লেখা যেন শুধু পড়ে নয়, শুনেও বুঝতে পারে

মাসিক সচিত্র সন্ধানী, ১৩ বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৬৯

জসীমউদ্‌দীন (১৯০৩–১৯৭৬)
জসীমউদ্‌দীন (১৯০৩–১৯৭৬)

খবরটা আগেই পেয়েছিলাম। তবে শতেক বিধি–নিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে শেষ অবধি এ বাংলায় এসে পৌঁছাতে পারবেন জসীমউদ্‌দীন, বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এসেছেন ১ জুলাই বিকেলে। কিছুটা বিস্ময় আর অনেকটা খুশি নিয়ে কবির সঙ্গে দেখা করার জন্য লেক রোডে গিয়ে পৌঁছলাম। মনোজ বসু ও মোহন লাল গঙ্গোপাধ্যায় কবির দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মনোজ বাবুর গৃহেই উঠেছেন কবি। মোহন লাল আর নেই। ঢাকাতেই তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলেন কবি।

গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়: আপনাকে পাসপোর্ট দেওয়ার সময় সরকার কোনো বাধানিষেধ আরোপ করেনি?

জসীমউদ্‌দীন: না, আমি স্বাধীন নাগরিক। খুশিমতো চলার অধিকার আমার আছে।

গো. চ.: আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় শিগগিরই পাকিস্তানে নির্বাচন হবে?

. উ.: আমি কবি মানুষ, রাজনীতি নিয়ে আমায় প্রশ্ন করবেন না।

গো. চ.: রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করব নাশুধু একটা ছোট জিজ্ঞাসা আছেপাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি এক আদেশ জারি করেছেন, অন্য দেশের মারফত রবীন্দ্রসংগীত তথা ভারতীয় সংগীতের রেকর্ড পাকিস্তানে নেওয়া নিষিদ্ধএ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

. উ.: কই, এ রকম আদেশ জারি করা হয়েছে বলে তো শুনিনি! আর সব ভারতীয় ‘গুডস’ আমদানি তো পাকিস্তানে অনেক দিন থেকে নিষিদ্ধ।

গো. চ.: আচ্ছা, পূর্ব বাংলায় এখন রবীন্দ্রসংগীত ও সাহিত্যের জনপ্রিয়তা কী রকম?

. উ.: খুব—খুব। ঢাকায় এ বছর অসংখ্য ছোট–বড় প্রতিষ্ঠান থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্‌যাপিত হয়েছে।

গো. চ.: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল–কলেজে কি এখনো রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ানো হয়?

. উ.: নিশ্চয়ই। রবীন্দ্রসাহিত্য বাদ দিয়ে বাংলা পড়ার মানেই হয় না।

গো. চ.: রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠ্য থাকলে ছাত্রদের চাহিদা মেটানোর জন্য নিশ্চয়ই বই ছাপানোর প্রয়োজনআপনারা কি বিশ্বভারতীর অনুমতি ছাড়াই রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থ সব ছাপছেন?

. উ.: না, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বই ছাপানো নিষিদ্ধ। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের বই ছাপানো হচ্ছে না। আগে থেকেই লোকের কাছে যা কপি আছে, তা–ই দিয়েই কোনোমতে কাজ চালাচ্ছে।

গো. চ.: তাতে কি এই বিপুল চাহিদা মেটানো সম্ভব?

. উ.: কোনো কোনো অধ্যাপক গোড়ায় ভূমিকা জুড়ে দিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য সংকলন প্রকাশ করছেন। যেমন অধ্যাপক অজিত গুহ গীতাঞ্জলি বের করেছেন ভূমিকা জুড়ে।

গো. চ.: ঢাকার বেতার ও টেলিভিশনে এখন রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হয় বা রবীন্দ্রনাথের নাটক অভিনীত হয় কি?

. উ.: হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। মাঝে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমরা আবার আন্দোলন করে তা চালু করিয়েছি। এই কয়েক দিন আগেও তো টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক অভিনীত হলো। টেলিভিশন আমার পছন্দ নয়। ওটা একটা পাবলিক নুইসেন্স। আমার বাড়িতে এখনো তাই আনিনি।

গো. চ.: আপনি টেলিভিশনকে ‘পাবলিক নুইসেন্স’ মনে করছেন কেন?

