শূন্য থেকে ব্র্যান্ড

শুরুতে পোশাকই ছিল শৈল্পিকের একমাত্র পণ্য। পোশাক বিক্রির সাফলে্য প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এইচ এম ইলিয়াছ গড়ে তুলেছেন আসবাব তৈরির নতুন প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের এই ব্র্যান্ড এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে।  সৌরভ দাশ
শুরুতে পোশাকই ছিল শৈল্পিকের একমাত্র পণ্য। পোশাক বিক্রির সাফলে্য প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এইচ এম ইলিয়াছ গড়ে তুলেছেন আসবাব তৈরির নতুন প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের এই ব্র্যান্ড এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। সৌরভ দাশ

গ্রাম থেকে এসে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এইচ এম ইলিয়াছ। থাকতেন অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যাচেলর বাসায়। দিনে ক্লাস, আর রাতে বসে পড়তেন কাগজ-পেনসিল নিয়ে। চলত আঁকাআঁকি। করতেন নানা নকশা। একসময় ব্যবসায়িক চিন্তা মাথায় আনেন। মা–বাবা ও ভাইদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা চেয়ে নিলেন। তখন রোজা সামনে। বাজারের পাঞ্জাবিতে খুব বেশি বৈচিত্র্য ছিল না। নামী ব্র্যান্ডও ছিল কম। টেরিবাজার থেকে পাঞ্জাবির কাপড় কিনে হরেক রকমের নকশা তৈরি করলেন। সেলাইয়ের কাজে অভিজ্ঞ মহিলাদের দিয়ে সেই নকশা ফুটিয়ে তোলা হলো পাঞ্জাবিতে। তৈরি হলো ১০০ পাঞ্জাবি। রোজার ঈদের আগে পরিচিতজন ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিলেন। তবে লাভ হলো না। কোনোভাবে বিনিয়োগের টাকা উঠে আসে। সেই শুরু।

কলেজের পড়া শেষে কী করবেন, এমন চিন্তা শেয়ার করলেন পরিচিতজনদের সঙ্গে। ব্যাচেলর বাসায় বড় ভাইয়েরা পরামর্শ দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগই তোমার জন্য জুতসই হবে। ভর্তি পরীক্ষাও দেন। কিন্তু প্রথমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় নামই আসেনি তাঁর। হাল ছাড়েননি। দ্বিতীয়বার আবার ভর্তি পরীক্ষায় বসলেন। এবার মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান।

ব্যবসায়িক পরিবারে বেড়ে ওঠা ইলিয়াছের মা–বাবা চারুকলায় পড়া পছন্দ করেননি। কারণ তাঁদের কাছে চারুকলা মানে বাউন্ডুলে জীবন। পরিবারের ইচ্ছা ছিল, কলেজের পড়া শেষে বিদেশে থাকা ভাইদের কাছে চলে যাবেন ইলিয়াছ। তিনবার ভিসাও পাঠিয়েছিলেন ভাইয়েরা। সবকিছু প্রস্তুত করে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করে দেন তিনি। যা করবেন, দেশে থেকেই করবেন। বাবার তখন চট্টগ্রামের মাদারবাড়িতে ছোটখাটো আইসক্রিম কারখানা। সেখানে কিছু সময় দেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পড়াশোনায় মন দেন তিনি। প্রথম বর্ষে প্রথম স্থানও অর্জন করেন। তবে ভালো লাগছিল না তাঁর।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দিন কেটে যেত প্রদর্শনী ও ফ্যাশন হাউসে ঘোরাঘুরি করে। কোথাও প্রদর্শনী হলে ছুটে যেতেন। ঘুরতেন তখনকার সময়ের বিখ্যাত চারু চট্টগ্রাম, রমণীয়া, ডলস হাউসের মতো ফ্যাশন হাউসগুলোতে। ঘুরে ঘুরে দেখতেন নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক। নিজের মধ্যেও তখন তাঁর জেগে ওঠে পোশাকের নকশা করার ভাবনা। বন্ধুদের সঙ্গে নিজের চিন্তা ভাগাভাগি করলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে এসে পাঁচ বন্ধু মিলে ঢঙ নামে প্রথম প্রদর্শনী করেন শিল্পকলায়। সাড়াও পান। উৎসাহ বাড়তে থাকে তাঁর। প্রদর্শনীতে ছিল শাড়ি, পাঞ্জাবি ও থ্রিপিস। প্রদর্শনী করেও পুরোপুরি তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। প্রদর্শনীতে সাড়া পাওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা জাগে তাঁর। তখন ক্লোজআপ ওয়ান প্রথম পর্ব ছিল ফ্যাশন প্রতিযোগিতায়। দেরি না করে অংশ নিলেন সেই প্রতিযোগিতায়। প্রথমবারই সেরা দশে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। এরপরই যখনই কোনো প্রতিযোগিতার খবর পেতেন, নতুন নকশায় পোশাক তৈরি করে অংশ নিতে থাকেন। প্রথম আলোর ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় প্রথমবারই অংশ নিয়ে কয়েকটি বিভাগে পুরস্কার জিতে নেন। পড়াশোনা আর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই কেটে যায় বিশ্ববিদ্যালয়জীবন।

