ভাগ্য বদলের দিশারি

বান্দরবান-চিম্বুক সড়কে জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বসন্ত ম্রোপাড়ায় নিজের গড়ে ফলের বাগানে চাষি  তোয়ো ম্রো।  প্রথম আলো
বান্দরবান-চিম্বুক সড়কে জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বসন্ত ম্রোপাড়ায় নিজের গড়ে ফলের বাগানে চাষি তোয়ো ম্রো। প্রথম আলো

চিম্বুক পাহাড়ের একজন দরিদ্র জুমচাষি নতুন ধরনের চিন্তা করে নিজের ভাগ্য যেমন ফিরিয়েছেন তেমনি তাঁর সমাজের মানুষকেও দেখিয়েছেন ভাগ্য বদলের পথ। তোয়ো ম্রো নামের এই চাষির ফলের বাগান আর সেই বাগানের ফল বিক্রির আয় দেখে বিস্মিত ম্রো সমাজের মানুষ। সনাতনী জুমচাষের বিকল্প হিসেবে ফলের বাগান করার কথা ভাবল তারাও। এখন চিম্বুক পাহাড়ের অধিকাংশ ম্রো কমবেশি ফলের বাগানি। বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে গেলেই মনোরম সেই বাগানের দৃশ্য চোখে পড়ে। চিম্বুক ফল চাষি সমবায় সমিতির সভাপতি পাসিং ম্রোর মতে, তোয়ো ম্রোর প্রদর্শিত পথে উদ্বুদ্ধ হয়ে বর্তমানে ৭০ শতাংশ ম্রো কোনো না–কোনো ফলের বাগান করে। সচ্ছলতা এসেছে তাদের জীবনে।