. উ.: ওতে বিকৃত রুচির আধুনিক সব গান–বাজনা পরিবেশিত হয়।

গো. চ.: ভালো অনুষ্ঠানও হয়এই তো বললেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক ও সংগীতও পরিবেশিত হয় সেখানেআর সুরুচিসম্পন্ন অনুষ্ঠান পরিবেশন করানোর দায়িত্ব তো আপনাদের

. উ.: এই কদিন আগে আমাকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে একটা জীবন্তিকা করেছিল টেলিভিশনে। ভালোই হয়েছিল অনুষ্ঠানটি। আমি পল্লির মানুষ। তাই হয়তো টেলিভিশন সহ্য হয় না। তবে আর কদিন? ছেলেমেয়েদের বায়নায় পড়ে শেষ পর্যন্ত টেলিভিশন হয়তো আনতেই হবে।

গো. চ.: আমরা এ বাংলার লোকেরা ওখানকার সাহিত্য সম্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহীওখানের সাহিত্যে কোন শাখাটা সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে?

. উ.: উপন্যাস। সুন্দর গদ্য লেখা হচ্ছে সেখানে। শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক; খন্দকার ইলিয়াসের কত ছবি, কত গান; জহির রায়হানের প্রাগৈতিহাসিক খুব ভালো উপন্যাস। তাছাড়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আ ন ম বজলুর রশীদ, মহিউদ্দিন, আবদুল গণি হাজারি—তারাও কয়েকটি উৎকৃষ্ট উপন্যাস লিখেছে। শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ—তাঁরাও ভালো ভালো গল্প–উপন্যাস লিখছেন।

গো. চ.: ঢাকায় মেয়েরা কেউ লিখছেন না?

. উ.: অনেকেই লিখছেন। দিলারা হাশেমের ঘর মন জানালা আর মনোয়ারা বেগমের গোধূলির লগ্ন তো দুটি অনবদ্য উপন্যাস।

গো. চ.: পূর্ব বাংলার সাহিত্যে এখন কোন বিষয়টা প্রাধান্য পাচ্ছে—সমসাময়িক ঘটনা, ধর্ম, পল্লি বা শহুরে জীবনের সংঘাত?

. উ.: জীবনের ঘাত–প্রতিঘাত নিয়ে প্রধানত উপন্যাস লেখা হচ্ছে। তরুণ সাহিত্যিকেরা আজ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে। গ্রামবাংলার ছবি, গ্রামবাংলার জীবন উপন্যাসে বেশি ঠাঁই পাচ্ছে।

গো. চ.: পূর্ব বাংলার আধুনিক কবিতা কতটুকু উন্নত হয়েছে

. উ.: দেখুন, আধুনিক কবিতা সম্পর্কে আমি বেশি উৎসাহী নই। জনগণের কথা বলছে, অথচ সে কবিতার ভাষা দুর্বোধ্য। আমাদের দেশের শতকরা ৯০ জন লোক অশিক্ষিত ও পল্লিবাসী। এ কদিন তাদের কথা জেনেই আমি লিখতে শুরু করি। গ্রামবাংলার সুন্দর ছবি, সেখানকার সহজ–সরল জীবন, গ্রামীণ ধান আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। ভেবে দেখলাম, তাদের সংস্কৃতি আছে, সুস্থ সংস্কৃতি অবহেলারও নয়। পৃথিবীতে তাদের অনেক কিছু দেওয়ার আছে। তাই তাদের নিয়ে লিখতে শুরু করি তাদেরই মুখের ভাষায়। আমি সব সময় একটা কথা মনে রাখি, আমি জাতীয় কবি। আমি এমন ভাষায় লিখব, যাতে তারা আমার লেখা শুধু পড়া নয়, শুনেও বুঝতে পারে। চিনতে পারে নিজেদের আমার সাহিত্যে। সাহিত্যের সার্থকতা আমি সেখানেই খুঁজি—আধুনিক কবিতায় আমি যে জিনিস খুঁজে পাই না।

গো. চ.: আপনি আধুনিক কবিতা একেবারেই পড়েন না?

