রোকেয়া সুলতানা

মশিউল আলম
মশিউল আলম

৯ আগস্ট, রাত ১১টা।
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘কাকে চাই?’
‘আপনি কে বলছেন?’
‘কী অদ্ভুত! ফোন তো করলেন আপনি। কাকে করেছেন?’
‘না, সরি, কলটা তো আমি দেখি নাই। কেমন করে জানি কল চলে গেল।’
‘ও, আচ্ছা।’
ও পাশে ল্যান্ডফোনের রিসিভার রেখে দেওয়ার শব্দ হলো। তারপর টুঁ টুঁ টুঁ।
আকরাম তার আইফোনটা কানের কাছে ধরেই রইল। মেয়েটির কণ্ঠস্বর এত মিষ্টি যে তার প্রতিটা শব্দের উচ্চারণে আকরামের কানে মধুবর্ষণ হচ্ছিল। আকরাম ফোনসেট কানের কাছ থেকে নামিয়ে রিসেন্ট কললিস্ট থেকে সর্বশেষ আউটগোয়িং কলের নাম্বারটা বের করে আবার কল করল। সেই মিষ্টি কণ্ঠস্বরই আবার বেজে উঠল।

‘হ্যালো!’

‘সরি, আপনি মনে হয় রাগ করে লাইন কেটে দিলেন।’

‘না, কিন্তু আপনি আবারও?’

‘সরি বলার জন্য কল দিলাম।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

‘বিরক্ত হননি তো?’

‘না, ওরকম হয়েই থাকে।’

‘থ্যাংক ইউ।’

‘কোথা থেকে বলছেন?’

‘ইস্কাটন।’

‘কী করা হয়?’

‘স্টুডেন্ট। আপনি?’

‘আমিও। আপনি কোথায় পড়েন?’

‘ঢাকা ভার্সিটি।’

‘তাই নাকি?’

‘আপনিও ঢাকা ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট?’

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র হয়ে এখনো ঢাকাতেই আছেন?’

‘তো কোথায় যাব?’

‘কী আশ্চর্য! এই অবস্থার মধ্যে আপনি ঢাকায় আছেন কী মনে করে?’

‘মানে?’

‘রাস্তাঘাটে বের হন, না মায়ের আঁচল ধরে দিনরাত বাসার মধ্যে লুকিয়ে থাকেন?’

‘আপনি এসব কী বলতেছেন?’

‘ঢাকা ভার্সিটির কোনো ছাত্র, যার মাথায় একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, যার বুকে দেশের জন্য একটুখানি ভালোবাসা আছে, সে কি এখন এই অবস্থার মধ্যে ঢাকায় থাকতে পারে?’

‘আঁ? কী বলছেন? কী অবস্থা?’

‘আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন তো, আপনার কোনো ছেলে ক্লাসমেট এখন ঢাকায় আছে কি না?’

‘খোঁজ নিতে হবে কেন? প্রতিদিনই তো আমাদের দেখা হচ্ছে...!’

‘কোথায় দেখা হচ্ছে?’

‘কেন? ক্লাসে দেখা হচ্ছে, ক্যাম্পাসে দেখা হচ্ছে, টিএসসিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হচ্ছে।’

‘আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?’

‘রসিকতা?’

‘মনে তো হচ্ছে রসিকতা করার জন্যই আপনি আমাকে ফোন করেছেন।’

আকরাম হেসে উঠল, হাসির শব্দটা একটু জোরেই হয়ে গেল। ঠিক ততটা জোরেই ওপাশে ফোনের রিসিভার রেখে দেওয়ার শব্দ হলো। সেই শব্দে আকরাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর উপলব্ধি করল, এত জোরে হেসে ওঠা ঠিক হয়নি।

১০ আগস্ট, সকাল ৮টা।

‘আবার আপনি ফোন করেছেন?’

‘সরি বলার জন্য কালকেই আবার কল দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আর রিসিভই করলেন না। খুব রেগে গেছিলেন?’

‘এটা রসিকতার সময় না।’

‘সত্যিই আমি রসিকতা করিনি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বলেন, আপনার জন্য কী করতে পারি?’

‘আপনার নামটাই কিন্তু জানা হলো না।’

‘রোকেয়া।’

‘বেগম রোকেয়া?’

‘এই যে, আবার! আপনি তো সত্যিই ফাজিল!’

