এই কথাটি মনে­­­ রেখো...

এক হাতে চোট, অন্য হাতে ব্যাট ধরে বল ঠেকিয়েছিলেন মাত্র একটি। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তামিম ইকবালের এই ‘দুঃসাহসী’ অভিযান স্মরণীয় হয়ে থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসে। সংগৃহীত
এক হাতে চোট, অন্য হাতে ব্যাট ধরে বল ঠেকিয়েছিলেন মাত্র একটি। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তামিম ইকবালের এই ‘দুঃসাহসী’ অভিযান স্মরণীয় হয়ে থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসে। সংগৃহীত
>ভক্ত-অনুরক্তদের সমর্থন ও ভালোবাসায় পূর্ণ জীবন তামিমের। কিন্তু সেখানেও আছে কিছুটা দুঃখবোধ। একটি–দুটি ম্যাচে খারাপ খেললেই নিন্দুক-সমালোচকেরা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধিক্কারে-নিন্দায় দুর্বিষহ করে তোলে জীবন।

ব্যাট হাতে একটিও রান না করে যে একজন ব্যাটসম্যান ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে যেতে পারেন তামিম ইকবালের চেয়ে বড় প্রমাণ আর কোথায় মিলবে? শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এশিয়া কাপের সেই ম্যাচটির কথা আরেকবার মনে করুন। ভাঙা হাত নিয়ে যখন মাঠে নামছেন তিনি, তখন বাংলাদেশ দলের রান ২২৯। হাতে উইকেট আছে একটি। এক হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, চারটি আঙুল বেরিয়ে আছে গ্লাভসের বাইরে। অন্য হাতে ব্যাট। চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে কেন ক্রিজে এসে দাঁড়ালেন তামিম? 

