চোখের আলোয়...

কক্সবাজারের বায়তুশশরফ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর রোগীদের নানা বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিশ্বজিৎ পাল (মাঝে)।  প্রথম আলো
কক্সবাজারের বায়তুশশরফ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর রোগীদের নানা বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিশ্বজিৎ পাল (মাঝে)। প্রথম আলো

চোখ মানেই জগতের আলো। যাঁরা অন্ধ, দেখতে পান না, হয়তো তাঁরাই কেবল বুঝতে পারেন বেঁচে থাকার জন্য চোখের গুরুত্ব কতখানি।

জন্মান্ধ না হয়েও অসুখবিসুখ বা দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে মানুষ। শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে অনেকেই চোখের ছানি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে (চোখে লেন্স সংযোজন করে) দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। কিন্তু দুর্গম উপকূল কিংবা পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে কোনো চিকিৎসক নেই, সেসব এলাকার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে পড়ে থাকা অসহায় লোকজনের খোঁজ রাখেন কয়জন?
আছেন একজন—বিশ্বজিৎ পাল। কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে মানুষ কোনো দিন চোখের চিকিৎসক দেখেনি, সেসব এলাকায় চক্ষু চিকিৎসার ক্যাম্পের মাধ্যমে বিশ্বজিৎ ছানি রোগী বাছাই করে নিয়ে আসেন কক্সবাজারের বায়তুশশরফ চক্ষু হাসপাতালে। তারপর চোখে লেন্স সংযোজন করে সেসব দৃষ্টিহীনকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় জীবনের আলো। গত ২২ বছরে ওই পাঁচ জেলার দুর্গম এলাকায় ১২ হাজারের বেশি চক্ষু ক্যাম্প পরিচালনা করে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এসব মানুষকে হাসপাতালে আনার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন বিশ্বজিৎ।
কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়গায়ের প্রয়াত স্কুলশিক্ষক ক্ষিতীশ চন্দ্র পালের ছেলে বিশ্বজিৎ পাল ছোটবেলা থেকেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন নাটক এবং টেলিফিল্মেও অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১০ সালে বায়তুশশরফ সম্মাননা ও ২০০৮ সালে জাতীয় শিশু–কিশোর সংগঠন খেলাঘর সম্মাননা পান। ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসাবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি দুই সন্তানের জনক। তাঁকে সবাই জানেন ‘দৃষ্টিহীনের বন্ধু’ হিসেবে। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
‘চোখে ছানি পড়ায় ১০ বছর ধরে দেখছি না। টাকার জন্য অস্ত্রোপচার করতে পারিনি। অবশেষে সুযোগ হলো অল্প টাকায় অস্ত্রোপচারের। ভালো হয়ে গেছে চোখ। এখন সবকিছু আগের মতোই দেখতে পাচ্ছি। তাই খুব খুশি লাগছে। আর এ জন্য আমি বায়তুশশরফ চক্ষু হাসপাতালের মাঠ কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ পালের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনিই আমাকে বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ থেকে খুঁজে এনে চোখের আলো ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।’ বায়তুশশরফ চক্ষু হাসপাতালে স্বল্প খরচে চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে বিশ্বজিতের প্রতি এভাবে কৃতজ্ঞতা জানালেন ষাটোর্ধ্ব মাহবুব আলম। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ গ্রামে। মাহবুব আলম বলেন, আঘাত লাগার কারণে ২০০৮ সালে তাঁর বাঁ চোখটি অন্ধ হয়। এরপর থেকে তিনি কিছুই দেখতে পাননি। এখন সবকিছু আগের মতোই লাগছে।
একইভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বোয়ালখালীর সৈয়দনগরের কুলসুমা খাতুন (৭০) বলেন, ‘চোখে দেখতে না পেয়ে ১১ বছর ধরে চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু অস্ত্রোপচারের জন্য ১৪ হাজার টাকা জোগাড় করতে না পারায় চোখ ভালো হয়নি। এখন বিশ্বজিতের সহায়তার মাত্র দেড় হাজার টাকা খরচ করে চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছি।’ বাঁশখালীর জলদী গ্রামের লেদু মিয়া (৬৯) ১৩ বছর ধরে বাঁ চোখে দেখেন না। অস্ত্রোপচারের পর দুটি চোখই সমান সচল হয়ে উঠেছে তাঁর। তিনিও বিশ্বজিতের জন্য দোয়া করলেন প্রাণভরে।
হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর গত ২২ বছরে চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় ১২ হাজারের বেশি অস্থায়ী চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করে ৫ লাখ ৫০ হাজার রোগীর চশমা পরীক্ষা, ১ লাখ ৯০ হাজার রোগীর চক্ষু চিকিৎসা করা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চোখে লেন্স সংযোজন করে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষকে। ক্যাম্প পরিচালনা, রোগী বাছাই এবং সেখান থেকে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে এসে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়ে আবার রোগীদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার সব দায়িত্ব পালন করেন বিশ্বজিৎ পাল।
চক্ষুবিশেষজ্ঞ মুশফিকুর রহমান বলেন, বিভিন্ন এলাকায় হাজারো মানুষ এ হাসপাতাল থেকে প্রায় বিনা মূল্যে সেবা নিয়ে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাচ্ছেন। এর পেছনে বিশ্বজিৎ পালের রয়েছে বিরাট অবদান।
সার্জন সাইফুল ইসলাম বলেন, চারটি কারণে (বার্ধক্যজনিত, অন্য অসুখ, চোখের কোনো অসুখ ও আঘাতজনিত কারণে) চোখে ছানি হতে পারে। ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে ছানি অপারেশন করা হয়। এরপর কৃত্রিম লেন্স সংযোজন করা হয়। এই পদ্ধতিতে চোখে সেলাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না। রোগীও দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন।
বিশ্বজিৎ পাল বলেন, ‘সাধারণত ছানি রোগীর অস্ত্রোপচার করতে বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ১০-২০ হাজার টাকা খরচ হয়। তবে এ হাসপাতালে রোগীদের টাকার জন্য কোনো চাপ দেওয়া হয় না। এখানে আর্থিকভাবে অক্ষম রোগীদের বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া হয়। গাড়িতে করে এনে থাকা–খাওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়ে রোগীকে আবার গাড়িতে করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও পালন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটি চলে দানশীল মানুষের সহযোগিতায়। আমি প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে দৃষ্টিহীনদের খুঁজে আনি। তাঁরা চোখের আলো ফিরে পেয়ে যখন আমার দিকে স্নেহ–ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকান, তখন যেন স্বর্গীয় আনন্দ পাই। শুধু চাকরির অংশ নয়, এটা আমার তৃপ্তির জায়গা, আমার আলোর ভুবন।’