‘সরি, সরি। রেখে দিবেন না, প্লিজ! আর করব না।’

‘আচ্ছা। নামটা জানতে পারি?’

‘আকরাম খান।’

‘খান?’

‘হুম।’

‘বিহারি নাকি?’

‘হা হা! বিহারি হতে যাব কেন? হানড্রেড পারসেন্ট পিওর বাঙালি।’

‘কথায় কথায় ইংলিশ বকেন কেন? বাংলা ভাষায় কি শব্দের আকাল পড়ে গেছে?’

‘আঁ?’

‘শতভাগ খাঁটি বাঙালি বলা যেত না?’

‘আপনি তো সাংঘাতিক মেয়ে! কোন ডিপার্টমেন্টে পড়েন?’

‘ইংলিশ।’

‘আরে! আমিও তো ইংলিশ ডিপার্টমেন্টেই! আপনি কোন ইয়ারে?’

‘থার্ড ইয়ারে। আপনি?’

‘আমিও থার্ড ইয়ারেই! কোন রোকেয়া আপনি?’

‘রোকেয়া সুলতানা। আপনি কোন আকরাম? আমাদের ক্লাসে আকরাম নামে কোনো ছেলে আছে বলে তো শুনিনি?’

‘ক্লাসের সব ছেলেকেই আপনি চিনেন?’

‘অবশ্যই। আপনি চেনেন না?’

‘প্রায় সবাইকেই তো চিনি। কিন্তু রোকেয়া সুলতানা নামে তো কোনো মেয়ে নাই। আপনার কোনো ডাকনাম আছে?’

‘রোকেয়া নামেই সবাই ডাকে।’

‘স্ট্রেঞ্জ! নিজের ক্লাসমেটকেই চিনব না, এটা হতে পারে নাকি?’

‘আপনি এখন রেগুলার ক্লাসে যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, আমি তো সব সময়ই রেগুলার ক্লাসে যাই।’

‘বুঝেছি।’

‘কী, কী বুঝেছেন?’

‘আপনি নিশ্চয়ই ইসলামী ছাত্র সংঘ করেন। আপনার মতো ছেলেরাই, এই আপনারাই পাকি আর্মিকে স্যারদের বাসায় বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আপনাদের হেল্প ছাড়া ওদের পক্ষে বেছে বেছে সবচেয়ে ভালো স্যারদের মেরে ফেলা সম্ভব হতো না। আপনারা বাঙালি নামের কলঙ্ক। কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক, ক্রিমিনাল। বাংলার মাটিতে একদিন আপনাদের বিচার হবেই।’

‘সরি? আপনি এসব কী বলতেছেন? কিছুই তো বুঝতে পারতেছি না!’

‘চুপ করেন! এই নাম্বারে আর কক্ষনো ফোন করবেন না!’

ওপাশে ফোনের রিসিভার রাখার শব্দটা এত জোরে আকরামের কানে আঘাত করল যে সে ভীষণ চমকে উঠল। ফোনসেটটা কানের কাছ থেকে নামিয়ে মুখের সামনে ধরে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

১০ আগস্ট, রাত ১০টা।

‘হ্যালো, এটা আকরাম, প্লিজ, ফোন রাখবেন না। জাস্ট এক মিনিট কথা বলব।’

‘বলেন।’

‘আপনার নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে।’

‘কী ভুল হচ্ছে? আপনি ইসলামী ছাত্র সংঘ করেন না?’

‘এটা কী জিনিস?’

‘আবার ফাজলামি শুরু করলেন?’

‘না না, সিরিয়াসলি, আমি কিন্তু আপনার কথাবার্তার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারতেছি না।’

‘আপনি যদি ইসলামী ছাত্র সংঘ না-ই করেন, তাহলে যুদ্ধে যাননি কেন?’

‘যুদ্ধে?’

‘আকাশ থেকে পড়লেন মনে হয়?’

‘কিসের যুদ্ধ? কোথায়?’

‘শোনেন, আকরাম খান সাহেব, আপনার যদি কোনো কাজ না থাকে, তাহলে ভাইবোনদের সঙ্গে লুডু-ক্যারম খেলেন, না হয় একা বসে বসে আঙুল চোষেন, খিদে পেলে মাকে ফিডারে দুধ ভরে দিতে বলেন, শুয়ে শুয়ে ফিডার খান। আমাকে আর বিরক্ত করতে আসবেন না, ঠিক আছে?’