এইচ এম ইলিয়াছ।  প্রথম আলো
এইচ এম ইলিয়াছ। প্রথম আলো

পড়াশোনা শেষে কী করবেন? বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষে তাঁর বন্ধুরা চাকরির সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বন্ধুদের মধ্যে ইলিয়াছেরই আগ্রহ ছিল না চাকরি করার। বিপরীত পথে হাঁটলেন তিনি। প্রদর্শনী আর প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে তত দিনে তাঁর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। দেরি না করে মনস্থির করলেন, পোশাকে ফুটিয়ে তুলবেন বৈচিত্র্য। আগ্রাবাদের মৌলভীপাড়ায় ছোট একটি কক্ষে একজন কারিগর নিয়ে কারখানা খোলেন। কারখানায় বানানো পোশাক তো বিক্রি করতে হবে। ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুর ব্যাংকক মার্কেটে প্রথম শৈল্পিক নামে শোরুম খোলেন। নিজ বাসায় বসে নকশা করতেন। তারপর সেই নকশা কারিগরকে দিয়ে পোশাকে ফুটিয়ে তুলতেন। এরপর সেই পোশাক শোরুমে নিয়ে আসতেন।
দিন–রাত তাঁর ভাবনায় ছিল নিত্যনতুন নকশা তৈরি। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জয়ের খবর তখন ছড়িয়ে পড়েছিল শৈল্পিকের। ব্যবসা থেকে আসা মুনাফার বড় অংশই বিনিয়োগ করতে থাকলেন। কারখানার পরিসরও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে শোরুমের সংখ্যাও। চার বছরের মাথায় চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকার বেইলি রোডে ২০০৭ সালে শোরুম খোলেন তিনি।
প্রথম আলোর ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় টানা হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হন ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। যাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তত দিনে তাঁদের ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটে তাঁর ২৮টি শোরুম আছে। কারখানাও বড় হয়েছে। ২০ হাজার বর্গফুটের কারখানায় কাজ করছেন ২০০ জন কর্মী। সব মিলিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীর সংখ্যা এখন প্রায় ৩০০। নিয়মিতই বাড়ছে কর্মীর সংখ্যা। এর মধ্যে আছে ডিজাইনারও। এখন বছরে ১ লাখ পোশাক তৈরি হয় তাঁর কারখানায়।
পোশাকের ব্যবসায় সাফল্য অর্জনের পর হঠাৎ তাঁর মাথায় এল শুধু পোশাক নিয়ে কেন থাকবেন। পোশাক তো বেশি সময়ের জন্য নয়। তাঁর সৃষ্টি তো কয়েক মাস বা বছরের বেশি লালন করবেন না গ্রাহকেরা। এমন কিছু করতে মন চাইছিল, যা তাঁর সৃষ্টিকে এক-দুই দশক বা তারও বেশি সময় লালন করবেন গ্রাহকেরা। তাঁর সৃষ্টির প্রদর্শনী এক-দুই দিনের জন্য নয়, বহু বছরের জন্য হতে হবে। এমন চিন্তা থেকেই আসবাবপত্রে বিনিয়োগের চিন্তা আসে তাঁর। ২০১৪ সালে শুরু করেন আসবাবপত্রের ব্যবসা। প্রথমে ছোট আকারে কারখানা গড়ে তোলেন সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশায় নিজেদের জায়গায়। পরে তা নিয়ে আসেন শহরের দেওয়ানহাটে। সম্প্রতি কাজীর দেউড়ি এলাকায় ছয়তলার একটি অত্যাধুনিক বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। পোশাকের পর আসবাবপত্রেও সাফল্য ধরা দিতে থাকে। আসবাবপত্রে শত রকমের বৈচিত্র্য তুলে আনেন তিনি। নিজের নকশা ফুটিয়ে তোলেন আসবাবপত্রে।