শুধু চিম্বুক পাহাড়ের ম্রোরা নয়, রুমা ও থানচি থেকে ত্রিপুরা ও বমরাও দলে দলে আসছে বাগান দেখতে। ড্রাগন, আম, আপেলকুল, সফেদা বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছে তারা। পরিকল্পিত ও পরিচ্ছন্ন বাগান দেখে অভিভূত লোকগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছে। বাগানে সেচের জন্য স্তরে স্তরে উঁচু জায়গায় পানির ট্যাংক বসানো হয়েছে। খাঁড়া পাহাড়ি ঝরনার প্রবাহে পাইপলাইন বসিয়ে প্রাকৃতিক স্রোতে পানি সরবরাহের সংযোগ টানা হয়েছে। যখন প্রয়োজন কল খুলে দিলে স্বয়ংচালিত স্রোতে বাগানে সেচ দেওয়া যায়। তোয়ো ম্রো জানালেন, প্রায় সময়ই তাঁর বাগান দেখার জন্য লোকজন আসে। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি থেকে ইউএনডিপি ও এনজিওর উপকারভোগীরা দল বেঁধে আসে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও দেখে যায়। তিনি নিজেও বাগানের জন্য বিভিন্ন জনকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ জন্য তাঁকে অনেকে তোয়ো মাস্টার বলেও ডাকেন।
বান্দরবান-চিম্বুক সড়কে জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বসন্ত ম্রোপাড়ার রাস্তার মাথা। সড়ক থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ভেতরে গেলে বসন্তপাড়াটির দেখা মেলে। সেখানেই ১৯৬৯ সালে তোয়ো ম্রোর জন্ম। বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালকে অবস্থিত ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। দরিদ্র পরিবারে মা-বাবাকে দেখাশোনা ও কাজ করার মানুষ কেউ ছিল না। এ কারণে আবাসিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা ছেড়ে জুমচাষে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এক বছরের খোরপোষের জুমচাষ, প্রতিবছর জমি বদল। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জুমের জমির ওপর চাপ পড়ছে। আগের মতো আর ফসল হয় না। পরিবারের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এক বেলা জোটে তো আরেক বেলা খাবার জোটে না। দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা। সেই সময়ে একদিন ওয়ার্ল্ড ভিশনের কৃষক প্রশিক্ষণে জেলা শহরে এসেছিলেন। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসি) উচ্চ ফলনশীল রেড লেডি পেঁপে চাষ দেখানোর জন্য তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। রেড লেডির উচ্চ ফলন দেখে বাগান করার মনস্থির করেন তোয়ো ম্রো।
২০০৫ সালে বিএডিসি থেকে রেড লেডির চারা নিয়ে বাগান শুরু করেন। শুরুর বছরেই ৩ লাখ টাকা আয় করে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজেও অবাক হয়েছিলেন ফলের বাগানে এত লাভ দেখে। জীবনে সেই প্রথম লাখ টাকা গুণে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
তখন থেকে জুমচাষ ছেড়ে দিয়ে শুধু বাগান করছেন। ২০০৭ সাল থেকে আম বাগান শুরু করেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি ও ওয়ার্ল্ড ভিশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাংগোয়াই, আম্রপালি, মল্লিকাসহ বিভিন্ন জাতের আমের বাগান করেছেন। তবে লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় জাতের রাংগোয়াই সবচেয়ে বেশি লাগিয়েছেন।
সফল বাগান চাষি হিসেবে পার্বত্যাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তোয়ো ম্রোর নাম। তিনি নিজেও চিম্বুক ফল চাষি সমবায় সমিতি গঠন করে সড়কের আশপাশে বসবাসরত লোকজনকে জুমচাষ ছেড়ে ফলের বাগান করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এভাবে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রোলংপাড়া থেকে শুরু করে থানচির সীমানায় জীবননগর পর্যন্ত ম্রো সড়কের দুই পাশে অসংখ্য বাগান গড়ে উঠেছে। ২৫টি ম্রো পরিবারের সবাই এখন ফল বাগানের মালিক। আগের জুমচাষের সময়ের চেয়ে এখন তাঁদের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো। তোয়োর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। দুই ছেলে মিশন স্কুলে পড়াশোনা করে। বড় ছেলে তাঁর সঙ্গে বাগানের কাজ করে। পাশের পোড়াপাড়ায় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে জামাইকে কিছু বাগান দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জামাই সেই বাগান না নিয়ে নিজেই বিশাল বাগান করেছেন।
চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোলংপাড়া থেকে ডিম পাহাড় ও রংরাং পাহাড় (চিম্বুক পাহাড় শ্রেণি বা হিল রেঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নাম হয়েছে) হয়ে মিয়ানমার সীমানা পর্যন্ত যুগ যুগ ধরে শুধু ম্রো জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বান্দরবান পার্বত্য জেলার পাহাড়ি জনসংখ্যার মধ্যে মারমাদের পরে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্রোরা। কিন্তু শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে তারা সবচেয়ে অনগ্রসর হওয়ায় ১৫-২০ বছর আগেও শতভাগ জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তোয়ো বাগান শুরু করার পর জেলা শহরের ১২ কিলোমিটার দূরে ম্রোলংপাড়া থেকে জীবননগর পর্যন্ত অধিকাংশ ম্রো আর জুমচাষ করে না।
সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে পাড়ার পূর্ব পাশে আমের বাগান দেখিয়ে তোয়ো ম্রো জানান, আমে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। এ কারণে ড্রাগন ও আপেলকুলে মনোযোগ দিয়েছেন। বর্তমানে তিন একর জমিতে ৭০০টি আপেলকুলের গাছ রয়েছে। প্রায় ১০ একর জমিতে ২ হাজার ৫০০ আম্রপালি, হাঁড়িভাঙা, মল্লিকা, স্থানীয় জাতের রাংগোয়াই, ও মিশ্রফল এবং দেড় একর জমিতে ৫৩৫টি খুঁটিতে ১ হাজার ৯৬০টি ড্রাগনগাছের বাগান রয়েছে। এ বছর আপেলকুলে ৮ লাখ ও ড্রাগন ফলে ২ লাখ টাকা আয় করেছেন বলে জানালেন তোয়ো।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তোয়ো ম্রো বলেন বাগান করা এবং বাগান করানো হচ্ছে তাঁর কাজ। বাগান চাষিদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শমূলক সভা আয়োজন করেন। সভায় কৃষিবিজ্ঞানীদের নিয়ে এসে বাগান সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকেন। তোয়ো বলেন ‘কৃষি প্রশাসনের অনেকে কৃষি পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে অনুরোধ করেছেন। আমি পুরস্কার দরকার নেই বলে দিয়েছি। আমি নিজের বাগানের কাজ করি, ফলে ফলে বাগান ভরে উঠলেই তো পুরস্কার পাওয়া হয়ে যায়।’
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, তোয়ো ম্রো এক প্রচারবিমুখ আদর্শ বাগানি। নিজে বাগান করে এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে চিম্বুক পাহাড়ের কৃষি পরিবেশকে তিনি বদলে দিয়েছেন। বর্তমানে চিম্বুক পাহাড়ের পাড়ায় পাড়ায় ফলের বাগান, সবজি বাগান। এ পরিবর্তনের দিশারি হলেন তোয়ো। তিনি শুধু বাগান করেন না, বাজারের সঙ্গে সংযোগ, কৃষি কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ—সব দিক দিয়ে তিনি অগ্রপথিক। কিন্তু কোনো পুরস্কারের জন্য আগ্রহী নন। তাঁর বাগান নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি ও টেলিভিশনে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু তিনি পুরস্কারের জন্য ওই সব সংগ্রহ করেও রাখেননি।