‘স্ট্রেঞ্জ!’

১১ আগস্ট, সকাল ৭টা।

‘ম্যাডাম রোকেয়া সুলতানা, আকরাম বলছি। শেষবারের মতো আপনাকে ফোন করলাম। এরপর আর বিরক্ত করব না।’

‘বলেন।’

‘আপনার ওখানে এখন কটা বাজে?’

‘সাতটা। কেন? আপনার হাতে ঘড়ি নাই?’

‘বিরক্ত হবেন না, প্লিজ। সকাল সাতটা, না সন্ধ্যা সাতটা?’

‘কী শুরু করলেন আপনি?’

‘প্লিজ, বলেন।’

‘সকাল সাতটা।’

‘এটা কোন মাস?’

‘আগস্ট।’

‘কত তারিখ?’

‘এগারো তারিখ।’

‘কত সাল?’

‘উনিশ শ একাত্তর।’

‘ম্যাডাম, এখানেই আপনার ভুল হচ্ছে।’

‘আবার ফাজলামি শুরু করলেন?’

‘মোটেও না। সিরিয়াসলিই বলছি। এটা ২০১৮ সাল। ১১ আগস্ট। শনিবার।’

‘আজ বুধবার।’

‘১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট বুধবারই ছিল। কিন্তু আজ শনিবার।’

‘আচ্ছা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা, বলেন তো, যুদ্ধ শেষ হবে কবে?’

‘ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে।’

‘আমরা জিতব?’

‘হ্যাঁ। তবে অনেক মানুষ মারা যাবে।’

‘আরও অনেক মানুষ মারা যাবে?’

‘হ্যাঁ। তিরিশ লাখ ছাড়ায়ে যাবে।’

‘বলেন কী? তিরিশ লাখ! শেখ সাহেব ফিরে আসবেন তো?’

‘হ্যাঁ। পৃথিবী কাঁপায়ে ফিরে আসবেন। স্বাধীন বাংলাদেশ উনাকে মাথায় তুলে নিবে। উনি হবেন সূর্যের মতো।’

‘উনি তো সূর্যই!’

‘তারপর উনাকে মেরে ফেলা হবে।’

‘আঁ? কী বললেন?’

‘বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হবে, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়।’

‘থামেন! বাজে কথা বন্ধ করেন।’

‘শুধু উনাকে না, উনার গোটা ফ্যামিলিকে। বেঁচে যাবেন শুধু দুই মেয়ে। উনারা বিদেশে থাকবেন বলে বেঁচে যাবেন।’

‘কামাল-জামাল? মনি ভাই?’

‘সবাইকে। একদম বংশসুদ্ধা।’

‘কারা মারবে? পাকিরা?’

‘আরে না, স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা আসবে কোথা থেকে?’

‘তাহলে? আমেরিকানরা? সিআইএ?’

‘না। বাঙালিরাই।’

‘কী বলছেন! বাঙালিরা শেখ সাহেবকে মারবে, এটা কখনো সম্ভব?’

‘বঙ্গবন্ধুকে যারা মারবে, তাদের বিচার করা যাবে না—এ রকম একটা আইন পাস করা হবে।’

‘কারা এসব করবে?’

‘বঙ্গবন্ধুর নিজেরই লোকজন।’

‘তাজউদ্দীন?’

‘না। তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক থাকবেন না। তাঁকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হবে।’

‘কেন?’

‘সেটা তো আমি বলতে পারব না।’

‘বঙ্গবন্ধুর পর প্রধানমন্ত্রী কে হবেন?’

‘প্রধানমন্ত্রী না, প্রেসিডেন্ট।’

‘প্রেসিডেন্ট?’

‘হ্যাঁ। বঙ্গবন্ধুর দেশ প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে চলে যাবে। বঙ্গবন্ধুকে খুন করে প্রেসিডেন্ট হবেন খন্দকার মোশতাক।’

‘খন্দকার মোশতাক! বলেন কী! স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হবেন খন্দকার মোশতাক?’

‘হ্যাঁ, আরও সারপ্রাইজ আছে।’

‘বলেন বলেন!’

‘মোশতাকের পর প্রেসিডেন্ট কে হবেন, জানেন?’

‘কে?’

‘জিয়া।’

‘কোন জিয়া?’

‘মেজর জিয়া। চিটাগাং থেকে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, মনে আছে?’

