্ঞ বা সমালোচকদের মধ্যেও।

>জিহান করিম 
 ২০১২: এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত আ সিম্পল ডেথ। 
 ২০১৬ এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত সেভেন সেন্সেস

তবে এ ডামাডোলের মধ্যেও সত্যিকারের সৃজনসমৃদ্ধ, স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বা অর্থপূর্ণ শিল্পকর্ম চিনে নেওয়া অসম্ভব নয়। যেসব সাম্প্রতিক শিল্পধারার কথা উল্লেখিত হলো, তার অধিকাংশই বাংলাদেশে দৃশ্যকলার তরুণ শিল্পীরা চর্চা করছেন; কেউ কেউ মানসম্পন্ন শিল্পকর্ম রচনা করছেন। কারও কারও কাজ বিদেশে প্রদর্শনের জন্য মনোনীত-আমন্ত্রিতও হচ্ছে। ভিডিও মাধ্যমটি কখনো কখনো মিশ্র রচনার অংশ হয়ে চর্চিত হচ্ছে, আবার অনেকটাই স্বাধীন ও একক প্রকাশমাধ্যম হিসেবেও রচিত হয়ে চলেছে। যাঁরা মূলত ভিডিও মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করে চলেছেন, জিহান করিম তাঁদের অন্যতম।
জিহান করিমের জন্ম চট্টগ্রামে, ছাত্রজীবনও কেটেছে চট্টগ্রামে। দৃশ্যকলায় শিক্ষা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। ২০১২ সালে স্নাতকোত্তর শেষে পরের বছর এখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে কর্মরত। চিত্রকলার ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তাঁর কাজে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দৃষ্টিগোচর হয়। আর বি কিতাজ, ফ্রান্সিস বেকন, ডেভিড হকনির ছায়া তাঁর প্রারম্ভিক কাজে অনুভব করা যায়, যা সূচনাপর্বে স্বাভাবিক। তবে জিহান খুব দ্রুতই প্রযুক্তির নানা কৌশলে শিল্পরচনার সুযোগ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে পড়েন, যা তাঁকে ভিডিও মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশের পথে উৎসাহিত করে। শতবর্ষ আগে চলমান চিত্রের আবিষ্কার চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে ইতিমধ্যেই শক্তিশালী সৃজনমাধ্যম হিসেবে প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছে। তবে আজকের ভিডিও–শিল্প চলচ্চিত্র থেকে নিজের কিছু পার্থক্য রচনা করেছে। ভিডিও চিত্র একেবারেই স্বল্পদৈর্ঘ্য হয়ে থাকে এবং সাধারণভাবে এতে তেমন কোনো কাহিনি থাকে না। চিত্রধারণ ও প্রক্ষেপণের মধ্যে কারিগরি চাতুর্যের প্রাধান্য থাকলেও নান্দনিক সার্থকতা ও তাৎপর্যময়তা এরও মুখ্য উদ্দেশ্য।
জিহান করিমের চিত্রকর্মে স্থান ও কালচেতনার যে আভাস দেখা দিচ্ছিল ভিডিও মাধ্যমের কাজগুলোতে, সেটি অব্যাহত রাখার প্রয়াস রয়েছে। উপস্থাপনে সমকালীন প্রযুক্তির সর্বশেষ সুবিধাকেও তিনি আত্মস্থ করতে আগ্রহী, ফলে সাধারণভাবে তাঁর ভিডিও উপস্থাপনকে প্রথমত পশ্চিমা রীতির অনুগমন মনে হতে পারে। তবে জিহান নতুন এ মাধ্যমে শিল্পরচনায় নামার আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়ার সুযোগগুলো হাতছাড়া করেননি। চলচ্চিত্র দর্শন ও ভিডিও নির্মাণের কর্মশালায় যোগ দিয়ে কারিগরি দক্ষতা ও চলমানতার অভ্যন্তরে শৈল্পিক অভিব্যক্তিকে প্রকাশের সুযোগগুলো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ঋত্বিক ঘটক বা আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্র তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। এভাবে অগ্রসর হয়ে তিনি ২০১০ সালে ভিডিও চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন, ‘দ্য চেস গেম’ তাঁর প্রথম প্রয়াস। ২০১২ সালে ‘উই দ্য পিপল’ আর ‘আ সিম্পল ডেথ’-এর মাধ্যমে তিনি শিল্পানুরাগী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, শেষোক্তটি ওই বছর দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হয়। এ পর্যন্ত তাঁর উল্লেখযোগ্য ভিডিও চিত্রের মধ্যে ‘লাইট ফাইটস ডার্কনেস, ডার্কনেস ফাইটস লাইট’, ‘নিওক্লিয়ার পাওয়ার্ড টুথব্রাশ’, ঢাকা আর্ট সামিটে প্রদর্শিত ‘আই’, ‘দ্য রিয়ার উইনডো’, ২০১৬ এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত ‘সেভেন সেন্সেস’ ইত্যাদিকে বিবেচনায় নেওয়া যায়।
এসব এবং অন্য আরও কিছু ভিডিও চিত্রের ছোট ছোট অনুপুঙ্খ অনুসরণ করে আমরা তার সূচনাবিন্দুতে পৌঁছাতে পারি এবং দেখে নিতে পারি তাঁর বয়ানের কেন্দ্র-পরিসর নির্মিত হয়েছে স্থানিক কোনো অভিজ্ঞতাকে আবর্তন করে। মনে করি, এখানেই জিহান করিম তাঁর স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট করে তোলেন। তাঁর ভাবনায় বা স্মৃতিতে রক্ষিত ইমেজগুলোকে তিনি ব্যবহার করতে পারেন আধুনিকতম প্রযুক্তির আধারে আর সমসাময়িকতার পাটাতনে তাকে পুনর্নির্মাণ করে এই বিক্রিয়াটিকে শৈল্পিক কাঠামোয় উপস্থাপন করার সক্ষমতা জিহান অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের আগামী দিনের দৃশ্যশিল্পের রূপরেখা জিহান করিমের মতো তরুণ শিল্পীরাই নির্মাণ করবেন, এমন প্রত্যাশা অবশ্যই করা যায়।

 আবুল মনসুর চিত্রশিল্পী ও দৃশ্যকলা বিষয়ক লেখক