. উ.: পড়ি না যে, তা নয়, মাঝেমধ্যে পড়ি। সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে—তাঁদের কবিতা থেকে যেমন আলাদা আলাদা করে তাঁদের চেনা যায়, আমাদের তরুণেরা আধুনিক কবিতায় সবাই মিলেমিশে একাকার। কবিতা পড়ে তাঁদের আলাদা করে চিনে উঠতে পারি না।

গো. চ.: হালে সংবাদ–এ পূর্ব বাংলার কবিতার ওপর একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছেলেখক হুমায়ুন কবিরতিনি তাতে বলেছেন, ‘বলা হয়ে থাকে যে বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় কবিতার ফলন আশাব্যঞ্জকউক্তিটি যদি উৎপাদনসংখ্যার নিরিখে করা হয়, তাহলে ন্যায্য বলে মেনে নেওয়া যেতে পারেএ ছাড়া দুঃখজনকভাবেই স্বীকার করতে হয় যে পূর্ব বাংলার কবিরা সাময়িকভাবে কোনো পৃথক চেতনার, এমনকি কাব্যশরীরের সন্ধান দিতে পারেননি, যা তিরিশের কবিতা থেকে আমূল পৃথক’—এ উক্তি কদ্দুর সত্যি?

. উ.: আমার তো মনে হয়, মন্তব্যটি যথার্থ। কয়েকজন অবশ্য ভালো কবিতা লিখছেন। বেগম সুফিয়া কামাল তাঁদের একজন। প্রবন্ধ ও বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদেও পূর্ব বাংলা বেশ উন্নত হয়ে গেছে। বদরুদ্দীন উমর, আশরাফ সিদ্দিকীর বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ বেরিয়েছে। শিশুসাহিত্যে রোকনুজ্জামানও খুব নাম করেছেন।

গো. চ.: আচ্ছা, পূর্ব বাংলায় কি সাহিত্যকে এখন জীবিকা হিসেবে নেওয়া চলে?

. উ.: হ্যাঁ। অনেকের তো সাহিত্য ছাড়া কোনো উপজীবিকা নেই, যেমন সৈয়দ শামসুল হক। শামসুল হকের বইয়ের কাটতি তো আছেই, তা ছাড়া প্রায়ই উপন্যাস চিত্রায়িতও হচ্ছে বেশ। পূর্ব বাংলার সাহিত্য সম্পর্কে আমি আশাবাদী।

গো. চ.: বর্তমানে পূর্ব বাংলায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রধান অন্তরায় কী বলে আপনার মনে হয়?

. উ.: পাঠক। পাকিস্তানে এখনো পশ্চিম বাংলার মতো পাঠক তৈরি হয়নি। তা ছাড়া পত্রপত্রিকার সংখ্যাও কম। কলকাতার যেমন অনেক পূজাসংখ্যা বেরোয়, ঢাকাতে তা নেই। ঈদে দৈনিক পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যা বের করে বটে, তবে তাতে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধেরই মাত্র স্থান সংকুলান হয়।

গো. চ.: পশ্চিমবঙ্গের তরুণ লেখকদের কারও লেখা আপনি পড়েছেন কি?

. উ.: আমার স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। সবার নাম মনে থাকে না।

গো. চ.: বিমল কর, প্রফুল্ল রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, দিব্যেন্দু পালিত, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

. উ.: তাঁদের কারও লেখা পড়িনি। আমি তাঁদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। তাঁদের লেখা থেকে ‘ইনস্পায়ারড’ হতে চাই। তবে সন্তোষ কুমার ঘোষ, শংকর—তাঁদের লেখা পড়েছি। আরেকজন তরুণ লেখকের লেখা পড়েছি (নামটা স্মরণ করতে পারছিলেন না); ওই যে গঙ্গা যাঁর লেখা।

গো. চ.: সমরেশ...

. উ.: হ্যাঁ, হ্যাঁ। সমরেশ বসু।

গো. চ.: পূর্ব পাকিস্তানে এখানকার লেখকদের জনপ্রিয়তা কী রকম?

. উ.: খু-উ-ব। কলকাতায় কোনো লেখা পেলেই তো আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি।

গো. চ.: আমরাও ওখানকার সাহিত্যের পরিচয় পেতে আগ্রহীআপনি কি দুই বাংলার আত্মিক যোগাযোগে বিশ্বাসী? যদি করেন, তাহলে কীভাবে সেটা সম্ভব?

জ. উ.: আমি আত্মিক যোগাযোগ বলতে এটাই বুঝি যে পূর্ব বাংলায় আমরা হিন্দুদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে সুযোগ–সুবিধা দেব, তুলে ধরার চেষ্টা করব, আর পশ্চিমবঙ্গেও তেমনি হিন্দুরা মুসলমানদের জন্য তা–ই করবেন।