‘সেই মেজর জিয়া প্রেসিডেন্ট হবেন?’

‘হ্যাঁ। মুখ ফসকে হলেও সেই ঘোষণা উনি কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই দিয়ে রাখছিলেন, মানে পাঠ করেছিলেন। আরও স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার হলো বঙ্গসন্তানেরা প্রেসিডেন্ট জিয়াকেও মেরে ফেলবে।’

‘বলেন কী! খালি খুনাখুনিই চলতে থাকবে?’

‘হ্যাঁ। কর্নেল তাহের, খালেদ মোশাররফ, জেনারেল মঞ্জুর—খুনের পর খুন। ক্যান্টনমেন্টে সাধারণ সিপাইরা বিদ্রোহ করে পঞ্চাশ-ষাটজন আর্মি অফিসারকে মেরে ফেলবে। প্রেসিডেন্ট জিয়া ফাঁসি দিয়ে মারবেন এয়ারফোর্সের পাঁচ-সাত শ সৈনিককে।’

‘আর শুনতে ইচ্ছা করছে না।’

‘জিয়া একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করবেন। সেই দল হবে স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষমতায় যাবে। জামাতে ইসলামীর লোকজন মন্ত্রী হবে। আরও কত অবাক কাণ্ড ঘটবে, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।’

‘যেমন?’

‘মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কেনাবেচা হবে...।’

‘মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট মানে?’

‘সার্টিফিকেট মানে বুঝলেন না? যাঁরা জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছেন, তাঁদের সার্টিফিকেট থাকবে না?’

‘কে দেবে সেই সার্টিফিকেট?’

‘কেন? সরকার দিবে।’

‘কী হবে সেই সার্টিফিকেট দিয়ে?’

‘কী হবে মানে? কত কিছু হবে! সরকারি চাকরিতে ৩০ পার্সেন্ট কোটা থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্য। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট থাকলে সরকারি চাকরির রিটায়ারমেন্টের বয়স বাড়বে। সে জন্য সরকারের সচিব পর্যায়ের লোকেরা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি করায়ে নিবে।’

‘ছি ছি ছি! এসব কী বলেন!’

‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ভরে যাবে। একটা করে সরকার আসবে, আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা লম্বা হতে থাকবে।’

‘থামেন, থামেন। আর বলার দরকার নাই।’

‘আর একটু শোনেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদেরকে সাপোর্ট করছে, নানাভাবে হেল্প করছে—এ রকম অনেক বিদেশি সিটিজেন, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন আছে না?’

‘আছে। সারা দুনিয়া আমাদের পক্ষে আছে।’

‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য, সেই বিদেশি বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য সরকার সোনার মেডেল দেওয়ার উদ্যোগ নিবে। তাঁদেরকে দাওয়াত করে এনে মহা ধুমধাম করে মেডেল দেওয়ার পর কী হবে, জানেন?’

‘কী হবে?’

‘ধরা পড়বে, কোনো সোনার মেডেলে একরত্তি সোনা নাই। সব ভেজাল।’

‘কী বললেন?’

‘লজ্জা-শরমে পাবলিকের মাথা হেঁট হয়ে যাবে, আর গবমেন্টের লোকেরা বলবে, হইছে হইছে, স্বীকৃতি দেওয়া হইছে এ–ই মেলা, মেডেলে সোনা নাই তো কী হইছে?’

‘আকরাম খান, আমার কিন্তু সত্যিই মনে হচ্ছে, আপনার রক্তে দোষ আছে!’

‘কী বললেন?’

‘ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, আব্বাস আলী খান, সবুর খান—এই সব ইভিল ক্রিয়েচারের রক্ত আছে আপনার শরীরে। নইলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে যে দল, সেই দল সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে এত খারাপ কথা আপনি বলতে পারতেন না।’

‘হা হা হা!’

‘ইতরের মতো হাসছেন কেন?’

‘ম্যাডাম, আমার বাবা একজন ফ্রিডম ফাইটার। আমার তিন মামা ফ্রিডম ফাইটার, এক মামা যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হয়েছেন। আমার দাদু বঙ্গবন্ধুর কনটেম্পোরারি আওয়ামী লীগার ছিলেন।’

‘তাই? সত্যি বলছেন?’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম, এক হরফ মিথ্যা বলি নাই।’

‘আকরাম, এত কিছু আপনি জানেন, একজন মানুষের খোঁজ কি এনে দিতে পারবেন আমাকে?’

