'মছলিখোর বঙ্গালি'

বাংলাদেশে যেমন নদী-নালা-খাল-বিল-হাওরের অন্ত নেই, তেমনি অন্ত নেই নানা স্বাদের নানা প্রজাতির মাছেরও। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশে যেমন নদী-নালা-খাল-বিল-হাওরের অন্ত নেই, তেমনি অন্ত নেই নানা স্বাদের নানা প্রজাতির মাছেরও। ছবি: প্রথম আলো

বাঙালির বিরুদ্ধে অনেক অপবাদ। ভিতু বাঙালি, ভেতো বাঙালি। ইতিহাসবিস্তৃত বাঙালি। অতিকথনপ্রিয় বাঙালি। এসব নিন্দা ছাড়াও আরেকটি অপবাদ আছে। আর তা হলো—মছলিখোর বঙ্গালি। নিরামিষভোজী উত্তর ভারতীয়রা অনেকটা গালির ঢঙেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে এ কথাটি বলে থাকে। নিরামিষভোজীরা মনে করে, তারা বড্ড বেশি বনেদি, আর মত্স্যপ্রিয়রা হীনস্য হীন। ওই সব উন্নাসিকেরা বাঙালি ও মাছের বিরুদ্ধে যা-ই বলুক না কেন, মাছ যে সভ্যতার প্রদোষকালেও মানুষের প্রধান খাদ্যের একটি ছিল, তা অনস্বীকার্য। পশুমাংসের সঙ্গে ধৃত মত্স্যও যে আদিম মানুষেরা পুড়িয়ে খেত, তা তো ইতিহাসস্বীকৃত।

Shurja
Shurja

বাঙালির খাদ্য সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে প্রাকৃতপৈঙ্গল গ্রন্থটির কথা মনে পড়বে। বইটিতে অজ্ঞাতনামা এক কবির একটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে, ‘ওগ্গর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা, গাইক ঘিত্তা দুদ্ধ সজুত্তা।/ মোইলি মচ্ছা ণালিচ গচ্ছা, দিজ্জই কন্তা খা পুণবন্তা।’ তরজমা এ রকম, ‘কলার পাতায় ঢালা ফেনসহ গরম ভাত, কিছু গাওয়া ঘি, গরম দুধ, মৌরলা মাছ, নালিতাশাক স্ত্রী পরিবেশন করছে, পুণ্যবান খাচ্ছে।’

বাংলাদেশের মত্স্যপ্রীতি কিন্তু আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাছে যথেষ্ট অপ্রীতিকর ছিল। বাংলার স্মৃতিকার ভট্ট ভবদেব ও শ্রীনাথাচার্য নানা যুক্তি দিয়ে মাছ খাওয়াকে সমর্থন করলেও উন্নাসিক আর্যদের কাছে তাঁদের যুক্তিতর্ক ধোপে টেকেনি। রুই, পুঁটি, শোল, এমনকি ইলিশের অমৃতময় স্বাদকে তারা বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে। তাতে বাঙালির কিচ্ছুটি আসে যায় না। মাছের সঙ্গে বাঙালির শুধু খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক নয়, ধর্মজীবনেরও অনুষঙ্গ। মাছ পুজো-আর্চা ও মঙ্গল অনুষ্ঠানে লক্ষ্মীশ্রীর প্রতীক। মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মাছের প্রসঙ্গ বারবার উল্লেখিত হয়েছে।

হিন্দুদের যে দশজন অবতার পুরুষ, তাঁদের প্রথমটি মত্স্য। কোন ভারতবাসী রাশি মানে না? সেই বারোটি রাশির একটি মীন। শুধু বাঙালির নয়, গোটা ভারতবর্ষীয় সংস্কার-সংস্কৃতি মাছের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রবাদ আছে, ‘মাছের নামে গাছও হাঁ করে।’ ভূতদের মধ্যে আছে মেছোভূত।

১৪৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কৃত্তিবাস ওঝা বাঙালির অতিপ্রিয় দুই রকম মাছের কথা তাঁর রামায়ণে লিখে গেছেন, ‘ভাল মত্স্য আন সবে রোহিত চিতল।/ শিরে বোঝা কান্ধে ভার বহরে সকল।’