সেই কেন’র উত্তর মিলল মাঠেই। এক হাতে ব্যাট ধরে বল ঠেকিয়েছেন মাত্র একটি। কিন্তু দলের সংগ্রহ ২২৯ থেকে ২৬১ গিয়ে পৌঁছাল শুধু এই ‘দুঃসাহসী’ অভিযানের কারণে। রান যা করার করেছেন মুশফিকুর রহিমই। কিন্তু তামিম সেদিন ভাঙা হাত নিয়ে এসে না দাঁড়ালে ইনিংসটা তো থেমে যেত আরও আগে। ৩২টি রান যুক্ত হলো বলে দল জিতল কি না সে কথা নিশ্চিত করে আজ বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশ সেদিন শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে আরও বড় ব্যবধানে। কিন্তু স্কোর কার্ড সব সময় প্রকৃত যুদ্ধের গল্পটা বলে না। যদি শ্রীলঙ্কা ২২৯ রানেই বেঁধে রাখতে পারত বাংলাদেশকে, তাহলে ওদের মনোবল বাড়ত কি না, খেলাটা বের করে নেওয়া সম্ভব হতো কি না একথা কে বলবে?
এসব ‘যদি’ ‘কিন্তু’র হিসেবে যাননি তামিম, বীরের মতো মাঠে নেমেছেন, ইতিহাসের পাতায় খোদাই করে এসেছেন নিজের নাম।
তাঁর আগে আর মাত্র দুজন ক্রিকেটার ভাঙা হাত সামলে অন্য হাতে ব্যাট নিয়ে মাঠে এসেছিলেন। ইংল্যান্ডের গ্রায়েম স্মিথ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যালকম মার্শাল।
আসলে তামিম ইকবালের ক্রিকেট জীবনের গল্পটাই সাহস ও বীরত্বের গল্প। ওপেনিংয়ে নেমে ১৫ ওভারের পাওয়ার প্লের সময়টাতে যে ব্যাটসম্যান কী রকম পাওয়ারফুল’ হয়ে উঠতে পারেন তা আমরা শুধু দেখতাম জয়সুরিয়া বা শচীন-শেবাগদের দিকে তাকিয়ে। তামিমই এসে দেখালেন আমরাও পারি। আজ ওপেনিংয়ে এসে ইমরুল, লিটন বা সৌম্য সরকার শুরু থেকেই বোলারদের ওপর চড়াও হওয়ার যে সাহস দেখাচ্ছেন, তাঁদের সামনে কার আগ্রাসী চেহারা ভাসে?
২০০৭ সালের আইসিসি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটার কথা ভাবুন। ত্রিনিদাদের কুইনস পার্ক ওভালে সৌরভ-শচীন-শেবাগ-দ্রাবিড়দের মতো তারকা খচিত দলটিকে ৫ উইকেটে হারানোর ভিতটা তো গড়ে দিয়েছিল তামিমের ৫৩ বলে ৫১ রানের ইনিংসটা। জহির খান-হরভজন সিংদের বল ৯ বার সীমানার বাইরে ফেলে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন সেদিন মাত্র ১৮ বছর বয়েসী ছেলেটি।
২০০৯ সালে কুইন্স স্পোর্টস ক্লাবের মাঠে জিম্বাবুয়ে যখন ৩১২ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিয়েছিল, তখন কে ভেবেছিল এই ম্যাচেও লড়াই সম্ভব। কিন্তু ১৫৪ রানের এক অসাধারণ ইনিংস খেলে তামিমই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কল্পনার পরিধি। সহজ জয় মুঠোয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল সেদিন টাইগাররা।
পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার মতো দলগুলোর বিপক্ষে এক দিনের ম্যাচে সেঞ্চুরি আছে। সেই ধারাবাহিকতা আছে টেস্ট ক্রিকেটেও।
টেস্টের কথা যখন এলোই, পরিসংখ্যানের জটিলতায় না গিয়ে একটি ম্যাচের কথাই বলি। সেটা ২০১০ সাল। ‘ক্রিকেটের মক্কা’ নামে পরিচিত লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৯৪ বলে শতক হাঁকিয়ে তামিম মাঠে দাঁড়িয়ে তাঁর জার্সির পেছনে লেখা নিজের নামটি দেখিয়েছিলেন আয়োজকদের উদ্দেশে। লর্ডসে সেঞ্চুরি করলে সেই ক্রিকেটারের নাম অনার বোর্ডে লেখা হয়, এই তথ্যটি জানা ছিল তাঁর। তাই জানিয়েছিলেন ‘আমার নামটিও লেখা।’
চট্টগ্রামে কাজীর দেউড়ি এলাকার এক ক্রীড়া পরিবারে জন্ম তামিম ইকবালের। তাঁর বাবা ইকবাল খানের নাম আজ অনেকেই হয়তো জানেন না। দুই ছেলে তামিম ও নাফিস, আর ভাই আকরাম খানের খ্যাতির নিচে অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে তাঁর কৃতিত্ব। কিন্তু ঢাকা ওয়াপদা দলের এই ফুটবলার শুধু নিজেই মাঠ দাপাননি, একসময় গড়ে তুলেছেন কেকেআরসি নামের একটি ফুটবল দল, যা পরে চট্টগ্রাম আবাহনী ক্রীড়াচক্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। অবসর গ্রহণের পর কোচিং করাতেন। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র বা সত্যজিৎ চক্রবর্তীর (রুপু) মতো খেলোয়াড়রা গড়ে উঠেছিলেন এই ইকবাল খানেরই পরিচর্যায়।
বাড়ির সামনে চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম। প্রায় শিশু বয়স থেকে আউটার স্টেডিয়ামে খেলে নিজেদের তৈরি করেছেন দুই ভাই তামিম ও নাফিস। একসময় চাচা সাবেক জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আকরাম খানের খ্যাতি দেখে অনুপ্রাণিত বোধ করতেন তামিম। আজ বিসিবি ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান আকরাম খান যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময়ে খেলার মাঠে ঘরের ছেলেটার নৈপুণ্য দেখেন।
ভক্ত-অনুরক্তদের সমর্থন ও ভালোবাসায় পূর্ণ জীবন তামিমের। কিন্তু সেখানেও আছে কিছুটা দুঃখবোধ। একটি–দুটি ম্যাচে খারাপ খেললেই নিন্দুক-সমালোচকেরা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধিক্কারে-নিন্দায় দুর্বিষহ করে তোলে জীবন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই নিন্দুকেরা তখন তাঁর যাবতীয় অর্জনকেই তুচ্ছ করে দিতে চায়। একসময় তো চাচা আকরাম খান নির্বাচক কমিটিতে আছেন বলেই জাতীয় দলে তাঁর স্থান হয়েছে এমন অভিযোগও শুনতে হয়েছে। কষ্ট পান, সেই কষ্ট বুকের ভেতর চাপা রেখে মাঠেই এসব সমালোচনার জবাব দিতে চান। কিন্তু রক্ত-মাংসের মানুষ তো, মাঝে মাঝে হতাশাও ভর করে মনে। রবীন্দ্রনাথের গানে যেমন শুনি, ‘এই কথাটি মনে রেখো, আমি গান গেয়েছিলাম...,’ তেমনি নিজের ক্রিকেট জীবনের সংগ্রাম-সাফল্য ও ত্যাগের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তামিমও যেন বলতে চান, ‘এই কথাটি মনে রেখো...।’