‘কার কথা বলছেন?’

‘আমার বন্ধু। ক্র্যাকডাউনের রাতে জহুরুল হক হলে ছিল। ২৮ তারিখে আখাউড়া দিয়ে আগরতলা চলে গেছে। যাওয়ার আগমুহূর্তে একপলকের জন্য দেখা হয়েছিল। কিন্তু সেই যে গেল, তারপর থেকে ওর আর কোনো খবরই পাচ্ছি না। কোথায় আছে, কেমন আছে, কিচ্ছু জানি না।’

‘তাই? কী নাম আপনার বন্ধুর?’

‘রফিক। রফিকুল ইসলাম।’

‘ঢাকা ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট ছিল?’

‘হ্যাঁ। আমরা ক্লাসমেট। ও ফিরে এলে আমাদের বিয়ে হবে।’

‘ও, তাই?’

‘হ্যাঁ। আকরাম, আপনি যেন কোথায় থাকেন?’

‘ইস্কাটনে।’

‘আমাদের বাসা ধানমন্ডি। আবাহনী মাঠের ঠিক উল্টা দিকেই। এক কাপ চা খেতে আসবেন?’

‘নিশ্চয়ই আসব।’

১১ আগস্ট, সন্ধ্যা ৭ টা।

আকরাম ধানমন্ডি যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরোতেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামল। সে দৌড়ে ফিরে এসে বিল্ডিংয়ের গেটের কার্নিশের নিচে দাঁড়াল। বৃষ্টির বেগ বেড়ে উঠল, সঙ্গে ঝাপটা বাতাস। কার্নিশের নিচেও আকরামের জামাকাপড় ভিজে গেল। সে ঠিক করল, আজ নয়, কাল বিকেলে যাবে। ঠিক এই সময় এক খালি সিএনজি অটোরিকশা তার পাশে এসে দাঁড়াল, চালক চিৎকার করে বলল, ‘মামা, কই যাইবেন?’

আকরাম ভেজা কাপড়ে বাসাটার দরজার সামনে দাঁড়াল। কপালের পানি মুছে ভেজা হাতে কলিংবেলের বোতামে পরপর দুইবার চাপ দিল। একটু পর দরজা খুলে গেল, এক সুশ্রী তরুণীর মুখ দেখতে পেল আকরাম। সে গলা খাঁকরে বলল, ‘এটা রোকেয়া সুলতানাদের বাসা?’

‘হ্যাঁ। আপনি?’

‘আমি আকরাম। ইস্কাটন থেকে এসেছি।’

‘ও, ভেতরে আসেন।’

আকরাম ঘরের ভেতরে ঢুকতেই তরুণী বলল, ‘আপনি তো পুরাপুরি ভিজে গেছেন! বসেন, আসছি।’

তরুণী দ্রুতপায়ে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল, একটু পরেই একটা তোয়ালে নিয়ে ফিরে এল।

আকরাম দাঁড়িয়েই রইল। ওর কাপড়চোপড় এতটাই ভিজে গেছে যে সোফায় বসতে দ্বিধা হচ্ছে। তরুণী তোয়ালেটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বসেন।’

আকরাম ধন্যবাদ দিয়ে তোয়ালেটা দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে সোফায় বসল। তরুণী বলল, ‘আকরাম, আমি আপনার কথা শুনেছি।’

‘উনি আপনার কে হন?’

‘ফুপি।’

‘বাসায় নাই?’

‘না। হসপিটালে।’

‘আঁ? হসপিটালে? কী হয়েছে?’

‘ম্যাসিভ স্ট্রোক।’

‘কখন? কখন হলো এটা?’

‘আজ সকালে।’

‘উনি এখন কোথায়?’

‘ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে।’

‘কী অবস্থা এখন?’

‘আনকনশাস।’

আকরাম উঠে দাঁড়াল, ‘দেখতে দিবে না?’

‘উনি তো আনকনশাস।’

‘তবু যাই।’ আকরাম দরজার দিকে পা বাড়াল। তরুণী বলল, ‘এক কাপ চা খেয়ে যেতেন।’

‘উঁহু। আরেক দিন।’

আকরাম নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। আকরামের কানে রোকেয়া সুলতানার কণ্ঠস্বর বেজে চলেছে।

l মশিউল আলম: কথাসাহিত্যিক।