'উপাচার্য-কথা' নিয়ে কিছু কথা

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া, তাঁদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্যদের নিয়োগ—এসব বিষয়ে গত এক যুগে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। বড় আকারে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন উপাচার্যকে নিয়ে ‘উপাচার্য–কথা’ নামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয় ২০০৭ সালের মার্চে। এসব প্রতিবেদনে একেকজন উপাচার্য কীভাবে বেপরোয়া দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করছেন, তা তুলে ধরা হয়েছিল।

২০০৭ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত প্রথমটির শিরোনাম ছিল ‘উপাচার্য খলিলুরের দুর্নীতি ও অনিয়মই এখানে নিয়ম’। সেদিনই পদত্যাগ করেন উপাচার্য খলিলুর রহমান। ১৪ মার্চ লেখা হয় ‘উপাচার্য বারীর দুর্নীতির ভার বইতে পারছে না উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’। এর পরদিন তাঁকে অপসারণ করা হলে প্রথম আলোর শিরোনাম হয় ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বারীমুক্ত’।

এরপর ধারাবাহিকভাবে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ছাপা হয় ‘সাবেক উপাচার্যের দুর্নীতির হাল ধরেছেন বর্তমান উপাচার্য’। সাবেক উপাচার্য মু. ওয়াহিদ-উজ-জামান দুর্নীতির টাকা হজম করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়কে ফেরত দিয়েছিলেন।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল খায়ের সম্পর্কে ছাপা হয় ‘তহবিল খালি করে ফেলেছেন উপাচার্য’। একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘দুর্নীতির হাত ধরে হাজী দানেশ থেকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মোশাররফ’। অধ্যাপক মোশাররফ হোসাইন মিঞাকে পরে অপসারণও করা হয়।
১৬ মার্চ ছাপা হয় ‘শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির চাষ’। তাঁর বিদায়ও সুখকর ছিল না।

আর ১৭ মার্চ ছাপা হয় ‘উপন্যাসের নায়ক শাহজালালের সাবেক উপাচার্য ড. মোসলেহ উদ্দিন’। ছাত্র আন্দোলনের মুখে তিনি রাতের বেলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

‘উপাচার্য নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন চান শিক্ষাবিদেরা’—১৮ মার্চ শেষ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল এটি। সেই পরিবর্তনটাও এসেছিল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটি) মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সার্চ কমিটি বাদ দিয়ে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে শুরু করে।

উপাচার্যদের ছবি দিয়ে তাঁদের অনিয়ম-দুর্নীতি বা আমলনামা সম্পর্কে এমন ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দৃষ্টান্ত অতীতে ছিল না। ২০০৭ সালের মার্চে প্রথম এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল প্রথম আলো। ঠিক এক দশক পর ২০১৬ সালে এসে উপাচার্যদের আমলনামা পর্যালোচনা করে দেখে প্রথম আলো। উপাচার্য পদে ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও অন্যায় ও অনৈতিক কাজের ধরন খুব একটা পরিবর্তন হয়নি; বরং অনেকে উপাচার্য পদের মর্যাদাহানি করেই চলেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে এক ডজনেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, প্রায় সব সংকটের কেন্দ্রে​ আছেন উপাচার্যরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাসিরউদ্দিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হককেও কার্যত বিদায় নিতে হয়েছে আন্দোলনের মুখে। উন্নয়নকাজের জন্য ছাত্রলীগকে টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একাংশের আন্দোলন চলছে। নিয়োগ প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তুলে আন্দোলন করছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।

কয়েক মাস ধরে নিয়মিত উপাচার্য নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবরার ফাহাদ হত্যার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা অস্থিরতা চলছে, সেখানে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে তাঁর পদ্যতাগ চান শিক্ষকেরা।

উপাচার্যের ওপরই নির্ভর করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন এবং এগিয়ে যাওয়া। এমন একজন উপাচার্য দেখতে চান প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, সেখানকার শিক্ষক–শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। আর তাঁদের এই যৌক্তিক প্রত্যাশার সঙ্গে প্রথম আলো ছিল, আছে এবং থাকবে।