মঞ্চ আলো করা জ্যোতি সিনহা

জ্যোতি সিনহা। ছবি: আনিস মাহমুদ
জ্যোতি সিনহা। ছবি: আনিস মাহমুদ

সরল মেয়েটি খুব জেদি। সে জেদ সৃষ্টিশীলতার।

কহে বীরাঙ্গনা নাটকটি জ্যোতি সিনহাকে নিয়ে গেছে এক নবীন উচ্চতায়। একই নাটকে মহাভারতের চারটি চরিত্র (শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা আর জনা) ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি অনবদ্য শৈল্পিক অভিনয়ে। এ নাটকের ৪৯তম ও ৫০তম মঞ্চায়ন হয়েছিল ঢাকায়, পরপর দুই দিন। ৪৯তম মঞ্চায়নে কী যেন হয়ে গেল জ্যোতির। মন লাগল না অভিনয়ে। মন ভরেনি নির্দেশক শুভাশিস সিনহারও। শো শেষে শুভাশিস জ্যোতিকে বললেন, ‘তোমাকে দিয়ে মনে হয় আর হবে না। তুমি এই শো করা বন্ধ করে দাও।’
জেদ চেপে গেল জ্যোতির মাথায়। মহড়া শুরু করলেন একা একা। প্রতিটি সংলাপ আলাদাভাবে উচ্চারণ করলেন। মহড়াই হয়ে গেল ধ্যানজ্ঞান এবং এরপর ৫০তম মঞ্চায়নে তিনি যা করলেন, তা হৃদয় ছুঁয়ে গেল সবার। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নতুন করে চেনারও শুরু হলো তখন থেকে।

২.
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মেয়ে জ্যোতি শৈশবেই নাচ–গানের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। বিটিভিতে লায়লা হাসানের ‘এসো নাচ শিখি’ অনুষ্ঠানে গিয়ে নাচের সঙ্গে পরিচয়। কিছুদিন গান শিখেছেন রামকানাই দাশের কাছে। পরে মণিপুরি থিয়েটারের শর্মিলা সিনহার কাছেও গান শিখেছেন। ১৯৯৬ সালের ২ জানুয়ারি জ্যোতির বাবা মারা যান। তখন জ্যোতির বয়স ১২ বছর। সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে বাবার লাশ নিয়ে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ফেরা এবং সেখানেই থিতু হওয়া। সে বছরই শুভাশিস সিনহা মণিপুরি থিয়েটারের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৯৭ সালের পয়লা বৈশাখে কিশোরী জ্যোতি বিষু উৎসবের নাটক আজবপুরের বর্ষবরণ–এ রাজকন্যার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এরপর থেকে মণিপুরি থিয়েটারের অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।

>জ্যোতি সিনহা 
 জন্ম সিলেটে। ১৯৮৪ সালের ২৯ নভেম্বর
 জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন। পাশাপাশি মণিপুরি থিয়েটারে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে এমএস করেছেন নৃবিজ্ঞানে, এমফিল করেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ২০১৭ সালে।
 মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকর্তা তিনি।
 মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটক থেকে মণিপুরি থিয়েটারের শুভাশিস সিনহা সম্পাদনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত জ্যোতি কহে বীরাঙ্গনার ৭১টি মঞ্চায়ন করেছেন।

জীবনের একটা বাঁক ছিল শূন্য দশকের শুরুতে। ২০০০ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় মঞ্চে এসেছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। ২০০১ সালে ঢাকায় নাটকটি মঞ্চস্থ হলে সাড়া পড়ে যায়।
২৫টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন জ্যোতি। নিজ দল মণিপুরি থিয়েটারের ইঙাল আধার পালা, দেবতার গ্রাস, ভানুবিল, ঢাকা থিয়েটার ও থিয়েটার আর্ট মিলে হৃৎমঞ্চ রেপার্টরিতে করি রুধির রঙ্গিনী।