ইলিয়াছের এগিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কী আছে? জানালেন, যাঁরা সৃষ্টি করেন, তাঁদের মানুষের আগ্রহ নিয়েও কাজ করতে হবে। গ্রাহক কী চান তা জানতে হবে। এখন বিশ্ব হাতের মুঠোয়। সমসাময়িক বৈশ্বিক প্রবণতা যেমন জানতে হবে, তেমনি মানুষের রুচিবোধ পরিবর্তনেও নজর রাখতে হবে। তাহলে শিল্পীর সৃষ্টি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকবে।
ইলিয়াছ যে এখনো মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করেন, তা তাঁর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে প্রমাণ মেলে। ডিজাইনার বা কর্মীরা থাকলেও এখনো প্রতিদিন নিয়ম করে কারখানা আর শোরুমে বসেন তিনি। নিজেই ডিজাইন করেন পোশাক বা আসবাবপত্রের। আবার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ডিজাইনারদের ডিজাইন দেখে নির্বাচন করেন। সন্ধ্যায় বিক্রয়কেন্দ্রে বসে কথা বলেন গ্রাহকের সঙ্গে। তাঁর কথায়, গ্রাহক কী চান তা বুঝতে হলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। গ্রাহকদের নিয়ে কাজ না করলে সাফল্য আসবে না। যাঁরা গ্রাহককে প্রাধান্য দেননি, তাঁরা সফল হতে পারেননি।
যে চারুকলায় প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঠাঁই হয়নি তাঁর, সেই চারুকলার ক্লাসে শিক্ষকেরা এখন তাঁর উদাহরণ টানেন। চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁর কথাই বেশি আলোচনা হয়। চারুকলার শিক্ষার্থীদের চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজের চেষ্টায় উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ তাঁর। ইলিয়াছ মনে করেন, বাজারে যত পণ্য আছে তা গ্রাহকদের কাছে তুলে ধরতে হলে পণ্যের মানের পরে নকশা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার এখানে বড় সন্তুষ্টি হলো পোশাক বা আসবাবে নিজের শিল্পকর্ম করে তা বিক্রি করছেন। আবার তাঁর সৃষ্টি গ্রাহকেরা ধরে রাখছেন। এর চেয়ে বড় সন্তুষ্টি আর কোথায় আছে? মানুষের ঘরে ব্যবহৃত পণ্যটাই তো তাঁর প্রদর্শনী।
এখন অনেক ঘরে ঘরে ইলিয়াছের প্রদর্শনী চলছে। এই যেমন শৈল্পিকের পোশাক বা আসবাবপত্র ঘরের অনেক কক্ষে জায়গা করে নিয়েছে। যেখানে আছে ইলিয়াছের সৃষ্টি। শুধু এটুকুতে থামতে চান না ইলিয়াছ। মানুষের লাইফস্টাইল বা জীবনযাপনের সবকিছুতেই তিনি তুলির আঁচড় দিতে চান। সেই চিন্তা থেকে পণ্যে নতুন নতুন বৈচিত্র্য দিতে চান তিনি।