কিংবদন্তিদের সঙ্গে

>

মোহাম্মদ রফির সঙ্গে
মোহাম্মদ রফির সঙ্গে

বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের কিংবদন্তি রুনা লায়লা। সংগীতের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে কাজ করতে গিয়ে দেশের বাইরের বহু কিংবদন্তি শিল্পীর সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভারতের মোহাম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে এবং সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল জুটি। ঈদ আনন্দের ক্ষণে ছোট ছোট গল্পে সেই সুখস্মৃতির কথাই বললেন রুনা লায়লা। 

বলিউডে আমি প্রথম গান গাই ১৯৭৫ সালে। ছবির নাম এক ছে বারকার এক। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন বিখ্যাত সুরকার কল্যাণজি-আনন্দজি। ওই ছবির শিরোনাম গানটিই আমি গাই। পর্দায় গানটি ছিল হেলেনের ওপর। সম্ভবত ওই বছরই দ্বিতীয় সুযোগটি পাই বাপ্পী লাহিড়ীর সুরে মোহাম্মদ রফি সাহেবের সঙ্গে গান গাওয়ার। যেদিন ভয়েস দেব, সেদিন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ঢুকেই দেখি, মোহাম্মদ রফি আগেই এসে স্টুডিওতে বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তে আমার যে কী অনুভূতি হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না। তিনি দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম দিলেন। আমিও সালামের জবাব দিলাম এবং তাঁর পায়ে ধরে সালাম করে বললাম, ‘আপনার সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি, এটা আমার জন্য বিরাট একটা ব্যাপার। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।’ 

তিনি হেসে বললেন, ‘আপনার মতো এত ভালো একজন শিল্পীর সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি, এটা আমার জন্য একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।’ 

তাঁর কথাগুলো শুনেই আমার চোখে পানি চলে এল। ওই মুহূর্তে নিজেকে কীভাবে যে সামলেছি, তা আমি জানি না। কারণ, এত বড় একজন শিল্পীর কাছ থেকে এ রকম প্রশংসা ও সম্মান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাঁর সঙ্গে গান গাওয়াটাও ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। কারণ, ছোটবেলা থেকেই যাঁদের গান শুনে শুনে বড় হয়েছি, তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। 

এরপর সুযোগ এল মোহাম্মদ রফি সাহেব, কিশোর কুমার দাদা ও রাহুল দেব বর্মণ দাদার সঙ্গে এক মঞ্চে অনুষ্ঠান করার। বিশাল এই অনুষ্ঠান হয়েছিল কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে। পরপর দুই বছর আমরা একসঙ্গে এই অনুষ্ঠান করি। সেখানে তাঁদের তুলনায় আমি অনেক নবীন এক শিল্পী। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে যে সম্মান পেয়েছি, তা কখনোই ভুলতে পারব না। 

লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে

লতার ভালোবাসা : আশার স্নেহ

লতাজি আর আশাজি ছোটবেলা থেকেই আরও অনেকের মতো আমারও আদর্শ ছিলেন। দুজনের গান শুনে শুনে বড় হয়েছি। অনেক কিছু শিখেছি। ১৯৭৪ সালে লতাজির সঙ্গে প্রথম দেখা হয় আমার। সে বছর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনের পক্ষ থেকে আমাকে কলকাতা, দিল্লি ও বোম্বেতে (এখন মুম্বাই) শো করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বোম্বেতে যখন আমি শো করতে যাব, তখন আয়োজক ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, আমার বিশেষ কোনো চাহিদা আছে কি না। সে সময় আমি বললাম, ‘সম্ভব হলে লতাজির সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি আমার স্বপ্নের একজন মানুষ ও শিল্পী। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে আমার শিল্পীজীবন ধন্য হবে।’ তাঁরা জানালেন, এটা প্রায় অসম্ভব। কারণ, তিনি কোথাও যান না। তবু আমরা চেষ্টা করব। 

যেদিন অনুষ্ঠান, সেদিন দিনের বেলা ব্যাক স্টেজে মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে মহড়া করছিলাম আমি। হঠাৎ দেখলাম, ব্যাক স্টেজের প্রবেশদ্বার দিয়ে সাদা শাড়ি পরা কেউ একজন আসছেন। পাশে আরও দু-তিনজন। দূর থেকে লতা দিদির মতোই মনে হলো। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ, এত বড় একজন শিল্পী, তিনি কেন পেছনের দরজা দিয়ে আসবেন? কাছাকাছি আসতেই মনে হলো, আমি বুঝি স্বপ্ন দেখছি। এ তো লতা দিদি! দৌড়ে তাঁর পায়ে ধরে সালাম করতে গেলাম, তিনি আমাকে ধরে তুললেন। বললেন, ‘না না, পায়ে ধরে সালাম করবেন না।’ 

আমি বললাম, ‘না, আমাকে করতেই হবে।’ তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেক আশীর্বাদ করলেন। অনেক আদর করলেন। তারপর অনেকক্ষণ আমরা গল্প করলাম। অনেক কথা জানতে চাইলেন তিনি। বললেন, ‘আমি আপনার অনেক গান শুনেছি। খুব ভালো লাগে আপনার গান।’ তাঁর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে আমি আসলে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছি। এরপর থেকে যখনই কলকাতা বা বোম্বে গিয়েছি, তখনই ফোন করে কথা বলেছি। তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। এখনো প্রায়ই তাঁর বাড়িতে আমি যাই। তিনি আমার জন্মদিনে, ঈদ বা কোনো উপলক্ষে উপহার পাঠান, শাড়ি পাঠান। বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ান। অনেক আড্ডা হয় সে সময়। খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে লতাদির সঙ্গে, তাঁর পরিবারের সঙ্গে। আমিও যেন ধীরে ধীরে তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে গেছি। 