৩.
মেয়েটা খাটতে পারে। মেয়েটার নানা বিষয়ে আগ্রহ। আর মণিপুরি থিয়েটারটাই এমন যে সে আগ্রহ মেটানোর নানা উপকরণ রয়ে গেছে সেখানে। যেমন দাঁড়ি–কমা ছাড়া একটি কবিতা দিয়ে দেওয়া হলো হাতে, পড়ার সময় বুঝতে হবে থামতে হবে কোথায়। কিংবা সংগ্রহ করা হলো অস্কারজয়ী সিনেমা, শুধু তা–ইবা কেন, ইরানি ছবি, কোরিয়ান ছবি, লাতিন ছবিও দেখা হয় দল বেঁধে। তারপর সে ছবি, ছবির অভিনয় নিয়ে কথা হয় সবাই মিলে।
উচ্চারণের বিষয়টা শেখা হয় খুব মন দিয়ে। কথা বলার শিল্প মূর্ত হয়ে ওঠে সংলাপে।
জ্যোতি রাজধানীতে থাকতে চাননি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে গেছেন নিজের ডেরায়, কমলগঞ্জে। মৌলভীবাজার শিল্পকলা একাডেমিতে কাজ করছেন তিনি। শিল্পী হিসেবে তাঁকে অনেক সহযোগিতা করে কর্তৃপক্ষ।

৪.
সংস্কৃতি নিয়েই কাজ জ্যোতির। কিন্তু খেলাধুলায়ও রয়েছে তাঁর সাফল্য। খুব ভালো হাইজাম্প আর লংজাম্প দিতে পারেন। দৌড়াতেও পারেন ভালো। আর ভালোবাসেন কবিতা। বিনয় মজুমদারের কবিতা গোগ্রাসে গিলতে থাকেন। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আরও অনেক কবির কবিতা পড়তে ভালোবাসেন। অড্রে হেপবার্ন আর সোফিয়া লরেনের সিনেমা পেলে দেখতে বসে যান। এই দুজনের অভিনয়ের দারুণ ভক্ত তিনি।

৫.
‘জ্যোতি, এখন কী পড়ছেন?’ প্রশ্ন আমার।
‘নাটকের বই পড়ছি বেশি। এখন পড়ছি স্যামুয়েল বেকেটের হ্যাপি ডেইজ।’
‘দেশি নাটক পড়েন না?’
‘পড়ব না কেন?’ হাসি। ‘কিন্তু ফ্রেঞ্চ এম্বাসির সঙ্গে কথা হচ্ছে। ওদের সহায়তায় এই নাটক হতে পারে।’

৬.
এই বাংলাদেশটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন জ্যোতি সিনহা। দেশের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘দেশ তো আমার ভালোবাসার জমিন। আমার একটা স্বাধীন দেশ আছে, এই অনুভূতি যে কী আনন্দের! সেই আনন্দও তো আমাকে শিল্পী করে তোলে। রাষ্ট্রের ইতি–নেতি নানান রূপ প্রকাশ পায়, সংকট তৈরি হয়, কিন্তু দেশ তো দেশই। তার সঙ্গে আমার আজন্মের নাড়ির টান। শিল্প যখন দেশের মাটির কাদাজলে তৈরি হয়, গড়ে ওঠে, তার সৌন্দর্য আবেদন অনুপম। আমি সেই শিল্পের আরাধনা করি, যা আমার নিজের, দেশের হয়েও বিশ্বের সবার।

৭.
জ্যোতি সিনহা যে ভালো অভিনয় করেন, সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি তাঁর মেধা আর চর্চা দিয়েই মঞ্চকে সুরভিত করে যাচ্ছেন। তাঁর সম্পর্কে আরেকটি তথ্য জানা থাকলে মন ভরে যাবে সবার। জ্যোতি ঢাকা বা অন্য কোথাও চাকরি করতে চাননি। নৃবিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে স্থিত হতে চেয়েছেন নিজের এলাকায়। বলেছেন, টাকা যত কমই হোক, চাকরি করবেন নিজের এলাকায়, আর নাটকে ঢেলে দেবেন মন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা গ্রামে রয়েছে তাঁদের স্টুডিও থিয়েটার নটমণ্ডপ। নিয়মিত সেখানেই নাটক করেন তিনি। কমলগঞ্জ থেকেই তিনি ছড়িয়ে পড়েন গোটা বাংলাদেশে, তারপর দেশের বাইরেও ছড়িয়ে যায় তাঁর অভিনয়ের সুরভি।

 জাহীদ রেজা নূর প্রথম আলোর উপফিচার সম্পাদক