বিজয়গুপ্ত আর দ্বিজবংশীদাস মনসামঙ্গল কাব্যের দুজন বিখ্যাত কবি। প্রথমজন বরিশালের, দ্বিতীয়জন ময়মনসিংহের। দুজনই তত্কালীন পূর্ববঙ্গের মানুষ। পূর্ববঙ্গে এখনো নদী-নালা-খাল-বিল-হাওরের অন্ত নেই। অন্ত নেই নানা স্বাদের নানা প্রজাতির মাছেরও। পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশে দুই ধরনের জল—মিষ্টি জল আর নোনা জল। মাছও দুই ধরনের, মিষ্টি পানির মাছ আর নোনা পানির মাছ। নোনা পানির মাছ মানে সমুদ্রের মাছ। রুই, কাতলা, কই, মাগুর, চিংড়ি, চিতল, পুঁটি এবং কখনো কখনো ইলিশও মিঠা পানির মাছ। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
থেকে বলতে পারি, মিঠা পানির মাছের চেয়ে নোনা পানি মানে সমুদ্রের মাছের প্রজাতি ও পরিমাণ অনেক বেশি। ওই যে গুপ্তকবি তপসে মাছের গুণকীর্তন করে গেছেন, সেই তপসে মাছও কিন্তু সমুদ্রের।

সমুদ্রের কথা উঠলই যখন, সামুদ্রিক মাছের একটা তালিকা দেওয়া যাক চট্টগ্রামের সমুদ্রোপকূলের জেলেদের লোকজ উচ্চারণে। ইলিশ, পাঙাশ, ঘোঁওড়া, রুপচাঁদা, ইঁদুর লেইজা, চেঁউয়া, চেরবডি, চিকা, উড়াইল্যা, ঠুঁইট্যা, কাকিয়া, বাইলা, চিত্রা বেলি, নীলদাগি, ভোল, খইবাই, ছয়দাগি পার্স, বারগুনি, ডুই, সুন্দ্রা, দারকুটা, খলা, আদো, মুড্ডা, লইট্যা, পিরানহা, অলুয়া, গলদা, করকইজ্যা, হিঁজরা, শাপলা, কাঁউইন, দাতিনা, কোরাল, লাম্বু, গাউঙ্গা কই, ফাঁইস্যা, পোপা, লাক্ষা, টেংরা, আইড়, ডাউক, বাইম, মেটকা, কাঁইলা, নাইল্যা, কয়রা, ফানসা, মলা, ফ্যাসা, করাতি চিলা, গুইজ্জা, কাটাবুখা, হাঙর এবং আরও অনেক অনেক প্রজাতির মাছ বঙ্গোপসাগরে আছে।

প্রতিটি জাতের আবার অনেক উপজাতি। এক হাঙরের কথাই ধরা যাক। বিলাই হাঙর, মুইচ্চা হাঙর, জেবরা হাঙর, মেটে হাঙর, কামোট, নীল হাঙর, কালা হাঙর, থুট্টা হাঙর, ছুরি কাসট, কউন্যা হাঙর ইত্যাদি। এদের সবাইকে নিয়ে হাঙররাজ বাঘার সাম্রাজ্য।

সব প্রজাতির মাছই যে এখন আর সমুদ্রে পাওয়া যায়, তা নয়। অনেক মাছ হারিয়ে গেছে। যেমন চেরবতি, ছেরফাদরি, হিঁজরা, রাউজ্যা। সাগরের মাছদের মধ্যে কিছু কম পানির, কিছু গহিন জলের। গহিন জলের মাছগুলো মরেধরে সামান্য হলেও বেঁচেবর্তে আছে। কিন্তু উপকূলের কম পানির মাছ রাবণের মতো নির্বংশ হয়ে গেছে। মানুষেরা নদীর কূলে কূলে প্রাণবিনাশী নানা কারখানা গড়ে তুলেছে। তার বর্জ্যে কূলবর্তী ছোট প্রাণের মাছেরা সবংশে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ধরাতল থেকে।

আর আছে অবাধে মাছ শিকার। ছোট-বড়, দাঁড়বাহিত, ইঞ্জিনচালিত হাজার–লাখ নৌকা-বোট-জাহাজ গোটা বঙ্গোপসাগর দিনরাত চষে বেড়াচ্ছে। বাঁচবে কী করে মাছেরা? জালেরও তো নানা ধারা—ছোট ফাঁকের, বড় ফাঁকের, মাঝারি ফাঁকের। মাছ ধরার জাহাজগুলোতে জাল হওয়া উচিত বড় ফাঁকের। তারা তো শুধু বড় সাইজের মাছগুলোই সংরক্ষণ করে। নির্দ্বিধায় ছোট মাছগুলো জলে ছুড়ে দেয়। কিন্তু মাছ ধরছে ছোট ঘেরের জালে।