রুনা লায়লা। ছবি: প্রথম আলো
রুনা লায়লা। ছবি: প্রথম আলো

লতা মঙ্গেশকর আমাকে ভালোবাসা দিয়েছেন, আর তাঁর বোন আশা ভোসলে দিয়েছেন স্নেহ। আশাজির সঙ্গে আমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তেমনভাবে মেলামেশা বা কথা বলার সুযোগ হয়নি। কয়েক বছর আগে ভারতের সাহারা ওয়ান টিভি চ্যানেলে ‘সুর ক্ষেত্র’ নামের রিয়েলিটি শোতে বিচারক ছিলাম আমরা তিনজন—আশা ভোসলে, পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী আবিদা পারভিন ও আমি। ওই সময়ই আরও ভালোভাবে বুঝতে পারলাম, আশা ভোসলে কত বড় মাপের শিল্পী এবং কত বড় একজন মানুষ। তাঁর সঙ্গে মিশে মনে হলো, আমাদের বন্ধুত্ব অনেক বছরের।

তিনি খুব ভালো রান্না করেন। ওই অনুষ্ঠান চলাকালীন একদিন আমাকে বললেন, ‘আপনি লাঞ্চ অর্ডার করবেন না, আমি রান্না করে নিয়ে আসব।’ এরপর ঠিকই একদিন অনুষ্ঠানের সেটে তিনি আমার জন্য বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে এলেন, আরেক দিন বড় গলদা চিংড়ি। তাঁর আন্তরিকতা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। যখনই আমাদের দেখা হতো, প্রতিবারই আমি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। আর তিনি আমাকে আদর করে বলতেন, ‘আপনিও আর্টিস্ট, আমিও আর্টিস্ট। আপনি আমার বন্ধু, আমার পায়ে হাত দিয়ে আর সালাম করবেন না।’

কিন্তু আমি বলেছি, ‘ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো, বোনের মতো, মায়ের মতো—যা-ই হোক না কেন—আমি আপনাকে যেভাবে সম্মান করি, যতবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে, ততবারই এভাবেই আপনাকে সম্মান করব।’

সেই থেকে তাঁর সঙ্গে খুব গভীর একটা সম্পর্ক হয়ে গেল। তিনি তাঁর বাড়িতে আমাকে দাওয়াত করেন, নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ান, উপহার পাঠান। বিনিময়ে আমিও যেটুকু পেরেছি, দিয়েছি। 

লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সঙ্গে
লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সঙ্গে

লক্ষ্মীকান্তের আন্তরিকতা

বিখ্যাত দুই সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালজির সুরে দুবার গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তাঁদের সুরে প্রথম প্লেব্যাক করি জিতেন্দ্র-জয়াপ্রদা অভিনীত স্বপ্ন কা মন্দির ছবিতে। এরপর গাই অমিতাভ বচ্চন অভিনীত অগ্নিপাত চলচ্চিত্রে। স্বপ্ন কা মন্দির ছবিতে গান গাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর যখন আমি গানটি তুলতে যাই, তখন দেখলাম, লক্ষ্মীকান্তদার আশপাশে আমার গাওয়া অনেক অডিও ক্যাসেট। আমি তো অবাক! আমাকে তিনি বললেন, ‘আমরা আপনাকে ভেবেই সুর করছিলাম। এ কারণেই আপনার গাওয়া বিভিন্ন ধরনের গানের ক্যাসেট শুনতে হয়েছে আপনার গায়কি ঠিকমতো বোঝার জন্য।’ একটা কাজের ব্যাপারে তাঁরা যে কী পরিমাণ আন্তরিকতা, নিবেদন ও শ্রম দেন, এই কাজ করতে গিয়ে তার প্রমাণ পেলাম। দেখলাম, আমি পাকিস্তানে যে ধরনের গান করেছি, যেসব সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি, সবকিছুই তাঁদের জানা। মোটকথা আমার সম্পর্কে সব ধরনের ধারণা নিয়েই কাজটা করেছেন। 

এই কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্মীকান্তদার সঙ্গে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেল। তাঁর বাড়িতে একাধিকবার দাওয়াত করে খাইয়েছেন। একদিনের কথা মনে পড়ে। লক্ষ্মীকান্তজির মেয়ের গানের খুব শখ। তিনি আমাকে তাঁর মেয়ের গাওয়া একটা গান দিয়ে বললেন, ‘ওর গানটা একটু শুনে বলেন তো, ও শিল্পী হতে পারবে কি না।’ আমি বললাম, ‘লক্ষ্মীকান্তজি, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? আপনি এত বড় মাপের একজন সুরকার। এটা তো আপনি নিজেই আমার চেয়েও বেশি ভালো বলতে পারবেন।’ 

তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমি তো ওর বাবা। আমি তো পক্ষপাত করতে পারি। বরং আপনি শিল্পী হিসেবে যাচাই করতে পারবেন।’ এ কথা শুনে খুবই অবাক হয়েছিলাম সেদিন, পাশাপাশি ভালোও লেগেছিল।