এখন সরকার পরিকল্পনা করে বছরের কিছু সময় মাছ ধরা বিরত রাখছে। এতে সমুদ্রে মত্স্য প্রজনন যথাযথভাবে হচ্ছে। পরিকল্পনাটি মূলত করা হয়েছে ইলিশকে লক্ষ্য করে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন—এই চার মাস ইলিশের মৌসুম। আমি তো বলি, ইলিশ স্বর্গীয় মত্স্য। অমৃত কখনো দেখিনি, খাইওনি। কিন্তু ইলিশ খেয়ে যে কেউ অমৃতের স্বাদ নিতে পারেন। বিখ্যাত খাদ্যরসিক রাধাপ্রস গুপ্ত তাঁর মাছ আর বাঙালি বইতে বলেছেন, ইলিশ কাব্যে উপেক্ষিত। তাতে কী হয়েছে, বাঙালির কাছে তো সমাদর পেয়েছে! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি শুরুই হয়েছে ইলিশ দিয়ে, ‘নৌকোর খোল ভরিয়া মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকমক করে। মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’

আমি চাকরির প্রথম জীবনে নীলফামারী জেলায় চাকরি করেছি। চট্টগ্রাম থেকে মাঝেমধ্যে ট্রাকভর্তি মাছ যেত। বাজারে দেখতাম ওই অঞ্চলের ক্রেতারা পাঙাশ, কাঁইলা, ছুরি, ইলিশ কিনছে; রুপচাঁদা অবহেলায় পড়ে আছে এক পাশে। আমি যখন কিনতে চাইতাম, বিক্রেতা অবাক হয়ে তাকাত আমার দিকে। বুঝে যেত, আমি নীলফামারীর নই।

একটি মাছ অবশ্য ইদানীং খুব জাতে উঠেছে, সে লইট্যা। নরম শরীর। রান্নার পর ওর ধরন হয় ঘন থিকথিকে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মানুষ ছাড়া অন্য জেলার মানুষেরা খেত না। সেই দিন পাল্টেছে। পাঁচ তারকা হোটেলেও এখন লইট্যা ফ্রাই পাওয়া যায়। ছুরি শুঁটকি, রুপচাঁদা, লইট্যা ফ্রাই বাঙালির কাছে কী রকম প্রিয়, কক্সবাজারের পৌউষি রেস্টুরেন্টে গেলে বোঝা যায়।

আরেক ধরনের মাছ, যা আমাদের বঙ্গোপসাগরেই পাওয়া যায়, শুধু বিদেশে, বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সে ঘোঁওড়া মাছ। এই মাছ এখন বাজারে পাওয়া যায় না। সব বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। ঘোঁওড়া মাছের চেয়ে ওর ডিম মহার্ঘ। তেমন করে লাক্ষা মাছের ডিমও এখন বাজারে ওঠে না। ওগুলো এখন সাহেবদের খাবার হয়ে গেছে।

মাছ উত্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন শুভ হাওয়া বইছে। এই সেদিন প্রথম আলোয় দেখলাম, পুকুরে মাছ উত্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগমন ঈর্ষণীয়। আগের তুলনায় উত্পাদন এখন ১২ গুণ বেশি। চিংড়ি, রুই, শিং, মাগুর তো আছে, তেলাপিয়া আর পাঙাশের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। সব ঠিক আছে, এসব মাছের
স্বাদ কি আছে আগের মতো? পাঙাশ সমুদ্রের
মাছ। আমাদের বাড়িতে যে বেলা সাগরে ধরা পাঙাশ রান্না করা হতো, মা হাঁড়িতে সের-আধা সের চাল বেশি দিত। পাঙাশে বা তেলাপিয়ায় আগের স্বাদ নেই। এগুলো সমুদ্র বা প্রকৃত পুকুর থেকে
হ্যাচারি বা কৃত্রিম পুকুরে এসে জাত যেমন হারিয়েছে, স্বাদও হারিয়েছে। রুইয়ের স্বাদও কি আগের মতো আছে?

শুনেছি ইলিশকেও নাকি কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে হ্যাচারি বা পুকুরে উত্পাদনের জোর প্রচেষ্টা চলছে। আমি নিশ্চিত, বিজ্ঞানীরা যদি সফল হন, ইলিশ তার স্বাদ হারাবে। বাজারে মেছোদের সামনে ইলিশ অবহেলায় পড়ে থাকবে এককোনায়। কিনবে না ক্রেতারা, করুণভাবে একটু হাসবে শুধু।

এটুকু বলে লেখাটা শেষ করা যায়, মাছ আছে বলেই বাঙালি আছে। বাঙালি আছে বলে মাছের কদরও আছে।

হরিশংকর জলদাস কথাসাহিত্যিক